কাজিরবাজার ডেস্ক :
মাহে রমজানের আজ ৮ম দিবস। এ মাসে মনকাড়া নানা আয়োজন উপভোগে রাতদিন মুমিন মন থাকে মশগুল। আপনি রমজানের মৌসুমে জনপদের যে প্রান্তেই অবস্থান করুন, ভোর রাতে নানা ধরনের গজলের সুর কানে আসবেই। মুসলিম শিশু কিশোর স্বেচ্ছাসেবী দল, মসজিদ কমিটি কিংবা মুয়াজ্জিন নানা কোরাস তুলে ঘণ্টাধ্বনি কিংবা সাইরেন দিয়ে সেহরি গ্রহণের জন্য রোজাদারদের নিদ্রাভঙ্গের প্রয়াস চালায়। যেমন কোথাও কোথাও কিশোররা। মসজিদের মাইক থেকে ভোর রাতে গেয়ে ওঠে :
রমজানেরই রাতের শেষে/ঘুমিয়ে কেন তুমি এখন
সেহরির যে সময় হলো/ উঠো উঠো মুমিনগণ।’
সেহরি অর্থ কোন কিছু পানাহার পূর্বক প্রত্যুষে সুবহে সাদিকের আগে রোজার শুভ সূচনা করা (আমাদের অনেকে সেহরিকে ‘সেহেরি’ বলে, এটা শুদ্ধ নয়। তবুও এটা প্রচলন হয়ে আছে)। উল্লেখ্য, সেহরি/সেহেরি ভোর রাতে নিছক একটি খানাপিনার আয়োজন নয়। এটি ইসলাম ধর্মে ইবাদতের মধ্যে শামিল। এ এক পবিত্র মুহূর্ত। আল-কুরআনে এ সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে : তোমরা পানাহার করো, যে পর্যন্ত তোমাদের জন্য সাদা সুতা কালো সুতা হতে সুস্পষ্ট না হয়। রাসূলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন : তোমরা সেহরি খাও। কেননা এতে বড় বরকত নিহীত। -বুখারী
বিখ্যাত সাহাবী হযরত যায়িদ ইবনে সাবিত (রাদি.) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমরা প্রিয় নবী হুজুরে কারীম (স.)-এর সঙ্গে সেহরি খেয়েছি। পরে তিনি ফজরের নামাজ পড়েছেন। সাহাবী যায়েদ (রাদি.) স্মৃতি রোমাঞ্চনের সময় একজন জানতে চাইলেন তখন আজান ও সেহরির মধ্যে কতটুকু ব্যবধান ছিল? উত্তরে তিনি জানালেন ৫০ আয়াত তিলাওয়াত করতে যে সময় লাগে সে সময় পরিমাণ। রাসূলে আকরাম (স.) অন্যত্র বলেছেন : নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর ফেরেস্তারা সেহরি গ্রহণকারীর ওপর রহমত ও দোয়া প্রেরণ করেন। -(ফাজায়েলে তাবরানী)।
সুতরাং আমরা যেন সেহরি অনুষ্ঠানকে রমজানের পালনীয় একটি অন্যতম সুন্দর অনুষঙ্গ হিসেবে গ্রহণ করি। কোন ধর্মীয় ব্যাপারে অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি কিংবা কৃত্রিমতার আশ্রয় নেয়া উচিত নয়। আল্লাহপাক বান্দাকে শুধু উপোস রেখে পরীক্ষা করতে চান তা নয়, পবিত্র ও হালাল পন্থায় পানাহারের যে তাগিদ রয়েছে সেহরির প্রতি ইসলামের উৎসাহ প্রদান সে ইঙ্গিত বহন করে। মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স.) তো স্পষ্টত বলে ফেলেছেন : আমাদের রোজা ও আহলে কিতাবদের রোজার পার্থক্য হচ্ছে সেহরি খাওয়া নিয়ে। (ইমাম মুসলিম হাদীসটি আমর ইবনুল আসের (রাদি.) উদ্ধৃতি দিয়ে বর্ণনা করেছেন)।
রোজার সূচনায় যেমন রয়েছে সেহরি গ্রহণের বিষয়, তেমনি রোজার সমাপ্তিতে রয়েছে ইফতার গ্রহণের বিষয়। ইফতার অর্থ সূর্য ডোবার পর কোন পানাহার দিয়ে রোজা ভঙ্গ করা। রোজা রাখা যেমন সাওয়াবের কাজ, সেহরি গ্রহণ যেমন বরকতের কাজ, তেমনি যথাসময়ে ইফতার গ্রহণও ইসলাম ধর্মের রোজার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও পুণ্যের কাজ। আমরা অনেক সময় ব্যস্ততা ও অবহেলার কারণে বিষয়টি বেমালুম ভুলে যাই। আর কেউ কেউ অজ্ঞতাবশত মনে করেন দেরি ইফতার করা বুঝি একটু বেশি সাওয়াবের কাজ। এমন ধারণা মোটেই ঠিক নয়। আমাদের দয়াল নবী হযরত মুহাম্মদ (স.) রোজার অনুশাসন প্রবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানব কল্যাণের বিষয়টিকেও সমান গুরুত্ব দিয়েছেন। ‘তার ওপর লাখো দরূদ ও সালাম, তিনি যথার্থই বলেছেন : আমার উম্মতগণ ততদিন পর্যন্ত বরকতময় ও প্রাচুর্যময় জীবন অতিবাহিত করবে যতদিন তারা যথাসময়ে মুখে ইফতার নেবে।’ তাই আমাদের উচিত দিনভর সিয়াম সাধনা করার পর সূর্য অস্ত গেলে কাল বিলম্ব না করে ইফতার গ্রহণ করি।
উল্লেখ্য, ইফতারির আইটেমের মধ্যে বর্তমানে আমাদের দেশে টক ঝাল মিষ্টিজাত নানা দ্রব্যের প্রতি সাধারণ মানুষের প্রবল ঝোঁক দেখা যায়। এসব যদি হালাল পথে উপার্জিত এবং স্বাস্থ্য সম্মত হয় তবে নাজায়েযের কিছু নেই। সচারাচর বিভিন্ন দেশে আল্লাহর বান্দারা বিচিত্র রকমের পানাহারে অভ্যস্ত। এসব পানাহার ও খাদ্যদ্রব্য ব্যবহার করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করাই বড় কথা। তবে খোরমা দিয়ে ইফতার করা সবচেয়ে উত্তম। এছাড়া মিষ্টিজাত দ্রব্য অথবা পানীয় দ্বারা ইফতার করা ভাল। সাহাবী আনাস (রাদি.) বলেন : আল্লাহর রাসূল (সা.) (মাগরিবের) নামাজের পূর্বে ইফতার করতেন কয়েকটি তাজা খেজুর দিয়ে। যদি তিনি তাজা খেজুর না পেতেন। শুকনো খেজুর (অর্থাৎ খোরমা) দিয়ে, আর যদি তাও না পেতেন তাহলে কয়েক ঢোক পানি পান করে নিতেন। – (রিয়াদুস সালেহীন)। আমরা ইফতার গ্রহণের সূচনাতে সামান্য খোরমা / মিষ্টিজাত কিংবা পানি মুখে দিয়ে সুন্নাতের সাওয়াব পেতে পারি। এর পরই অন্যান্য আহার্য গ্রহণ করা যায়।