বায়ু দূষণ

22

মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক :

মানুষ বেঁচে থাকার প্রধান অনুষঙ্গ বায়ু বা বাতাস। বায়ু ছাড়া জীবজগৎ এক মুহূর্তও বাঁচতে পারে না। জীবন ধারণের অপরিহার্য উপাদান বায়ুকে দূষণ করছি আমরা নিজেরাই। যার ফলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশ দূষণ আধুনিক সভ্যতার অভিশাপ। পরিবেশ বিপর্যয়ের তিনটি উপাদান হলো- মাটি, পানি ও বায়ু। পরিবেশ দূষণের মধ্যে বায়ুদূষণ অধিক ক্ষতিকর। মানুষের অসচেতনার কারণে প্রতিনিয়ত বায়ু দূষিত হচ্ছে। পরিচ্ছন্ন-নির্মল বায়ু আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। বায়ুর গুণগতমান বজায় রাখা একান্ত জরুরি। প্রাকৃতিক শুদ্ধতা আর সজীবতাকে ছাপিয়ে আধুনিক কল-কারখানা, তথ্য প্রযুক্তি ও শিল্প বাণিজ্যের চরম উৎকর্ষ আজ মানব সভ্যতাকে এক উৎকন্ঠ বাস্তবতার মুখোমুখি এনে দাঁড় করিয়েছে। বায়ুদূষণ নিয়ে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা মারাত্মকভাবে উদ্বিগ্ন। বায়ুদূষণের পরিমাণ দিন দিন যে হারে বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে মানুষ সুপরিবেশের মধ্যে নয় দূষিত পরিবেশে বাচঁতে হবে। বায়ুদূষণ প্রবণতা এতটাই ভয়াবহ যে, প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, প্রচুর জীবন ও জানমাল ধ্বংস হচ্ছে। দূষণগুলোর মধ্যে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, প্লাস্টিকদূষণ, পানিদূষণ, মাটিদূষণ, নদীদূষণ ও বর্জ্য অব্যবস্থাপনার প্রভাব সবচেয়ে বেশি। বিশ্বে বায়ুদূষণে বাংলাদেশ প্রথম। এরপর পাকিস্তান, ভারত ও আফগানিস্তনা। সুইজারল্যান্ড ভিত্তিক দূষণ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারভিজুয়্যাল এসব তথ্য নিশ্চত করে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত ৩০টি শহরের মধ্যে ২২টি ভারতের। ৮টি পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও চীনে অবস্থিত। দিল্লির বাতাসে প্রতি ঘনমিটারে সূক্ষ্ম বস্তুকণার (পার্টিকেল ম্যাটার বা পিএম-২.৫) পরিমাণ ১১৩.৫, ঢাকায় ৯৭.১ ও কাবুলে ৬১.৮। যা স্বাস্থ্যের জন্য খুবই হুমকিস্বরূপ। কারণ প্রতি ঘনমিটারে পিএমের স্বাভাবিক মাত্রা ১ থেকে ১২ পর্যন্ত। সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় পিএম-২.৫ এর পরিমাণ বাংলাদেশ ৯৮, পাকিস্তান ৭৫, ভারত ৭২, আফগানিস্তানে ৬২, এবং বাহরাইনে ৫৯। ইন্টারন্যাশনাল গ্লোবাল বার্ডেন ডিজিজ প্রজেক্টের প্রতিবেদনে বিশ্বে মানুষের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বায়ুদূষণকে চার নম্বরে দেখানো হয়েছে। বিশ্বে প্রতিবছর ৭০ লাখ মানুষ বায়ুদূষণে মারা যায়। তন্মধ্যে ৭৫ শতাংশ মৃত্যুই ঘটে স্ট্রোক করে, বাকি ২৫ শতাংশ ফুসফুসের রোগে। বিশ্বজুড়ে বায়ুদূষণ নীরব ঘাতক হিসেবে বিবেচিত। এটা এখন একটা চ্যালেঞ্জ। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্যকরী পদক্ষেপ ও জনসচেতনতা না বাড়ালে ভবিষ্যতে ভয়াবহ বায়ুদূষণের প্রবণতায় পড়বে বাংলাদেশ।
