॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
রক্তদান একটি পরোপকারী অনুকম্পামূলক কাজ। রক্তের স্বল্পতাজনিত মুমূর্ষু রোগীর দেহে প্রয়োজনীয় রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়। রক্তের কোনরূপ বিকল্প না থাকায় একমাত্র রক্তদানের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করা হয়। ফলে বিশেষ মুহূর্তে রক্তদান জীবন রক্ষায় সহযোগিতা করে। বাংলাদেশে নিরাপদ রক্তদান ও পরিসঞ্চালন নিশ্চিতকরণে সুনির্দিষ্ট আইন রয়েছে। ইসলামে রক্তদান একটি বড় দান এবং পুণ্যের কাজ হিসেবে বিবেচিত। আর্তমানবতার সেবায় ব্যক্তির এ স্বতঃস্ফূর্ত এগিয়ে আসাকে ইসলামী শরীয়া অনুমোদন করেছে। এ ধরনের মানবিক কল্যাণমূলক কর্মোদ্যোগ ইসলামী শরীয়ার মানবিকতা ও নৈতিকতা দ্বারা পরিচালিত। আলোচ্য প্রবন্ধে উল্লেখিত বিষয়ের ইসলামী দৃষ্টিভক্তি ও মূল্যবোধ এবং শরীয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ইত্যাদি আলোচনা করা উদ্দেশ্যে। তাছাড়া এ প্রবন্ধে রক্তদানের সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শরীয় বিধি-বিদান আলোাচিত হয়েছে। প্রবন্ধটি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বর্ণনা ও বিশ্লেষণমূলক পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। আলোচনার ফলাফলে প্রতীয়মান হয়েছে যে, প্রচলিত আইনে রক্তদান বিধিসম্মত। ইসলামী আইনে এ বিধানের ক্ষেত্রে দুটি মত পাওয়া যায় এবং সার্বিক বিবেচনায় রক্তদানের বৈধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই নির্দিষ্ট নীতিমালা প্রতিপালন করতে হবে।
রক্তদান ও পরিসঞ্চালন একটি বহুল প্রচলিত চিকিৎসা প্রক্রিয়া। চিকিৎসার প্রয়োজনে রক্তদানের মাধ্যমে একজন মানুষের দেহের একই গ্রুপের রক্ত আরেকজনের দেহে সঞ্চালন করা হয়। রক্ত এমন বস্তু, যা শুধু শরীরের ভিতরেই উৎপন্ন হয়। রক্ত তৈরির বিকল্প কোন ব্যবস্থা কিংবা রক্তের কোন বিকল্প এখনও উদ্ভাবিত হয়নি। তাছাড়া মানুষকে একমাত্র মানুষই রক্তদান করতে পারে। চিকিৎসকরা রক্তের স্বল্পতাজনিত মুমূর্ষু রোগীর দেহে নিরাপদ বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য পরামর্শ প্রদান করেন। ফলে বিশেষ মুহূর্তে রোগীর জীবন রক্ষায় রক্তদান অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠে। ইসলামে যদিও সব ধরনের দানকেই মহৎ কর্ম বলে গণ্য করা হয়, তবুও রক্তদান একটি বড় দান এবং পূণ্যের কাজ হিসেবে বিবেচিত হয়। ইসলামী শরী‘আ ব্যক্তির এ স্বতঃস্ফূর্ত এগিয়ে আসাকে আর্তমানবতার সেবা হিসেবে গণ্য করেছে। বস্তুত এ ধরনের মানবিক কল্যাণমূলক কর্মোদ্যোগ ইসলামী শরী‘আর মানবিকতা ও নৈতিকতা দ্বারা প্রভাবিত ও উৎসাহিত হয়। আলোচ্য প্রবন্ধে উল্লেখিত বিষয়ে ইসলামী শরী‘আর দৃষ্টিভঙ্গি, মুল্যবোধ ও লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ইত্যাদি আলোচিত হবে। তাছাড়া দাতা-গ্রহীতার পারস্পরিক উপকারিতা, রক্তদানের উত্তম স্থান, ধর্মীয় ও নৈতিক উন্নতি ইত্যাদি প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন শরীয় বিধি-বিধান আলোচনার পরিধিভূক্ত হবে।
রক্তদান ও পরিসঞ্চালনঃ রক্তদান হল কোন প্রাপ্তবয়ষ্ক সুস্থ মানুষের স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়া। সাধারণত কোন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ ব্যক্তি রক্তের স্বল্পতাজনিত কোন অসুস্থ ব্যক্তিকে স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়ার প্রক্রিয়াকে রক্তদান বলে। ইংরেজিতে তাকে Blood Donation এবং আরবীতে ‘‘নাক্ল আদ্-দাম’’ ও ‘‘তাবাররু বিদ দাম’’ বলা হয়। চিকিৎসকরা নিরাপদ বিশুদ্ধ রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্য