: শেখ একেএম জাকারিয়া :
বিশ্ব ভালোবাসা দিবস বা সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীতে একমাত্র ব্যতিক্রমধর্মী বছর সংক্রান্ত উৎসবের দিন, যা ফেব্র“য়ারির ১৪ তারিখে উদযাপিত হয়। বর্তমানে এ দিবস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে উদযাপিত হয়ে থকলেও অর্ধেকের বেশি দেশেই দিনটি ছুটির দিন নয়। এ দিনে প্রেমিক-প্রেমিকা, হিতৈষী- স্বজন, স্বামী-স্ত্রী, বাবা-মা-সন্তান, শিক্ষক -শিক্ষার্থীসহ নানা রকম বন্ধনে আবদ্ধ মানবজাতি পরস্পরের কাছে তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করে। পুরো পৃথিবীতে এ দিনটিকে মহাসমারোহে আনন্দনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করা হয়। এ দিনে অবকাশ যাপনের উদ্যান ও বিনোদন কেন্দ্রগুলো প্রিয়মানুষে ভরতি থাকে।
প্রতিবছর ভালোবাসা দিবসে প্রিয়মানুষদের সবাই ফুলসহ নানাধরণের উপটৌকন প্রদান করে থাকে।
এ দিবসের আনুষ্ঠানিক নাম সেন্ট ভ্যালেন্টাইন’স ডে। অন্য নাম ভ্যালেন্টাইন’স ডে। ভালোবাসা দিবস গত কয়েক বছর আগেও পৃথিবী জুড়ে এ সময়ের মতো জাঁকজমকভাবে পালন করা হতো না। দিবসটি শুধু আমেরিকার সংযুক্ত রাষ্ট্রসমূহ বা পশ্চিমের দেশে স্থিরিকৃত ছিল। মজার বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ধরে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে অথচ আমরা অনেকেই জানি না দিবসটি কীভাবে বা কোথা থেকে আসল। আসুন জেনে নিই বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের প্রাচীন ইতিহাস।
২৬৯ খ্রিষ্টাব্দ। ইউরোপে অবস্থিত ইতালির রোম নগরীতে সেন্ট ভ্যালেইটাইন’স নামযুক্ত খ্রিষ্টধর্মের অনুসারী একজন ধর্মপ্রচারক ও চিকিৎসক ছিলেন। ধর্ম প্রচারের অভিযোগে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস তাঁকে কয়েদ করেন। কারণ সে সময়ে রোমান সম্রাটের শাসনাধীন রাজ্যসমূহে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার নিয়মবহির্ভূত ছিল। কয়েদ থাকাকালীন তিনি অনির্দিষ্ট কোনো একজন কারারক্ষীর অন্ধ মেয়েকে রোগ নিরাময়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে সুস্থ করে তোলেন। যে কারণে সেন্ট ভ্যালেইটাইনের লোকপ্রিয়তা বেড়ে যায়। আর এসব দেখে সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস ভ্যালেইটাইনের প্রতি ক্ষুদ্ধ ও ঈর্ষান্বিত হয়ে গুরুতর অপরাধের শাস্তিস্বরূপ তাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করেন। সেদিন ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ ছিল। অন্য সূত্রে জানা যায়, সময়টি ছিল ২৭০ খ্রিষ্টাব্দ। সে সময়ে রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস নারী-পুরুষের বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে যুদ্ধের প্রতি পুরুষদের অনুৎসাহ সৃষ্টি হয়। সে সময়ে রোম নগরীর খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী পুরোহিত ‘ভ্যালেন্টাইন’ সম্রাটের নির্দেশ উপেক্ষা করে লুকিয়ে নারী-পুরুষের বিবাহবন্ধনের