টানা ১১ দিনের পর গাজা এখন শান্ত, বাড়ি ফিরছেন ফিলিস্তিনীরা, স্বস্তিতে বিশ্ববাসী

30

কাজিরবাজার ডেস্ক :
টানা ১১ দিনের ইসরাইলী আগ্রাসনের পর অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা এখন অনেকটাই শান্ত। হামলায় ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়া গাজাবাসী বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। বৃহস্পতিবার রাতে গাজার নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী হামাস ও ইসরাইল যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। শুক্রবার ভোর থেকে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর কয়েক মিনিটের মধ্যে অনেকে গাজার রাজপথে গাড়ির হর্ন বাজিয়ে এবং আকাশের দিকে গুলি ছুড়ে উৎসব পালন করেন। অধিকৃত পশ্চিম তীরের রাজপথে অবস্থান নিয়ে সাধারণ জনগণ আনন্দ-উৎসব পালন করে।
শুক্রবারের এ আনন্দকে অনেকে ঈদের দিনের আনন্দের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অনেকে ‘আল্লাহু আকবর’, ‘আল্লাহর প্রতি শুকরিয়া’ ইত্যাদি শ্লোগান দেয়। এই সংঘাতে ইসরাইল এবং হামাস উভয়ে বিজয় দাবি করেছে। গাজায় যুদ্ধবিরতির খবরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে বিশ্ববাসী। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ অন্যান্য নেতা ইসরাইল-হামাস যুদ্ধবিরতির ঘটনাকে স্বাগত জানিয়েছেন।
১০ মে ছড়িয়ে পড়া এ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির পর মিসরের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি চুক্তি হয়। এ চুক্তি পালনে গাজার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ শক্তিশালী সশস্ত্র গ্রুপ ইসলামিক জিহাদও সম্মত হয়েছে। এ চুক্তির মধ্যস্থতায় মিসরের ভূমিকার প্রশংসা করে হোয়াইট হাউসে জো বাইডেন বলেন, আমি বিশ্বাস করি এক্ষেত্রে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রকৃত সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং আমি এ ব্যাপারে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, দেশটির নিরাপত্তা পরিষদ কোন পূর্ব শর্ত ছাড়া পারস্পরিক অস্ত্রবিরতি পালনের জন্য মিসরের উদ্যোগ মেনে নিতে সকল নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের সুপারিশ সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করে। হামাস ও ইসলামিক জিহাদও পৃথক বিবৃতিতে যুদ্ধবিরতি চুক্তির খবর নিশ্চিত করে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ্যান্টনিও ব্লিনকেন আগামী ‘কয়েকদিনের মধ্যে’ মধ্যপ্রাচ্য সফর করবেন। মার্কিন পররাষ্ট্র বিভাগের মুখপাত্র নিড প্রাইস বলেন, ব্লিনকেন ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী গবি আশকানাজির সঙ্গে কথা বলেছেন। আশকানাজি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ অঞ্চল সফরের পরিকল্পনাকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ্যান্টনিও ব্লিনকেন মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। এ সময় তিনি সংঘাত নিরসন ও ইসরাইল-ফিলিস্তিনের জন্য উন্নত ভবিষ্যত গড়ে তোলার ব্যাপারে একসঙ্গে কাজ করার বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন।
বৃহস্পতিবার মন্ত্রিসভার জরুরী বৈঠকের পর ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন। গাজায় বিবিসির সংবাদদাতা রুশদি আবুয়ালউফ এক টুইট বার্তায় বলেন, এ যুদ্ধ বন্ধে নিজেদের অবস্থান মিসরকে জানিয়েছে ইসরাইল। গাজায় ইসরাইলী হামলা বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছিল। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বুধবারও ফোনে এ বিষয়ে ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে কথা বলেন। একই দিন রাশিয়ায় নিযুক্ত ইসরাইলী দূতকে ডেকে সতর্ক করে ভøাদিমির পুতিন প্রশাসন। বৃহস্পতিবার একাদশ দিনের মতো গাজায় হামলা চালায় ইসরাইল। এতে অন্তত একজন নিহত হয়। মোট নিহত ২৩২ জন। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, নিহতদের মধ্যে অন্তত ৬৫ শিশু ও ৩৯ নারী রয়েছে। অপরদিকে হামাসের রকেট হামলায় ১৩ ইসরাইলী নিহত হয়।
