কাজিরবাজার ডেস্ক :
কঠোর লকডাউনের ষষ্ঠ দিনেও চোখে পড়ে বিপুল জনসমাগম আর যানজট। করোনাভীতি উপেক্ষা করে মানুষজন নানা অজুহাতে ঘোরাফেরা করছে। গত কয়েকদিনের তুলনায় এদিন রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ির পাশাপাশি রিক্সায় মানুষের বাড়তি যাতায়াত দেখা গেছে। বিভিন্ন সিগন্যালে বাড়তি যানবাহনের চাপে জটলাও ছিল। কাজের সন্ধানেও বেরিয়ে রাজপথের মোড়ে মোড়ে দেখা গেছে মানুষের জটলা। করোনা সংক্রমণের ভয়ঙ্কর পরিণতি দেখার পরও হুশ ফিরছে না অনেকেরই। মঙ্গলবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় শত শত মানুষকে কাজের সন্ধানে বের হতে দেখা গেছে। অন্যদিকে প্রধান সডকগুলোতে পুলিশের চেকপোস্টের কারণে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এদিকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে আরও এক ঘণ্টা ব্যাংক লেনদেনের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে। এতে সকাল দশটা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ব্যাংক খোলা থাকবে। সঙ্গত কারণেই এতে আরও বাড়বে মানুষের ঘর থেকে বের হবার প্রবণতা। এমন অবস্থায় করোনা সচেতন অনেকেই চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে লকডাউন কার্যকর করার কৌশল নির্ধারণের মতামত দিয়েছেন। এবারের লকডাউনে মানুষের এত বেশি বাইরে থাকার কারণ সম্পর্কে তারা বলছেন- “সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত কাঁচাবাজার চালু, ব্যাংক শিল্প কারখানা ও গার্মেন্টস ও রাত দশটা পর্যন্ত হোটেল খোলা রাখা এবং পর্যাপ্ত টহলের অভাবের জন্যই সড়কে এত মানুষের ভিড়। প্রথম লকডাউনের সময়েও মানুষের মাঝে যে ভীতি ছিল কিংবা ঘরে থাকার প্রবণতা ছিল এবার তা নেই। করোণার চলমান সংক্রমণের পরিণতি সম্পর্কে মানুষ সচেতন না হলে লকডাউনের বাস্তবায়ন করার কঠিন হয়ে পড়বে।
এবারের লকডাউনে এত মানুষের চলাচল সম্পর্কে করোনা সচেতন সাধারণ মানুষের মাঝেও এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। হেদায়েতুল ইসলাম নামের গুলশানের এক ব্যবসায়ী ফোনে বলেন, ঢাকাসহ সারাদেশের রাস্তাঘাট হাটবাজার দেখে মনে হয় লকডাউন নামেই। এবারের লকডাউন সম্পর্কে আমাদের অন্যরকম একটা আলাদা কৌতূহল ও ধারণা ছিল এজন্যই যে, প্রথমে বলা হলো শাটডাউন। পরে বলা হলো শাটডাউন নয়, লকডাউন। এখন বলা হচ্ছে বিধিনিষেধ। ঘোষণাতেই যদি তিন রকম মেসেজ আসে- তাহলে মানুষের মাঝে সেটার কার্যকর প্রভাব তেমন না পড়ারই কথা। তারপর দেখা গেল সেনাবাহিনী বিজিবি র্যাব পুলিশ মোতায়েন হলো। আবার অন্যদিকে কি করা হলো কাঁচাবাজার খোলা রাখা হলো সকাল ৯টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত, হোটেল খোলা রাত দশটা পর্যন্ত। সঙ্গে আছে শিল্প কারখানা ও গার্মেন্টস। অর্থাৎ এ ধরনের ২১ ক্যাটাগরির আওতায় মানুষকে ঘরের বাইরে আসার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এর ওপর যোগ হয়েছে মানুষের মিথ্যাচার ও ধোঁকাবাজি। এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে লকডাউন বাস্তবায়ন করা যাবে।
হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণের ভয়াবহ অবস্থায় কেন কাচাবাজার সারাদিন খোলা রাখতে হবে। এটা তো আর স্বাভাবিক সময় নয়। ধরে নিতে হবে একটা মহামারী বা যুদ্ধকালীন কঠিন সময়। এখন কেন মানুষের জন্য সাারাদিন কাঁচাবাজার খোলা রাখতে হবে? কাঁচাবাজার তো আজকাল সাতদিনেরটা একদিনেও কিনে রাখা যায়। কাঁচাবাজার সকাল ৮টা থেকে তিন ঘণ্টা খোলা রেখে অন্যান্য জরুরী প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংক যদি দুপুর বারোটার পর্যন্ত খোলা রাখলেই চলত। বেলা বারোটা থেকে ভোর ৭টা পর্যন্ত কার্ফুর মতো পরিস্থিতি ঘোষণা করলেই তো মানুষ আর তুচ্ছ অজুহাতে বের হতো না। কিন্তু এখন কি দেখছি আমরা কাঁচাবাজার থেকে একটা পলিথিনে দশ টাকার কাঁচামরিচ কিনে হাতে রেখে সারাদিন ঘোরার সুযোগ পাাচ্ছে মানুষ। টহলকারীরা আটক করলে কাঁচাবাজার আর চালডালের অজুহাত দেখিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। এখানেই তো শুভঙ্করের ফাঁকি রয়ে গেছে।
ওয়াহিদ খান নামের বিমানবন্দরের এক পরিবরহন ব্যবসায়ী ফেসবুকে লিখেছেন- রাজধানীর সব শিল্প কারখানা ও গার্মেন্টস খোলা রেখে লকডাউন বাস্তবায়ন কঠিন। হাজার হাজার গার্মেন্টসের লাখ লাখ শ্রমিক যদি প্রতিদিন সকাল বিকাল বের হয়- তাহলে তাদের সমাগম দেখে অন্যরাও বের হয়ে আসার উৎসাহ পায়। একই ভাবে মহল্লায় মহল্লায় যেভবে মানুষের গিজ গিজ চলাচল তা রোখার উপায় কি? সীমিত সংখ্যক নিরাত্তাকর্মী দিয়ে কি রাজধানীর প্রতিটি মহল্লায় চেক দেয়া সম্ভব?
লকডাউনে ষষ্ঠ দিন মঙ্গলবারও রাজধানীতে দেখা গেছে- পর্যাপ্ত যানবাহন ও মানুষের চলাচল। উত্তরা বিমানবন্দর, বনানী বাড্ডা, গুলশান রামপুরা, মালিবাগ মগবাজাার ফার্মগেট, আসাদগেট, মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার, রাসেল স্কয়ার, কল্যাণপুর ও গাবতলীসহ বিভিন্ন এলাকার অলিগলিতে মানুষের উপস্থিতি বেড়েছে আগের চেয়েও বেশি। তাদের কেউ বের হয়েছেন বাজার করতে, কেউ কর্মস্থলে যোগ দিতে, কেউ সকালের নাস্তা করতে। আবার কেউবা বের হয়েছেন শারীরিক কসরত করতে। গলির কিছু কিছু দোকানের সাঁটার অর্ধেক খোলা রেখে বিক্রি চলছে। ছোট কয়েকটি হোটেলে বসে খাওয়ার সুযোগও দেয়া হয়েছে। মহল্লার সাধারণ বাজারের পাশাপাশি ভ্যানে বিক্রি করার জন্য সবজির বিক্রেতাদের প্রস্তুতি নিতে দেখা গেছে। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে দেখা যায়- বেশ কিছু রিক্সা জটলা করে আছে। সেগুলোর সামনে কিছু অফিসগামী মানুষের ভিড়। তাদের কেউ কেউ চালকদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দরদাম করছেন। ভাড়া মিললে যাচ্ছেন, নতুবা অপেক্ষা করছেন। এমনকি গন্তব্য এক হলে ভাড়া ভাগাভাগি করে রিক্সায় উঠতেও দেখা গেছে। কিছু কিছু সড়ক পুরোপুরি খালি থাকায় উল্টো পথেও রিক্সা চলাচল করতে দেখা গেছে। এদিকে ঘোষিত কঠোর বিধিনিষেধ অমান্য করে রাস্তায় টিভি নাটকের শূটিং করায় ইউনিটের ১২ জনকে থানায় নিয়ে যায় রাজধানীর খিলগাঁও থানা পুলিশ। এরপর মুচলেকা রেখে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়।
এছাড়া কাজের সন্ধানে প্রতিদিনই বাড়ছে রাজপথে খেটে খাওয়া মানুষের ভিড়। উত্তরা আজমপুর বাসস্ট্যান্ডে থেকে শুরু করে মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজার পর্যন্ত দেখা গেছে অনেক খেটে খাওয়া অনেক মানুষের অপেক্ষমাণ আড্ডা। এমন ক’জন শ্রমিক বলেন- “মানুষের কাছে হাত পাততে পারি না। কাজ করেই খাই। লকডাউনের জন্য কাজে যোগ দিতে পারছি না। টাকা না থাকায় বাসায় বউ ছেলেমেয়েদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারছি না। তাই কাজের সন্ধানে এখানে এসেছি। যদি কারও প্রয়োজন হয়- তবে এখান থেকেই তারা আমাদের নিয়ে যায়।
