কাজিরবাজার ডেস্ক :
মহামারী করোনার কবল থেকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি মানের শিল্প খাত (এসএমই) রক্ষায় ছয় প্যাকেজে ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দেয়া হচ্ছে। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে স্বাভাবিক কাজকর্মে আসতে পারছে না এই খাতের ৮০ লাখ শিল্প প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রয়েছে কুটির শিল্প। লকডাউনে বন্ধ রয়েছে ২০ লাখ দোকান। এসব প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। অন্যথায় দেশের এসএমই খাত চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কোভিড-১৯ এর অর্থনৈতিক প্রভাব মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে ১ লাখ ২৪ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন। এর মধ্যে শুধু এসএমই খাত উন্নয়নে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ রয়েছে। প্যাকেজে ক্ষতিগ্রস্ত কুটির শিল্পসহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য স্বল্প সুদের ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধা প্রদান বাবদ ২০ হাজার কোটি টাকা, নিম্ন আয়ের পেশাজীবী, কৃষক ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিমে ৩ হাজার কোটি টাকা, গ্রামের দরিদ্র কৃষক, বিদেশফেরত প্রবাসী শ্রমিক এবং প্রশিক্ষিত তরুণ ও বেকার যুবকদের গ্রামীণ এলাকায় ব্যবসা ও আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজে স্বল্পসুদে ঋণ বিতরণ ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা, রফতানিমুখী তৈরি পোশাক চামড়াজাতপণ্য ও পাদুকা শিল্পের কর্মহীন দুস্থ শ্রমিকদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রম ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, এসএমই খাতের জন্য ক্রেডিট গ্যারান্টি স্কিম ২ হাজার কোটি টাকা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পখাতের গতি সঞ্চারে ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়। এ খাতে আরও ৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে। অর্থাৎ এসএমই খাতে গতি সঞ্চারে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা দিবে সরকার।
জানা গেছে, কুটির ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প খাতের গতি সঞ্চারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকার নতুন দুটি প্রণোদনা প্যাকেজ কর্মসূচীর অনুমোদন দিয়েছেন। এই কর্মসূচীর আওতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও সামাজিক নিরাপত্তার আওতাও সম্প্রসারণ করা হবে। করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামাল দিতে ঘোষিত এ প্রণোদনা প্যাকেজের বাস্তবায়ন শুরু করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, নতুন অনুমোদিত প্রথম প্যাকেজটির আকার ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, যার আওতায় ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্প খাত ও নারী উদ্যোক্তাদের জন্য গৃহীত কার্যক্রম সম্প্রসারণের লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প (এসএমই) ফাউন্ডেশনকে ৩০০ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সংস্থাকে (বিসিক) ১০০ কোটি টাকা এবং জয়িতা ফাউন্ডেশনকে ৫০ কোটি টাকা দেয়া হবে। পাশাপাশি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করতে এনজিও ফাউন্ডেশনকে ৫০ কোটি টাকা, সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনকে ৩০০ কোটি টাকা, পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশনকে ৩০০ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র কৃষক উন্নয়ন ফাউন্ডেশনকে ১০০ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ডকে ৩০০ কোটি টাকা দেয়া হবে। এছাড়া অনুমোদিত দ্বিতীয় প্যাকেজের আওতায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের ১৫০টি উপজেলায় দরিদ্র সব বয়স্কদের এবং বিধবা ও স্বামী পরিত্যক্তা সব নারীকে ভাতার আওতায় আনা হবে। এছাড়া নতুন অনুমোদিত এ দুটিসহ মোট প্রণোদনা প্যাকেজের সংখ্যা হলো ২৩টি, যার মোট আর্থিক পরিমাণ ১ লাখ ২৪ হাজার ৫৩ কোটি টাকা (জিডিপির ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ)।