মিসরের প্রেসিডেন্ট আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি প্রথমে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। উভয় নেতা গাজায় চলমান সহিংসতা নিরসনের উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি জেন সাকি বলেন, জো বাইডেন ও আব্দেল ফাত্তাহ আল সিসি যুদ্ধ বন্ধের গুরুত্ব নিয়ে দীর্ঘসময় আলোচনা করেন। এর পরই ইসরাইলী নেতারা বৈঠকে বসেন। গাজার পরিস্থিতি নিয়ে চরম উদ্বেগ প্রকাশ করে নিজেদের নেয়া পদক্ষেপের প্রতি হুঁশিয়ার থাকতে ইসরাইলকে তাগিদ দেয় মস্কো। রাশিয়ার ডেপুটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিখাইল বোগদানোভ বলেন, রাশিয়া গাজার পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখছে। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেন, নিজেদের বক্তব্যের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষকে সতর্ক থাকতে হবে। যাতে নতুন করে সহিংসতা আর কোনভাবেই বৃদ্ধি না পায়। তিনি জানান, ইসরাইল ও হামাসের মধ্যে সরাসরি আলোচনার আয়োজন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে রাশিয়া। এর আগে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর প্রসঙ্গে হামাসের সশস্ত্র বাহিনীটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মুসা আবু মারজুক বলেন, আমরা ধারণা করছি যুদ্ধবিরতি নিয়ে এখন যে চেষ্টা চলছে, তা সফলতা অর্জন করবে। এক/ দুইদিনের ভেতরেই আমরা যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাতে পারব। পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে এ যুদ্ধবিরতি হবে। গাজা ভূখণ্ডে হামলা ও অবৈধ বসতি স্থাপনসহ ফিলিস্তিনীদের সঙ্গে ইসরাইলের আচরণের সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী যুগের মিল রয়েছে বলে মন্তব্য করেন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা। ‘ফ্রান্স ২৪’ টেলিভিশন চ্যানেলের সঙ্গে এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, ফিলিস্তিনীরা আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিজেদের হাতে রাখতে চায়। নিজেদের জন্য তারা একটি রাষ্ট্র চায়। স্বাধীনতাসহ নিজেদের সকল বিষয় নিজেরাই দেখভাল করতে চায়। নিজেদের চলাফেরা ও কর্মকাণ্ডের ওপর অন্যের নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব চায় না ফিলিস্তিনীরা। তিনি আরও বলেন, ইসরাইলীরা যেভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ ফিলিস্তিনীদের মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আসছে, যেভাবে দেশটি অবরুদ্ধ এই ভূখণ্ডটিতে একের পর এক বোমা বর্ষণ করছে; তাতে যে কেউ সহজেই ইসরাইলকে বিদ্বেষবাদী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে। গাজার আবাসিক এলাকায় দখলদার ইসরাইলের বিমান হামলায় এ পর্যন্ত ৫২ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে বলে জাতিসংঘের এক হিসাবে উঠে এসেছে। জাতিসংঘ জানায়, ইসরাইলী বিমান হামলায় এ পর্যন্ত ৫২ হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। গাজা উপত্যকায় ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সেখানে প্রায় সাড়ে চার শ’ ভবন বিধ্বস্ত হয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ইসরাইল যেভাবে ফিলিস্তিনের আবাসিক এলাকায় বিমান হামলা চালিয়েছে, তা যুদ্ধাপরাধের শামিল। যদিও ইসরাইল তা অস্বীকার করে। দেশটির সামরিক বাহিনী বলেছে, তারা সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে, যাতে বেসামরিক নাগরিকদের হতাহত হওয়ার ঘটনা এড়িয়ে যাওয়া যায়। জাতিসংঘের অফিস ফর দ্য কোঅর্ডিনেশন অব হিউম্যানিট্যারিয়ান এ্যাফেয়ার্সের (ওসিএইচএ) মুখপাত্র ইয়েন্স লেয়ার্কে বলেন, গাজায় জাতিসংঘের পরিচালিত স্কুল রয়েছে ৫৮টি। এতে আশ্রয় নিয়েছেন প্রায় ৪৭ হাজার ফিলিস্তিনী।