দুপুরে শাহবাগ এলাকায় লকডাউনের অন্যদিনের তুলনায় জনসাধারণের বাড়তি চাপ দেখা গেছে। মোড়ে ডাব-শরবত এমনকি চায়ের দোকান ঘিরে রয়েছে মানুষের ভিড়। তারপর হঠাৎ চারটা চেকপোস্ট বসানোর পর শাহবাগ মোড় ফাঁকা হয়ে পড়ে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত বিপুলসংখ্যক লোকসমাগমের ওপর প্রচারিত একটি বেসরকারী চ্যানেলের প্রতিবেদনের পরই সেখানে একযোগে হাজির হয় র্যাব সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশ। তারা এক যোগে চারটি চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরু করলেই ম্যাজিকের মতোই ফাঁকা হয়ে পড়ে শাহবাগ।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছে, শাহবাগ মোড়ের দুদিকে চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি চালায় সেনাবাহিনী, র্যাব ও পুলিশের একটি চেকপোস্ট। সেনাবাহিনী টহল শেষ হলে এরপর সেখানে আসে বিজিবি। বাটা সিগন্যাল, কাঁটাবন হয়ে যেসব গাড়ি আসছিল, সেগুলো ফুটওভার ব্রিজের নিচে থামিয়ে প্রতিটি গাড়ি চেক করেছিল সেনাবাহিনী। এই চেকপোস্ট পেরিয়ে যেসব গাড়ি মৎস্য ভবনের দিকে যাচ্ছিল- সেগুলো আবার আটকায় র্যাব। এতে একদিকে যেমন দীর্ঘ যানজট হয়- তেমনিভাবে দুর্ভোগে পড়তে হয় সাধারণ মানুষের। শাহবাগে সেনাবাহিনীর দলটির নেতৃত্বে ছিলেন মেজর হাসান চৌধুরী। তিনি বলেন- আমরা প্রত্যেকটি গাড়ি থামিয়ে বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞেস করেছি। যারা সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি- তাদের জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ট্রাফিক পুলিশের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হয়। এছাড়া যারা মাস্ক ছাড়া বা থুতনিতে মাস্ক নামিয়ে চলছেন তাদের সতর্ক ও সচেতন করা হয় বলেও জানান মেজর হাসান।
দুপুর ১২টার দিকে শাহবাগ মোড়ে বারডেম হাসপাতালের সামনে মৎস্যভবনগামী রাস্তার মাথায় চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি শুরু করে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। এর পরপরই শাহবাগ মোড়ে আলাদা সড়কের মাথায় অবস্থান নিয়ে চেকপোস্ট পরিচালনা করে সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশ সদস্যরা। এ সময় প্রতিটি চেকপোস্টে গাড়ি ও রিক্সা থামিয়ে জনসাধারণকে বাইরে বের হওয়ার কারণ জানতে চান। মানুষজনের সবাই কোন না কোন কারণ উল্লেখ করলেও আশানুরূপ উত্তর না পেলে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করা হয়।
আরও কিছু সড়কে দেখা গেছে পুলিশের কঠোর তৎপরতা। গণভবন চেকপোস্টে দেখা যায়- ছোট-বড় প্রতিটি গাড়িই চেকিংয়ের আওতায় আনা হচ্ছে। যৌক্তিক কারণ দেখাতে পারলে যেতে দেয়া হচ্ছে অন্যথায় মামলা করা হচ্ছে। ফলে গাড়ির দীর্ঘ সারি তৈরি হয়েছে ওই রাস্তায়। শুধু গণভবন চেকপোস্টেই নয়, রাজধানীর রাসেল স্কয়ার, কল্যাণপুর ও গাবতলী চেকপোস্টেও একই অবস্থা দেখা গেছে।
সড়কে টহলরত পুলিশ জানিয়েছে- তুচছ অজুহাতে মঙ্গলবারও অনেক লোক ঘর থেকে বের হয়ে ধরা খেয়েছে। জাকির নামের একজন লোক তিনজনকে নিয়ে সকালে গিয়েছিলেন ধানমণ্ডির ন্যাশনাল ব্যাংকে। কিন্তু ফেরার পথে শাহবাগে তাকে আটকে দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। যথোপযুক্ত কারণ মনে না হওয়ায় তাকে এক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। দুপুর ১২টা থেকে শাহবাগ মোড়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে র্যাব। অভিযোগ করে জাকির বলেন, করোনায় তো ব্যাংক খোলা। জরুরী লেনদেনের জন্যই গিয়েছিলাম ব্যাংকে। এরপরও জরিমানা গুনতে হলো। এ সম্পর্কে ভ্রাম্যমাণ আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট পলাশ কুমার বসু বলেন, জরুরী লেনদেনের জন্য তিনি অবশ্যই যেতে পারবেন। তবে তিনি যেটা করেছেন এক চেকের টাকা উত্তোলনের কথা বলে তিনজনকে নিয়ে বের হয়েছিলেন- যা এই মুহূর্তে অগ্রহণযোগ্য।