উল্লেখ্য, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ব্যবসা-বাণিজ্যে গতিশীলতা আনতে প্রণোদনা প্যাকেজের কর্মসূচীতে আরও বরাদ্দ বাড়ানো হবে। এ খাতের উন্নয়নে পর্যায়ক্রমে ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজের কর্মসূচী গ্রহণ করবে অর্থ মন্ত্রণালয়। এই প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় ৪ শতাংশ সুদে ঋণ সহায়তা দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান। এ প্রসঙ্গে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সিনিয়র সচিব মোঃ আসাদুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, এসএমই খাত উন্নয়নে আরও ১০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়া হবে। গত অক্টোবর মাসে এটা নিয়ে একটি নীতিমালা তৈরি করতে বলা হয়েছিল। ২০ হাজার কোটি টাকার যে প্রণোদনা দেয়া হয়েছিল সেটার ডিসবার্সমেন্টটা ভালো ছিল না। অনেক চাপ প্রয়োগ করেছি, ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটা অনীহাও ছিল। আর একটা পরিস্থিতি তারা ফেস করেছে সেটা হল তাদের কাছে (ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা) তথ্য ছিল না। এসএমই সেক্টরের গ্রাহকদের সঙ্গে তাদের পরিচিতিটা কম। তিনি আরও জানান, গত ছয় মাসে আমরা প্রচুর আলোচনা করেছি বাংলাদেশ ব্যাংক, এসএমই ফাউন্ডেশন, পিকেএসএফের সঙ্গে। বড় এমএফআই (ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা), ক্ষুদ্র এমএফআইগুলোর সঙ্গে আমরা বসেছি। অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটা টিম করে দিয়েছিলাম, আমাদের উদ্দেশ্য ছিল ডিসেম্বরের মধ্যে এটি (প্রণোদনা প্যাকেজ) কেবিনেটে পাঠাবো। ডিসেম্বরের মধ্যে অর্থ বিভাগ তাদের মতামত দিয়ে এটিকে অনুমোদন করে দেয়। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ১০ হাজার কোটি টাকা ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি দেবে, সেখানে সরকার সাবসিডি দেবে।
জানা গেছে, করোনার প্রভাব থেকে ক্ষতিগ্রস্ত কুটির, মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তাদের (সিএমএসএমই) সক্ষমতা বাড়াতে প্রথম দফায় ২০ হাজার কোটি টাকার ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলোর অদক্ষতায় সর্বশেষ হিসেবে গত বছরের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ঋণ বিতরণ হয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৩৪৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ বরাদ্দকৃত ঋণের অর্ধেকও বিতরণ করা সম্ভব হয়নি। এই সময়ে ঋণের জন্য আবেদন এসেছে ৪৬ হাজার ৫৪৩টি, বিপরীতে ঋণ বিতরণের জন্য ৪১ হাজার ৬৯টি প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে করে এসএমই খাতের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ সুবিধার বাইরে রয়েছে। প্রসঙ্গত দেশে সিএসএমই খাতে প্রায় ৮০ লাখ শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর বাইরে নন-ব্যাংকিং চ্যানেলে ছোট ছোট লাখ লাখ ব্যবসা-বাণিজ্যক প্রতিষ্ঠা রয়েছে। এ কারণে প্রণোদনার সুফল পেতে হলে এসএমই খাতে ঋণ প্রাপ্তির বিষয়টি আরও সহজ করার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন দেশের খ্যাতিমান অর্থনীতিবিদরা। ওই বৈঠকে অর্থনীতিবিদরা করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মোকাবেলায় এসএসই খাত উন্নয়নে প্যাকেজ বাস্তবায়নে তাগিদ দিয়েছেন। তাদের মতে, প্রণোদনা প্যাকেজের মেয়াদ ও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কারণ করোনাকাল দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। অর্থমন্ত্রীও ওই আলোচনায় নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণার আভাস দিয়েছেন। এর আগে করোনা মোকাবেলায় অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও প্রণোদনা প্যাকেজের যাবতীয় দিক নিয়ে অর্থবিভাগ সম্প্রতি তিনটি মতবিনিময় সভা আয়োজন করে। এ সভাগুলোতে অংশগ্রহণ করেন উর্ধতন সরকারী কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, ব্যাংক, উন্নয়ন সহযোগী দেশ ও সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন খাতের অংশীজন। সভাগুলোতে করোনা মোকাবেলা করে ক্ষুদ্র শিল্প খাত ও সামাজিক নিরাপত্তার আওতা সম্প্রসারণের জন্য নতুন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা ও তা দ্রুত বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়।