কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা রোগীদের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে জরুরী ভিত্তিতে ৪০টি অক্সিজেন জেনারেটর কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে অক্সিজেনারেটর দ্রুত দেশে নিয়ে আসতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কেনার জন্য নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, করোনা থেকে মানুষের জীবন বাঁচাতে দ্রুত অক্সিজেন জেনারেটরগুলো কেনা হবে। সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে আগামী বাজেটেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি জানান, করোনাকালেও দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক ধারা বজায় থাকায় দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে।
বুধবার দুপুরে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে ভার্চুয়ালি অর্থনৈতিক বিষয়ক সংক্রান্ত ও সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এর আগে ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে ৪০টি অক্সিজেন জেনারেটরসহ ৮ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯ ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হয়। সভায় কমিটির সদস্য, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সিনিয়র সচিব, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব ও উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সভা শেষে অনুমোদিত ক্রয় প্রস্তাবগুলোর বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন অর্থমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. শাহিদা আক্তার।
উল্লেখ্য, মহামারী করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের আঘাতে দেশে কোভিড আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুহার বেড়েছে। ঈদের আগে দৈনিক মৃত্যুহার ১০০ ছাড়িয়ে যায়। ওই সময় হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে মরনাপন্ন রোগীদের চিকিৎসায় আইসিউও এবং সিসিইউ সিট সঙ্কট তৈরি হয়েছিল। জরুরী অক্সিজেন সিলিন্ডারের ঘাটতি দেখা দেয় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। এখন আবার কিছুটা কমতে শুরু করলেও বুধবার আবার মৃত্যু ও সংক্রমণের হার বেড়েছে। এছাড়া প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা অনেকটা ভেঙ্গে পড়েছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, দ্রুত দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়তে পারে। এ অবস্থায় জরুরী ভিত্তিতে অক্সিজেন জেনারেটর কেনা ও সংগ্রহের পরামর্শ রয়েছে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের। এ কারণে করোনা চিকিৎসার জন্য অক্সিজেন জেনারেটর কেনা হচ্ছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, স্বাস্থ্যখাত অত্যন্ত জরুরী বিষয়, তাদের দায়িত্ব ছিল এসব চাহিদার বিষয়ে যথাযথ সময় ব্যবস্থা নেয়া, কিন্তু তখন সেটি করা হয়নি। করোনা পৃথিবীতে সবার জন্যই প্রথম, তাই সবাই যেসব কাজ সম্পর্কে অবগত থাকবে তাও না। এখন যেগুলো আসছে সেগুলো সবই নতুন। তিনি বলেন, কোভিড সারাবিশ্বে তা-বলীলা চালাচ্ছে। এর মাঝে কাজের পরিধি বাড়ছে। আমাদের এখন এগুলো চিন্তা না করে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে হবে। এই বিবেচনায় আমরা এটি অনুমোদন দিয়েছি। