কাজিরবাজার ডেস্ক :
রূপ বদলিয়ে গোটা বিশ্বকে আতঙ্কিত করা করোনার নতুন ধরনের নাম ডেল্টা। রূপান্তরিত এই ধরনের কারণেই বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। ডেল্টা ধরনে আক্রান্ত হলে রোগী পেটের অসুখে বেশি ভুগছেন। জ্বরের তীব্রতা কম ও গন্ধ না পাওয়ার উপসর্গ আলফা ও বিটার তুলনায় কম থাকছে।
অধিক সংক্রমণ ক্ষমতার কারণে ধরন বা প্রজাতির (বি.১.৬১৭.২) অতি সংক্রামক হওয়ায় একে ‘বিশ্বের জন্য উদ্বেগ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদারাময় গবেষণা কেন্দ্র (আইসিডিডিআরবি) এর গবেষণায় উঠে এসেছে ঢাকা শহরে করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ রোগীর শরীরে এই অতি সংক্রামক ভারতীয় ডেল্টা ধরনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার নতুন এই ধরনের উপসর্গগুলো কিছটুা আলাদা। আগের ধরনে আলফা ও বিটা থেকে উপসর্গে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। ডেল্টাতে গন্ধ চলে যাওয়ার ঘটনা কম ঘটছে। ডেল্টাতে জ্বরের তীব্রতা কম থাকলেও পেটের অসুখ বেশি হয়ে থাকে। আর কাশিও কম থাকছে। এই ধরন সংক্রমণ ক্ষমতা আলফা ও বিটার থেকে কয়েকগুণ বেশি।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে প্রথম ধরা পড়ে এই ডেল্টা ধরনটি। সার্স-কোভিড-২ এর একাধিক মিউটেশনের ফলে এই ভাইরাস যেন আগের থেকেও শক্তিশালী। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সমরতি যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে সেখানে দেখা গিয়েছে মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্বের ১০০টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। করোনাভাইরাসের থেকে এই মিউটেন্ট ধরন ২ থেকে ৩ গুণ বেশি সংক্রমক। ভারত, ব্রিটেন, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফের হানা দিয়েছে এই ডেল্টা ধরন।
হেলথ এ্যান্ড হোপ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান ডাঃ লেনিন চৌধুরী বলেন, করোনার ডেল্টা ধরনের উপসর্গে আলফা ও বিটা থেকে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। ডেল্টাতে আক্রান্ত বাংলাদেশের রোগীরা বেশিরভাগ পেটের অসুখে ভুগছেন। রোগীর জ্বরের তীব্রতা কম থাকছে। মাথাব্যথা, সর্দি ও হাঁচিও থাকছে এই প্রজাতিতে। এছাড়া বেশিরভাগ রোগীর শরীরে ব্যথাও থাকছে। এই প্রজাতিতে আক্রান্ত হলে রোগী ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আক্রান্ত হওয়ার ৫ দিনের মধ্যে ৪৮ শতাংশ রোগীর মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীরা ১০ দিনের মধ্যে চরম সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় চলে যাচ্ছে, না হয় সুস্থ হয়ে যাচ্ছে। আলফা ও বিটার তুলনায় বেশি অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। আগে আলফা ও বিটা ধরনে রোগীদের এতো দ্রুত স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটত না। ডেল্টা ধরনে করোনার চিকিৎসা সেবায় আলফা ও বিটা থেকে পৃথক কোন চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ডাঃ লেলিন চৌধুরী বলেন, সরকারীভাবে কোভিড প্রটোকল অনুযায়ীই চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। নতুন করে চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হচ্ছে না।
ডেল্টা প্রজাতি নিয়ে যুক্তরাজ্যের ইস্ট এ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক পল হান্টার বলেছেন, চিকিৎসকরা সম্প্রতি এই ভাইরাসে সংক্রমিত ব্যক্তিদের মধ্যে নানারকম উপসর্গ দেখতে পেয়েছেন। যার অর্থ করোনায় সংক্রমিত হওয়ার শুরুতে আগে যেমন কাশি ছিল পরিচিত উপসর্গ, সেটি আর থাকছে না। করোনায় সংক্রমিত বেশিরভাগ মানুষের শুকনো কাশি হয়, গায়ে জ্বর অনুভব করেন, ঘ্রাণ ও স্বাদ কমে যায়। অধ্যাপক হান্টার জানান, চিকিৎসকরা বিভিন্ন ধরনের লক্ষণের দেখা পেয়েছেন। তিনি বলেন, এক্ষেত্রে ঠাণ্ডা লাগার মতো আরও কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে যেমনঃ গলা ব্যথা এবং হাঁচি। জ্বর আসাটা খুব সাধারণ উল্লেখ করে তিনি জানান, ডেল্টা ধরনের ক্ষেত্রে ঘ্রাণশক্তি চলে যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। মাথাব্যথা এবং সর্দি বেড়ে যাওয়া সাধারণ লক্ষণ হিসেবে রেকর্ড করা হচ্ছে। কিন্তু আলফা ও বিটার ক্ষেত্রে ঘ্রাণ শক্তি চলে যেত।
