কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের ওষুধ কোম্পানিগুলোর প্রতি মাসে ৫ কোটি ডোজ টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। আগামী দুই-তিন মাসের মধ্যেই টিকা উৎপাদন করা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে টিকা উৎপাদনের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই আমরা দেশেই টিকা উৎপাদন করতে পারব বলে আশা করি। আপৎকালীন পরিস্থিতি মোকাবেলায় টিকা কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও চীন ও রাশিয়ার টিকা দেশী কোম্পানির মাধ্যমে উৎপাদনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দ্রুত সরকারের উচ্চ মহল থেকে আসবে বলে নির্ভরশীল সূত্র জানিয়েছে। যদিও ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকাও বাংলাদেশে উৎপাদনের প্রস্তাবও এসেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দেশের ৪টি ওষুধ কোম্পানি টিকা উৎপাদন করতে সক্ষম। কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যাল, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যাল, হেলথ কেয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল, ওরিয়ন ফার্মাসিউটিক্যাল। চারটি কোম্পানি বর্তমানে বিভিন্ন রোগের টিকা উৎপাদন করছে। কোম্পানিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সক্ষমতা রয়েছে ইনসেপ্টা ফার্মার। এরা বছরে ৫০ কোটি টিকা উৎপাদন করতে পারে বলে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে দেয়া তাদের প্রস্তাবে এই সংখ্যা উল্লেখ রয়েছে। বাকি কোম্পানিগুলো আরও ১০ কোটি টিকা উৎপাদন করতে পারবে বলে জানা গেছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক ইনসেপ্টা ফার্মার টিকা প্ল্যান্ট পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি আশা প্রকাশ করেন, দেশের সব কোম্পানি মিলে বছরে প্রায় একশ’ কোটি টিকা উৎপাদন করতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছেন, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে টিকা উৎপাদন সম্ভব। একইসঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রবার্ট আর্ল মিলার বলেছেন, বাংলাদেশী ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানিগুলোর ভ্যাকসিন উৎপাদনের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখছে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। একইসঙ্গে টিকাকরণ কর্মসূচী এগিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেয়া হয়।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, চীন ও রাশিয়ার কাছ থেকে টিকা কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও পাশাপাশি দেশ দুটি বাংলাদেশেই উৎপাদনের প্রস্তাব দেয়। এই টিকা উৎপাদনের জন্য কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবও চাওয়া হয়। মোট চারটি কোম্পানি প্রস্তাব দেয়। কোম্পানিগুলো হলো- ইনসেপ্টা, পপুলার ফার্মা, হেলথ কেয়ার ও ওরিয়ন ফার্মা। এর মধ্যে ইনসেপ্টার প্ল্যান্টে বর্তমানে ১৪টি টিকা উৎপাদিত হয়ে থাকে। এই টিকা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি করা হয়। ইনসেপ্টার পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মোট ৫০ কোটি ডোজ টিকা ইনসেপ্টা বছরে উৎপাদন করতে সক্ষম। আর দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা পপুলার ফার্মাসিউটিক্যাল তিন ধরনের টিকা উৎপাদন করে থাকে। কোম্পানিটির বছরে ২ কোটি ৪০ লাখ টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। এছাড়া ওরিয়ন ফার্মা ও হেলথ কেয়ারের টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। অর্থাৎ সবমিলে এখনই বছরে প্রায় ৬০ কোটি টিকা দেশে উৎপাদন সম্ভব। দেশে উৎপাদন হলে অনিশ্চয়তা দূর হওয়ার পাশাপাশি কম মূল্যে টিকা পাওয়া যাবে। এ কারণে সরকার টিকার উৎপাদন ঘিরেই মূল পরিকল্পনা করছে।
গত ১৮ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক আশুলিয়ার জিরাবো এলাকায় ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন লিমিটেডের ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট পরিদর্শন করেন। সেদিন তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি ইনসেপ্টা ভ্যাকসিন প্ল্যান্ট ইতোমধ্যে ইনফ্রাস্ট্রাকচার এ্যান্ড গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি) মান অনুযায়ী ভ্যাকসিন উৎপাদনে বিশ্বমানের সক্ষমতা অর্জন করেছে। সুতরাং আমি মনে করি, অন্য দেশগুলোও ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য এই প্ল্যান্ট ব্যবহার করতে পারে।
ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল মুকতাদির বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার শর্ত পূরণ করে টিকা উৎপাদনের জন্য তাদের আন্তর্জাতিক মানের ল্যাবরেটরি রয়েছে। বিষয়টি উল্লেখ করে টিকা উদ্ভাবক কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে চিঠিও দেয়া হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকেও বিষয়টি চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদিত কোন টিকার কাঁচামাল পেলে ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের প্রতিবছর ৫০০ মিলিয়ন ডোজ টিকা উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে টিকা উদ্ভাবক প্রতিষ্ঠানগুলো সক্ষমতা আছে এমন প্রতিষ্ঠানগুলোকে কাঁচামাল সরবরাহ করবে বলে আশা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে টিকা সঙ্কট দূর করতে এর বিকল্প নেই। তবে টিকা উৎপাদনের অনুমোদন পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসেনি।
পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালের পরিচালক ডাঃ এম এ মালেক চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে টিকা উৎপাদনের সুযোগ পেলে পপুলার ফার্মার প্ল্যান্টে প্রতি মাসে ২ মিলিয়ন ভাওয়েল টিকা উৎপাদন সক্ষম। সেই হিসেবে বছরে ২৪ মিলিয়ন ভাওয়েল উৎপাদন করতে পারবে কোম্পানিটি। তবে টিকার একক বা ডাবল ডোজের ওপর নির্ভর করে এই পরিমাণ কমবেশি হতে পারে। তিনি আরও জানান, বর্তমানে পপুলার ফার্মা রেবিস, হেপাটাইসিস বি ও টিটেনাসের টিকা উৎপাদন করছে। তিনি বলেন, টিকা উৎপাদন কিছুটা সময় সাপেক্ষ। কারণ অনুমোদন পাওয়ার পরও অন্তত মাস খানেক সময় লাগবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োমেডিক্যাল রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক আ ব ম ফারুক বলেন, রাশিয়া টিকার প্রযুক্তি ও কাঁচামাল সরবরাহ করতে সম্মত হয়েছে। সুতরাং প্রযুক্তি ও কাঁচামাল পেলে টিকা উৎপাদন করে দেশের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি করা যাবে। রাশিয়ার টিকাটির কার্যকারিতা ৯৭.৫ শতাংশ। অন্যান্য অধিকাংশ টিকার তুলনায় রাশিয়ার টিকা এগিয়ে। এই টিকাটি বাংলাদেশ পেলে সেটি হবে সবচেয়ে ভাল বিকল্প।
মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে টিকা উৎপাদনের দেশ দুটির প্রস্তাব খতিয়ে দেখছে সরকার। রাশিয়া গোপন রাখার শর্তে টিকা উৎপাদনের প্রযুক্তি হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশকে টিকা উৎপাদনের প্রযুক্তিটি গোপন রাখতে হবে। বাংলাদেশ সেই শর্ত মেনে নিয়েছে। এখন পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়ার প্রতিনিধিদল সম্ভাব্য টিকা উৎপাদন প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করবে। চীনও প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে বাংলাদেশকে টিকা উৎপাদনের প্রস্তাব দিয়েছে। এমনকি ভারতও সেদেশের ভারত-বায়োটেক উদ্ভাবিত টিকা কো-ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য (ট্রায়াল) বাংলাদেশকে প্রস্তাব দিয়েছে। ভারত থেকে টিকা না পেয়ে বাংলাদেশ বিকল্প হিসেবে রাশিয়া ও চীনের টিকা পেতে আগ্রহী হয়। এর অংশ হিসেবে এপ্রিলের শেষে রাশিয়ার স্পুটনিক-ভি এবং মে মাসের শুরুতে চীনের সিনোফার্মের টিকা জরুরী ব্যবহারের অনুমোদন দেয় ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। এছাড়া দেশ দুটির টিকা বাংলাদেশে উৎপাদনেরও অনুমোদন দেয়া হয়। এরপরই দেশে ভ্যাকসিন তৈরিতে সক্ষম কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রস্তাব চাওয়া হয়। এখনও সেই প্রস্তাবগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের হাতে ৬ কোটি ডোজ অক্সফোর্ডের টিকা রয়েছে, যা তারা ব্যবহার করছে না। সেখান থেকে একটি অংশ এরই মধ্যে বাংলাদেশ চেয়েছে। পাশাপাশি টিকার আন্তর্জাতিক জোট কোভ্যাক্স থেকেও টিকা পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে বাংলাদেশ। মার্কিন রাষ্ট্রদূত আশ্বস্ত করেছেন, আগামী দুই-একদিনের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়াতে টিকা সরবরাহের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বাংলাদেশ এখনও এই টিকা পাওয়ার আশা ছাড়েনি।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকার মোট সাড়ে ১৩ কোটির মতো মানুষকে টিকা দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। এর মধ্যে কোভ্যাক্স থেকে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ বা ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা বিনামূল্যে পাওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু কোভ্যাক্স থেকে এখনও টিকা পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া অক্সফোর্ড ও এ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকার তিন কোটি ডোজ কেনার চুক্তি হয়েছে। এর মধ্যে চুক্তির ৭০ লাখ ডোজ পাওয়া গেছে। আর ভারত সরকার ৩২ লাখ ডোজ টিকা উপহার হিসেবে বাংলাদেশে পাঠায়। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত এক কোটি দুই লাখ ডোজ করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক টিকা কোভিশিল্ড হাতে পেয়েছে বাংলাদেশ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, কূটনৈতিক সম্পর্ক অটুট রাখতে আগামী জুলাই মাস থেকে টিকা রফতানির ওপর ভারতের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হতে পারে। তখন বাংলাদেশ সেরাম ও কোভ্যাক্স- দুটি উৎস থেকেই টিকা পাবে। চলতি বছরের মধ্যে কোভ্যাক্স থেকে ছয় কোটি ৮০ লাখ ও সেরাম থেকে আসা তিন কোটি এবং ভারত সরকারের কাছ থেকে উপহারের ৩২ লাখ মিলে মোট টিকা হবে ১০ কোটি ১৩ লাখ ডোজ। এই টিকা দিয়ে ৫ কোটি সাড়ে ৬ লাখ মানুষের টিকা দেয়া যাবে। তাছাড়া কোভ্যাক্স প্রস্তাব দিয়েছে, যত টিকা লাগবে তারা সরবরাহ করবে। কারণ কোভ্যাক্সের টিকার প্রতি ডোজের দাম পড়বে ৭ ডলার করে। আর সেরাম থেকে টিকার প্রতি ডোজের দাম পড়েছে ৫ ডলার করে। পাশাপাশি চীন ও রাশিয়ার টিকার দাম দ্বিগুণের বেশি।