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. শাহিদা আক্তার সাংবাদিকদের জানান, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীন সিএমএসডি কর্তৃক কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগীর ব্যবহারের জন্য ৪০টি অক্সিজেন জেনারেটর সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে (ডিপিএম) ক্রয়ের নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের করোনা পরিস্থিতির ভয়াবহ অভিজ্ঞতায় অক্সিজেন সঙ্কট এবং অক্সিজেনের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের বিষয়টি প্রাধান্য পাচ্ছে। দেশটিতে শুধু অক্সিজেনের অভাবে প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। ভারত সরকারও অক্সিজেনের জোগান দিতে পারছে না। ভারতের এই পরিস্থিতিও বিবেচনায় রাখছে সরকার। এজন্য দেশের করোনাভাইরাসের পরিস্থিতি বিবেচনায় ৪০টি অক্সিজেন জেনারেটর কিনা হচ্ছে। সময় স্বল্পতার কারণে জরুরী ভিত্তিতে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে এসব জেনারেটর কেনা হবে।
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে ॥ সরকারের রাজস্ব আয় বাড়াতে আগামী বাজেটেও কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, পদ্ধতিগত কারণে দেশে অপ্রদর্শিত অর্থ তৈরি হয়। এ কারণে যতদিন অপ্রদর্শিত আয় থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এই সুযোগ বহাল রাখা হবে। পুঁজিবাজার, ব্যাংক আমানতে, নগদ টাকা, ফ্ল্যাট কেনাসহ সবক্ষেত্রে বিনা প্রশ্নে ১০ শতাংশ কর দিয়ে সর্বশেষ বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১২ হাজার কোটি টাকা সাদা হয়েছে। করোনার ধাক্কার মধ্যেও ঢাকায় প্রায় সব রেডি ফ্ল্যাট বিক্রি হয়ে গেছে। নতুন অর্থবছরে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ থাকছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, অপ্রদর্শিত টাকা কিভাবে হয় ? এবারও সেটি বহাল রাখা হবে। যতদিন পর্যন্ত অপ্রদর্শিত টাকা প্রদর্শিত না হবে ততদিন আমরা এটি কন্টিনিউ করব। আমাদের পদ্ধতিগত কারণে অনেক সময় অপ্রদর্শিত টাকা সিস্টেমে চলে আসে।
অর্থমন্ত্রী বলেন, অপ্রদর্শিত টাকা কি কি কারণে হয়? জমি রেজিস্ট্রেশন ফি আমরা অনেক রেখে দিয়েছি। মার্কেট প্রাইজে লেনদেন হলে অপ্রদর্শিত টাকা থাকত না। আমাদের সিস্টেমের কারণেই এখন ক্রেতা এবং বিক্রেতার কাছে তাদের অপ্রদর্শিত টাকা থাকে, সেজন্য তারা বিপদে পড়ে। আগে ইনকাম ট্যাক্স রেট বেশি ছিল, কেউ দিতো না। সেজন্য আমরা পর্যায়ক্রমে ইনকাম ট্যাক্স রেট কমিয়ে এনেছি। এটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের মতো যারা রয়েছেন তাদের সঙ্গে আমাদের মূল্যায়ন করলে যাতে একইরকম পাওয়া যায় সেজন্য ব্যবস্থাটি আমরা নিচ্ছি। আমরা আশা করি অপ্রদর্শিত টাকা আমাদের অর্থনৈতিক পদ্ধতি থেকে বিলীন হয়ে যাবে, থাকবে না।
সামষ্টিক অর্থনীতি ইতিবাচক হওয়ায় মাথাপিছু আয় বেড়েছে ॥ সামষ্টিক অর্থনীতি ইতিবাচক ধারক থাকার কারণে দেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। এছাড়া করোনার মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর একের পর এক সাহসী প্যাকেজ এবং সবগুলো ক্ষেত্রেই সঠিক উদ্যোগের কারণে মাথাপিছু আয় বেড়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থনীতির কোন দিকটা ভাল হওয়ার কারণে মাথাপিছু আয়টা বেড়েছে জানতে চাইলে আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেন, প্রধানমন্ত্রী করোনার সময় যে সাহসী প্যাকেজগুলো নিয়েছেন একের পর এক এবং সবগুলো ক্ষেত্রেই তিনি স্পর্শ করেছেন। সে কারণেই আমাদের সামষ্টিক অর্থনীতির প্রত্যেকটায়ই এখন উন্নতির দিকে, নেগেটিভ কিছু নাই। আমাদের মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৪৭ যা আগের মতোই আছে। দুর্যোগের মধ্যেও এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের পণ্য রফতানি ৩২.