অধ্যাপক হান্টার জানান, ডেল্টা ধরনের কারণে শরীর বিভিন্নভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। এটি আমাকে অবাক করে না কারণ অন্য ধরনের করোনাভাইরাসগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায়-প্রধানত চারটি উপসর্গ রয়েছে- এগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সাধারণ সর্দি জাগায়। এটিও সম্ভব যে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমিতদের মধ্যে কেউ কেউ এর আগে সংক্রমিত হয়েছিল বা ভ্যাকসিন নিয়েছিল। অতএব, তাদের বিভিন্ন উপসর্গ দেখা যাচ্ছে কারণ তাদের কাছে ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ইতোমধ্যে এ্যান্টিবডি রয়েছে।
ডেল্টা প্রজাতি নিয়ে বিবিসির কাছে কোভিডের উপসর্গবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক টিম স্পেক্টর বলেছেন, তরুণদের ক্ষেত্রে ডেল্টা প্রজাতিতে আক্রান্ত হওয়াটা মারাত্মকভাবে সর্দি লাগার মতোই মনে হতে পারে। যদিও তাদের খুব বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ার আশঙ্কা নেই, তবে তারা সংক্রামক হতে পারে এবং অন্যদের ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। যে কারও যদি সন্দেহ হয় যে, তিনি হয়তো কোভিডে আক্রান্ত হয়ে থাকতে পারেন, তা হলে তার অবশ্যই টেস্ট করানো উচিত।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এনএইচএসের মতে সাধারণত কোভিডের যে উপসর্গ দেখা যায় তা হলো: কাশি, জ্বর, স্বাদ ও গন্ধ না পাওয়া। কিন্তু অধ্যাপক স্পেক্টর বলছেন, এই উপসর্গগুলো এখন আর তেমন দেখা যাচ্ছে না। কোভিড আক্রান্ত হাজার হাজার মানুষের উপসর্গভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে এমনটি জানিয়েছে। তিনি বলেন, মে মাসের শুরু থেকে সবচেয়ে বেশি যে উপসর্গগুলো দেখা গেছে সেগুলো আগের উপসর্গগুলোর মতো নয়। এই পরিবর্তন ডেল্টা প্রজাতির সংক্রমণের কারণে হয়েছে। ডেল্টা প্রজাতির প্রথম ভারতে শনাক্ত করা হয়েছিল এবং এর পর থেকে যুক্তরাজ্যে এখন ৯০ শতাংশ সংক্রমণের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি। জ্বরের উপসর্গ এখনও একই আছে। কিন্তু প্রথম ১০টির মধ্যে এখন গন্ধ না পাওয়ার উপসর্গটি আর নেই, বলেন অধ্যাপক স্পেক্টর। মানুষের মনে হতে পারে যে, তারা হয়তো সাধারণ মৌসুমি ঠাণ্ডা লাগায় আক্রান্ত হয়েছে এবং এটা ভেবে তারা বাইরে বিভিন্ন পার্টিতে অংশ নিচ্ছে। এভাবে তারা আরও ছয়জনের মধ্যে এটি ছড়িয়ে দিতে পারে। একইভাবে যুক্তরাজ্যে যখন আলফা বা যুক্তরাজ্য ভ্যারিয়েন্টের আধিপত্য ছিল, তখন ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডন একটি রিএ্যাক্ট স্টাডি করেছিল ইংল্যান্ডের প্রায় ১০ লাখ মানুষের ওপর। সেখানে তারা কোভিডের সঙ্গে সম্পর্কিত আরও অনেক উপসর্গ পেয়েছিলেন। কোভিডের অন্য উপসর্গের পাশাপাশি করোনাভাইরাসের সংক্রমণের লক্ষণ হিসেবে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া, ক্ষুধামন্দা, মাথাব্যথা এবং পেশি ব্যথারও উল্লেখ পাওয়া গেছে। কোভিডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপসর্গগুলো হচ্ছে: নতুন করে ক্রমাগত কাশি, শরীরের উচ্চ তাপমাত্রা ও স্বাদ বা গন্ধ না পাওয়া।
করোনার ডেল্টা প্রজাতি প্রতিরোধে ড. মতিউর রহমান জানান, সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। করোনা থেকে বাঁচতে মানুষের ড্রপলেট থেকে দূরে থাকতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মানা, শতভাগ মানুষের মাস্ক পরা, নিয়মিত হাত ধোঁয়া ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে। তিনি আরও জানান, ডেল্টা প্রজাতি থেকে বাঁচতে যতটা সম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে। জীবিকা নির্বাহ ও সম্পূর্ণ নিরাপদ থাকতে বাসাবাড়িতে অবস্থান করতে হবে। শারীরিক ও মানসিক মনোবল ধরে রাখতে হবে। তিনি আরও জানান, করোনা প্রতিরোধে সরকারী নির্দেশনা মেনে চলতে হবে।