পরামর্শ প্রদান করেন। নিরাপদ রক্ত বলতে যে কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট, কেমিক্যাল ইত্যাদি ক্ষতিকর উপাদান বা যে কোন জীবাণুমুক্ত রক্তকে বোঝায়। একমাত্র স্বেচ্ছায় সুস্থ রক্তদাতার মাধ্যমে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় প্রাথমিক পর্যায়ে দাতার একটি সংক্ষিপ্ত শারীরিক পরীক্ষা ও চিকিৎসার ইতিহাস গ্রহণ করা হয়। এরপর নমুনা সংগ্রহ করে ‘ব্লাডস্ক্রিনিং’ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ঝুঁকিমুক্ত হিসেবে নিশ্চিত করা হয়। রক্তের মাধ্যমে ছড়ানো রোগগুলো এ পরীক্ষার অন্তর্ভূক্ত। এ ক্ষেত্রে রক্তদাতা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এইডস্, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস বি এবং হেপাটাইটিস সি ইত্যাদি পরীক্ষার ফলাফল পেয়ে যায়। মূলত রক্তদাতার সুস্থতা ও দানের উপযোগিতা এবং গ্রহীতার জন্য সম্ভাব্য ক্ষতির ঝুঁকিমুক্তির নিমিত্ত এসব পরীক্ষা করা হয়। গৃহীত রক্তের পরিমাণ ও পদ্ধতি ভিন্ন হতে পারে। তবে সাধারণত একজন দাতা থেকে একবার সর্বোচ্চ পাঁচশত মিলিলিটার রক্ত নেয়া হয়। সংগৃহীত রক্ত পরিসঞ্চালন বা অংশীকরণের মাধ্যমে ঔষধে পরিণত করে গ্রহীতার দেহে প্রবেশ করানো হয়।
রক্তদান পরিসঞ্চালনের প্রয়োজনীয়তাঃ মানবদেহে প্রবাহমাণ অস্বচ্ছ লাল তরল পদার্থটি রক্ত। এটি শিরা বা ধমনীর মধ্যে দিয়ে পুরো দেহে বাহিত হয়। দেহের প্রতিটি টিস্যুতে খাবার ও অক্সিজেন পৌঁছে দেয়। এ খাবার ও অক্সিজেন টিস্যুর বৃদ্ধি ও ক্ষয় রোধের জন্যে অপরিহার্য। এছাড়া দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হরমোন রক্তের মাধ্যমে প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে পৌঁছে অঙ্গের কর্মক্ষমতা নিশ্চিত করে। রক্ত টিস্যুর বর্জ্যগুলো বের করে দেয়। কার্বন-ডাই-অক্সাইডকে ফুসফুসের মাধ্যমে দেহের বাইরে বের করে দেয়। দেহের পাশাপাশি দেহের বিভিন্ন অংশে রাসায়নিক পদার্থ ও পুষ্টি সরবরাহ করে। অন্যান্য তরল পদার্থগুলোর ভারসাম্য বজায় রাখতেও সহায়তা করে। রক্তের সাহায্যে দেহের তাপমাত্রা ঠিক থাকে। রোগাক্রান্ত দেহে জীবাণুর বিরুদ্ধে রক্তই প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তোলে। দেহের অভ্যন্তরস্থ এসিড এবং ক্ষারের স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখাও রক্তের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
চিকিৎসা পদ্ধতির উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসা সেবা লাভের সুযোগ সৃষ্টির সুবাদে রক্তের বহুবিধ প্রয়োজন পরিলক্ষিত হয়। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে প্রতিদিন শত শত রোগীর অপারেশন হচ্ছে। এতে প্রতিদিনই শত শত ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন পড়ে। এছাড়া বিভিন্ন কারণে শরীরে রক্তাল্পতা দেখা দেয়। হঠাৎ কোন দুর্ঘটনার কারণে অধিক রক্ত প্রবাহিত হয়ে রক্তাল্পতা সৃষ্টি হলে রক্তের প্রয়োজন হয়। তৎক্ষণাৎ শরীরে রক্ত সরবরাহের মাধ্যমে জীবন রক্ষা করা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়ে। তাছাড়া রক্তের ক্যান্সার, রক্তশূণ্যতা, হিমোফিলিয়া, ডেঙ্গুসহ রক্তের স্বল্পতাজনিত অন্যান্য রোগের চিকিৎসায় রোগীর দেহে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন পড়ে। আবার অনেকক্ষণ অপারেশন চলার কারণে অতিরিক্ত রক্ত বাহিত হয়ে গেলেও রক্তের প্রয়োজন হয়। আবার কারও দেহে রক্ত সম্পূর্ণভাবে তৈরি হতে পারে না। থ্যালাসেমিয়ার রোগীরা কিছুদিন পর পর শরীরে রক্ত সঞ্চালনের মাধ্যমে বেঁচে থাকে। কারও দেহে যদিও রক্ত তৈরি হয় তা লোহিতকণিকার জন্য সময়ের আগেই নষ্ট হয়ে যায়। এতে ব্লাড ক্যান্সারের মত ভয়ঙ্কর অসুখ দেখা দেয়। ফলে এ অসুখের জন্য ঘন ঘণ রক্ত পরিবর্তন করতে হয়। তার জন্য প্রচুর রক্তের প্রয়োজন হয়। যথারীতি সপ্তাহে একবার শরীরে অবশ্যই রক্ত দিতে হয়।