পরিবেশ অধিদপ্তরের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, ঢাকা শহর বায়ু দূষণের জন্য প্রায় সাড়ে ৪ হাজার ইটভাটাকে ৫৮ শতাংশ দায়ী করা হয়, ডাস্ট ও সয়েল ডাস্ট ১৮ শতাংশ, যানবাহন ১০ শতাংশ, বায়োমাস পোড়ানো ৮ শতাংশ এবং শিল্পকারখানা, বিদ্যুৎ ও তাপ উৎপাদনকারী যন্ত্র থেকে উৎপন্ন ধোঁয়া, কঠিন বর্জ্য পোড়ানোর ফলে সৃষ্ট ধোঁয়া, দহন, অপরিকল্পিত নগরায়ন, ঘনঘন রাস্তা খনন, ড্রেনের ময়লা রাস্তার পাশে উঠিয়ে রাখা, গাড়ি থেকে নির্গত ধোঁয়া ৬ শতাংশ দায়ী। এছাড়াও অ্যাশ, ধূলিকণা, সীসা, কার্বন, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইডসমূহ এবং কার্বন ডাই-অক্সাইড প্রতিনিয়ত ভয়ঙ্কর গ্রিণহাউজ গ্যাসের উপস্থিতি বেড়েই চলেছে। একজন সুস্থ স্বাভাবিক লোক গড়ে দুই লক্ষ লিটার বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করে থাকে। দূষিত বায়ুর কারণে ফুসফুস ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যা ক্যান্সার হতে পারে। এটা মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। ইটভাটা থেকে নাইট্রোজেন, অক্সাইড ও সালফার-ডাই অক্সাইড অ্যাজমা, হাঁপানি, অ্যালার্জি, নিউমোনিয়া ও শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। বালুকণার মাধ্যমে ফুসফুসের স্লিকোসিস নামে রোগ সৃষ্টি হয়, যার ফলে ফুসফুস শক্ত হয়। কার্বন-মনো-অক্সাইড রক্তের সঙ্গে মিশে অক্সিজেন পরিবহনের ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। বায়ুদূষণের ফলে শুধু স্বাস্থ্যের ক্ষতি নয়, পরিবেশ এবং সম্পদও নষ্ট হয়। সর্বোপরি মানুষের অকাল মৃত্যুর জন্য দায়ী বায়ুদূষণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে দেখা যায়, বিশ্বে প্রতি ১০ জনের মধ্যে প্রায় ৯ জনই বেশি মাত্রায় দূষিত বায়ু শ্বাস-প্রশ্বাসে ব্যবহার করে। প্রতিবেদন থেকে আরোও জানা যায়, বায়ু দূষণ এমন মারাত্মক যার জন্য ২৪ শতাংশ পূর্ণবয়স্ক মানুষের হার্টের অসুখ, ২৫ শতাংশ স্ট্রোক, ৪৩ শতাংশ পাল্মনারি রোগ এবং ২৯ শতাংশ ফুসফুসে ক্যান্সার হয়ে থাকে। এ বছর গ্রিণপিস থেকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বায়ুদূষণ জনিত রোগে প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ৮০০ মানুষের মৃত্যু হয়। বর্তমানে মৃত্যুর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বেড়েই চলছে। অন্য একটি গবেষণা থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালে বিভিন্ন দূষণের শিকার হয়ে সারা বিশ্বে ৯০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। ‘দ্য স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের যে পাঁচটি দেশের শতভাগ মানুষ দূষিত বায়ুর মধ্যে বসবাস করে, তন্মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বায়ুদূষণজনিত মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশে বিশ্বে পঞ্চম। একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে, বায়ুদূষণে প্রতিবছর বাংলাদেশে মারা যাচ্ছে ১ লাখ ২৩ হাজার আর ভারত ও চীনে মারা গেছে ১২ লাখ মানুষ। ২০১৭ সালের হিসাবে প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন বায়ু দূষণে মারা গেছে। সড়ক দুর্ঘটনা বা