১ বিলিয়ন ডলার, যেটার প্রবৃদ্ধি ৮.৭ শতাংশ। রেমিটেন্সের প্রবৃদ্ধি হলো ৪০ শতাংশ। ১১ মাসে রেমিটেন্স হয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভে গত জুনে ছিল ৩৬ বিলিয়ন ডলার, এখন এটি ৪৪.৬ বিলিয়ন ডলার। এ মাসেই এটি ৪৫ বিলিয়ন ডলার হয়ে যাবে। আমরা আশা করি, আগামী অর্থবছরে নিঃসন্দেহে এটা ৫০ বিলিয়ন ডলার টাচ করবে। তিনি জানান, নপারফর্মিং লোন অনেক কমে আসছে, এখন ৭.৬৬ আছে। গতবছরের জুনে ছিল ৯.১৬ শতাংশ। পুঁজিবাজারে গতবছরের জুনে ৩ লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন ছিল। এখন সেটা বেড়ে ৪ লাখ ৯৫ হাজার হয়েছে। আমাদের জাতীয় রাজস্ব নিয়ে সব সময় বিচলিত থাকি, সেই জাতীয় রাজস্ব এপ্রিল পর্যন্ত গ্রোউথ ১১.৮ শতাংশ।
অর্থমন্ত্রী বলেন, আপনাদের প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে শিকার করতে হবে আমরা আগের চেয়ে অনেক ভাল করছি। ভাল করার পেছনে যুক্তি হলো প্রধানমন্ত্রী সময় উপযোগী, সময়মতো এবং প্রণোদনা দিয়েছেন যা প্রত্যেক মানুষের কাছে পৌঁছেছে। যারা চাকরি হারিয়েছেন, যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, অটিস্টিক সবাইকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়েছে। সে কারণেই টাকার সাপ্লাই এখন বেশি। বিশেষ করে আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি এখন অনেক ভাল। আমাদের ইমপোর্ট আগের চেয়ে অনেক ভাল হচ্ছে। এসএমই খাতের বরাদ্দের টাকা দেয়া যায়নি, এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা সিস্টেমে নিয়ে দিচ্ছি এটা। কোন মিডল ম্যানকে ইউজ করছি না। মিডল ম্যান ইউজ করলে যাদেরকে টাকা দিচ্ছি তারা পেত না। সেজন্য যাদের এ্যাকাউন্ট নাম্বার নেই তাদের যার যে মাধ্যম আছে সেটি দেখেশুনে দেয়া হচ্ছে। ১০ টাকা দিয় এ্যাকউন্টের বিষয়টি আনা হয়েছিল যাতে তারা ব্যাংকমুখী হয়। সেটি করে আমরা তাদের ব্যাংকে অভ্যস্ত করার চেষ্টা করেছি। আমরা যে সাহায্য ব্যাংকে দেবো বলেই তাদের ব্যাংকমুখী করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমাদের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ২২৭ ডলারে উন্নীত হয়েছে। আগের যে পরিসংখ্যান ছিল সেখানে (মাথাপিছু আয়) ছিল ২ হাজার ৬৪ ডলার। মাথাপিছু আয় ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
৯ ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদন ॥ সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রী সভা কমিটির ১৮তম সভায় ৮ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৯ ক্রয় প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবগুলোর মধ্যে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের ২টি, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ২টি, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের ২টি, বিদ্যুত বিভাগের ১টি, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের ১টি, জননিরাপত্তা বিভাগের ১টি এবং বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের ১টি প্রস্তাবনা ছিল। কমিটির অনুমোদিত ৯টি প্রস্তাবে মোট অর্থেও পরিমাণ ৮,৭৮৪ কোটি ২৮ লাখ ৪৩ হাজার ৯৩ টাকা। মোট অর্থায়নের মধ্যে জিওবি হতে ব্যয় হবে ২,৫১৮ কোটি ২৮ লাখ ৭৯ হাজার ৪৯০ টাকা এবং দেশীয় ব্যাংক ও বিশ্বব্যাংক ঋণ ৬,২৬৫ কোটি ৯৯ লাখ ৬৩ হাজার ৬০৩ টাকা।