কাজ সম্পন্ন করতেন। এ সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ভ্যালেন্টাইনকে সম্রাটের নিকট ধরপাকড় করে নিয়ে আসা হয়। সম্রাটের আইন কেন অমান্য করা হয়েছে এ প্রশ্নের জবাবে ভ্যালেন্টাইন সম্রাটকে জানান, যিশুখ্রিষ্ট প্রবর্তিত ধর্মবিশ্বাসের কারণে কিংবা যুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে তিনি কাউকে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে নিষেধ করতে পারেন না। সম্রাট এসব কথা শোনার পর ভ্যালেন্টাইনকে কারাগৃহে পাঠান। কারাগৃহে থাকাকালীন সম্রাট তাকে খ্রিষ্টধর্ম পরিহার করে বহুকাল পূর্বের রোমান পৌত্তলিক ধর্মে ফিরে আসার প্রস্তাব দেন এবং প্রতিদানে তার সব অপরাধ মার্জনা করার কথা জানান। উল্লেখ্য, সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস অনাধুনিক রোমান পৌত্তলিক ধর্মে বিশ্বাস করতেন এবং সে সময়ে রোমান সম্রাটের শাসনাধীন রাজ্যসমূহে এ ধর্মের আধিক্য ছিল। যা হোক, ভ্যালেন্টাইন সম্রাটের প্রস্তাব মানতে অস্বীকৃতি জানান এবং যিশুখ্রিষ্ট প্রবর্তিত ধর্মের প্রতি প্রচণ্ড বিশ্বাস আছে এমন কথা পুনরায় ব্যক্ত করেন। সম্রাট ক্লডিয়াস সঙ্গে সঙ্গে তাকে প্রাণদণ্ডের নির্দেশ দেন। অনন্তর সম্রাটের নির্দেশে ২৭০ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৪ তারিখ ভ্যালেন্টাইনের প্রাণদণ্ড কার্যকর করা হয়। লোকশ্রুতি আছে, মৃত্যুদণ্ডের পূর্বে ভ্যালেন্টাইন অন্ধ মেয়েটিকে বিদায় জানিয়ে একটি চিরকুট লিখেছিলেন। তাঁকে হত্যার পর কারাপ্রধান চিরকুটটি মেয়েটির হতে দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল, ইতি তোমার ভ্যালেন্টাইন (ঋৎড়স ুড়ঁৎ ঠধষবহঃরহব)। মেয়েটি চিরকুটের ভেতরে বসন্তের হলুদ ত্রৌকস ফুলের আশ্চর্য সুন্দর রং দেখতে পেয়েছিল। এর কারণ হচ্ছে ইতোমধ্যে ভ্যালেন্টাইনের চিকিৎসায় মেয়েটির অন্ধচোখে দৃষ্টি ফিরে এসেছিল।পরবর্তীতে রোমান সম্রাটের শাসনাধীন রাজ্যসমূহে খ্রিষ্ট ধর্মের প্রাধান্য সৃষ্টি হলে পাদ্রি ও চিকিৎসক ভ্যালেন্টাইনকে ঝধরহঃ হিসেবে ঘোষণা করে। ৩৫০ খ্রিষ্টাব্দে রোম নগরীর যে জায়গায় ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল সে জায়গায় তার স্মৃতি রক্ষার্থে একটি গির্জা বানানো হয়। অতঃপর ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে পোপ সেন্ট জেলাসিয়ুস ১ম জুলিয়াস ভ্যালেইটাইন’স স্মরণে চৌদ্দই ফেব্রুয়ারিকে ভ্যালেন্টাইন দিবস ঘোষণা করেন। সে থেকে এ দিনটিকে মানবজাতি ভ্যালেন্টাইন্স ডে হিসেবে পালন করে আসছে। তাছাড়া লোকশ্রুতি আছে, অনাধুনিক রোমে ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল রোমান দেব-দেবীর রানি জুনোর সম্মানে ছুটির দিন। জুনোকে নারী ও প্রেমের দেবী বলে লোকে বিশ্বাস করত। কারও কারও মতে চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস হওয়ার কারণ ছিল এটিই। তবে এ মত সর্বজন স্বীকৃত নয়, দ্বিমত আছে অনেকের। ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উৎপত্তি সম্পর্কে আরেকটি সম্পূর্ণ ভিন্নমত আছে। এই মতের লোকেরা বিশ্বাস করে, ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে প্রিয়মানুষকে ভালোবাসার বার্তা পাঠানোর আদৌ কোনও সম্পর্ক নেই। বহুকাল পূর্বে মানুষের বিশ্বাস ছিল, ১৪ ফেব্রুয়ারি হলো পাখিদের বিবাহের দিন। পাখিরা বছরের দ্বিতীয় মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ডিম পাড়া শুরু করে। আবার কারও মতে, মধ্যযুগের শেষদিকে মানুষ বিশ্বাস করত, এদিন থেকে পাখিদের মিলন ঋতু শুরু হয়। পাখিরা সঙ্গী খুঁজে বেড়ায়। পাখিদের দেখাদেখি মানুষও তাই সঙ্গী নির্বাচন করে এ দিনে। তবে গবেষকগণ মনে করেন উল্লিখিত মতগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম মত দুটি এই সময়ে গ্রহণযোগ্য ও সর্বজন স্বীকৃত।
তবে এটা সত্য যে, ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে যে ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র উদ্ভব হয়েছিল, সে দিবসটি প্রথম দিকে পৃথিবীব্যাপী তেমনভাবে প্রচার ও প্রসার লাভ করেনি। নুনাধিক সকলেই অবগত পশ্চিমের দেশে জন্মদিনের অনুষ্ঠান, ধর্মীয় অনুষ্ঠান সবক্ষেত্রেই ভোগের বিষয়টি মুখ্য। তাই উপাসনালয়ের ভেতরেও মদ্যপান থেকে তারা বিরত থাকে না। খ্রিস্টীয় অনুভূতি ভ্যালেন্টাইন দিবসের কারণে নষ্ট হওয়ার অভিযোগে ১৭৭৬ খ্রিষ্টাব্দে ফ্রান্স সরকার ভ্যালেন্টাইন’স উৎসব আইনসম্মত নয় ঘোষণা করে। ইংল্যান্ডে ক্ষমতাসীন পিউরিটানরাও একসময় প্রশাসনিক ভাবে এ দিবস উৎযাপন করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এছাড়া অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরি ও জার্মানিতে বিভিন্ন সময়ে এ দিবসটি বর্জিত হয়।২০১৭ সালে পাকিস্তান সরকারও ইসলামবিরোধী হওয়ায় ভ্যালেন্টাইন উৎসব নিষিদ্ধ করে।
বর্তমানে, পশ্চিমা দেশগুলোতে এ উৎসব ঘটা করে উদযাপন করা হয়। পশ্চিমা দেশ ছাড়াও ভ্যালেন্টাইন’স দিবসের কদর এশিয়া মহাদেশে প্রবলভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বইপত্রাদি ঘেঁটে জানা যায়, যুক্তরাজ্যে প্রায় ১০০ কোটি পাউন্ড ব্যয় করে এই ভালোবাসা দিবসের জন্য শুভেচ্ছা কার্ড, ফুল, চকোলেট ও অন্যান্য উপহার সামগ্রী ক্রয় করতে। সবচে’ বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে এ দিবস উপলক্ষে যুক্তরাজ্যে প্রায় ২.৫ কোটি ও যুক্তরাষ্ট্রে ৩ কোটি শুভেচ্ছা কার্ড আদান-প্রদান করা হয়।
শেষকথা হচ্ছে, প্রচলিত এ পাশ্চাত্য কাহিনি বা ইতিহাস কতটুকু ঠিক, সেটা আমরা জানি না। তবে এটুকু জানি যে, ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কোনও বিশেষ দিনের প্রয়োজন হয় না। প্রতিটি দিন ভালোবাসার দিন, ভালোবাসা প্রকাশের দিন। তবুও প্রচলিত রীতি অনুসারে চৌদ্দই ফেব্রুয়ারি আমাদের কাছে বিশেষ একটি দিন হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সবাইকে ভালোবাসা দিবস-এর শুভেচ্ছা জানাই। প্রত্যেকের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভালোবাসায় পূর্ণ থাকুক, এই কামনা করি।