ধূমপানের কারণে মৃত্যুর হারের তুলনায় ২০১৭ সালে বায়ুদূষণে মানুষ মারা গেছে বেশি। যার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থা বেশি খারাপ। বায়ুদূষণের শিকার হয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় প্রতিটি শিশুর ৩০ মাস করে আয়ু কমে যাচ্ছে জানিয়েছে সংস্থাটি, কিন্তু উন্নত দেশগুলোয় এই হার গড়ে পাঁচ মাসের কম। একজন মানুষ বিশুদ্ধ পানি খাবার জন্য অর্থ ব্যয় করেন কিন্তু পরিশুদ্ধ বাতাসের জন্য অর্থ ব্যয় করেন না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অজ্ঞতার কারণে ঠান্ডা বাতাস পেয়ে থাকেন, কিন্তু পরিশুদ্ধ বাতাসের পরিবর্তে অধিকতর দূষিত বাতাস গ্রহণ করেন। ফলে বায়ুবাহিত রোগে ব্যাপক আক্রমণ করে। প্রায়ই হাসপাতাল বা প্রাইভেট ক্লিনিকে শোনা যায় অপারেশন সফল কিন্তু ইনফেকশনে রোগীর মৃত্যু হয়েছে। ইনফেকশনের অনেকগুলো কারণের মধ্যে অন্যতম দূষিত বায়ু। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ধূলাবালি, পোলেন, প্যাথোজেন সর্দি-কাশির মাধ্যমে রোগজীবাণু বাতাসে প্রায় ১৬০ ফুট পর্যন্ত ছড়ায়। হাসপাতাল বা প্রাইভেট ক্লিনিককে বায়ুদূষণমুক্ত করার ব্যবস্থা নেই। নেই জীবাণু ধ্বংস, বাতাসের চাপ ও বেগ, ভেন্টিলেশন, বাতাস পরিবর্তন ও মুক্ত বাতাসের ব্যবস্থা। যার অভ্যন্তরে বায়ুদূষণ সব চেয়ে বেশি।
পরিবেশের উপর নেমে আসা বিপর্যয় নিয়ে বিশ্বের মত বাংলাদেশও উদ্বিগ্ন। বায়ুদূষণ প্রতিরোধ ও প্রতিকারে, সর্বসাধারণের ব্যাপক ভূমিকা পালনে সবাই যদি সচেতন না হই তাহলে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটবে, তাই ব্যক্তি ভূমিকা ও সচেতনতা একান্ত প্রয়োজন। উদাহরণ হিসেবে- ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলে পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা। পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ ব্যবহারে সাশ্রয়ী হওয়া ও অপচয় রোধ করা। বিলাসিতা বর্জনের চেষ্টা। পলিথিন, প্লাস্টিক জাতীয় দ্রব্য যা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে সেগুলোর ব্যবহার রোধ করা। নবায়নযোগ্য জ্বালানী শক্তির ব্যবহার করতে হবে। কাঠ, কয়লা, তেল যথা সম্ভব পরিমাণ মতো ব্যবহার করা। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন বন্ধ করে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়ন প্রতিষ্ঠা। পরিবেশসম্মত অবকাঠামো নির্মাণ ও তার সুষ্ঠু ব্যবহার। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিবেশ শিক্ষার যেমন প্রয়োজন, ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়ে তেমনি দরকার রয়েছে। শিক্ষা তখনই সার্থক হবে, যখন পরিবেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও ব্যবহারে আমরা নিশ্চিত হব। এজন্য সরকারের পাশাপাশি প্রত্যেক মানুষের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের নিজেদেরকে রক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপদ এবং সুন্দর স্বদেশভূমি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বায়ুকে দূষণমুক্ত করে নিজেকে অনেকদিন বাঁচিয়ে রাখি।