রক্তদান দাতার স্বাস্থ্যের জন্যও বেশ উপকারী। রক্তদানের পর শরীরে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। রক্তদান করার দুই সপ্তাহের মধ্যেই নতুন রক্ত কণিকা জন্ম হয়ে এ ঘাটতি পূরণ করে। বছরে তিনবার রক্তদান রক্তদাতার লোহিত কণিকাগুলোকে প্রাণন্ত করে তোলে। রক্তদানের ফলে হৃদরোগ ও হার্ট এটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমে আসে। তাছাড়া মুমূর্ষু মানুষকে রক্তদান করে অপার মানসিক তৃপ্তি পাওয়া যায়।
রক্তদান ও পরিসঞ্চালনের ইতিহাসঃ সর্বপ্রথম ১৬১৬ সালে ইংরেজ চিকিৎসক ডা. উইলিয়াম হার্ভের গবেষণার মাধ্যমে মানুষ মানবদেহের অভ্যন্তরে রক্ত প্রবাহের বিষয়ে জানতে পারে। স্যার ক্রিস্টোফার রেন ১৬৫৭ সালে ডা. উইলিয়াম হার্ভে আবি®কৃত যন্ত্র ব্যবহার করে জন্তুর দেহে ইনজেকশনের মাধ্যমে তরল পদার্থ প্রবেশ করান। ডা. রিচার্ড লোয়ার ১৬৬৬ সনে সফলভাবে প্রথমবারের মতো একটি কুকুরের দেহ থেকে আরেকটি কুকুরের দেহে রক্ত সঞ্চালনের পরীক্ষা চালান। অবশ্য এর পরে পশুর দেহ থেকে মানবদেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করতে গিয়ে চিকিৎসকদের হাতে প্রাণ হারান অনেক মানুষ। ফলে ১৬৭৮ সনে রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যাপারে পোপ নিষেধাজ্ঞা প্রদান করেন। ডা. জেমস ব্লান্ডেল নামে একজন ইংরেজ ধাত্রীবিদ্যাবিশারদ ১৮১৮ সালে রক্ত পরিসঞ্চালনের জন্যে একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন, যা দিয়ে সফলভাবে একজন সুস্থ মানুষের দেহ থেকে আরেকজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষের দেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা হয়। তিনিই প্রথম মানুষের শরীরে কেবল আরেকজন মানুষের রক্তই দেয়া যাবে বলে নিশ্চিত করেন। ১৯০১ সনে ভিয়েনার ডা. কার্ল ল্যান্ডস্টেনার মানুষের রক্তের প্রধানত ৪টি গ্রুপ এ, ও, বি, এবং এবি. সনাক্ত করেন। ১৯১৪-১৯১৮ সনে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের এ সময়টায় যুদ্ধাহত হাজার হাজার মানুষকে বাঁচাতে অনেক রক্তের প্রয়োজন হয়েছিল। তখনই মানুষ রক্তদাতার শরীর থেকে বের করে সোডিয়াম সাইট্রেট মিশিয়ে জমাট বাঁধা থেকে রক্ষা করা এবং ফ্রিজে সংরক্ষণ করা আবিষ্কার করে। প্রথমবারের মতো ১৯১৬ সনে সফলভাবে সংরক্ষিত রক্তকে আরেকজনের দেহে প্রবেশ করান হয়। এই ধারণা থেকেই একজন আমেরিকান মেডিকেল গবেষক অসওয়াল্ড হোপ রবার্টসন ফ্রান্সে বিশ্বের প্রথম ব্লাড ব্যাংকের সূচনা করেন। তারপর ১৯২১ সনে লন্ডনের কিংস কলেজ হাসপাতালে বৃটিশ রেডক্রসের সদস্যরা সবাই একযোগে রক্ত দেয়ার মাধ্যমে বিশ্বের প্রথম স্বেচ্ছা রক্তদানের দৃষ্টান্ত সূচিত হয়। এর ফলশ্রুতিতে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের ন্যায় উপমহাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদান শুরু হয়। ইম্পিরিয়াল সেরোলজিস্টরা ১৯২৫ সনে কোনো ধরনের সংরক্ষণের ব্যবস্থা ছাড়া একজন রক্তদাতার দেহ থেকে একটি সিরিঞ্জের মাধ্যমে রক্ত করে রক্তগ্রহীতার দেহে পরিসঞ্চালনের ব্যবস্থা নিয়ে কলকাতার ট্রপিকেল মেডিসিন স্কুলে একটি রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র শুরু করে। ১৯৩৯ সনে ভারতের রেডক্রস সোসাইটি একটি ব্লাড ব্যাংক কমিটি গঠন করে। এই কমিটি যন্ত্রপাতি দিয়ে রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্রটিকে সহায়তা করে এবং রক্তদাতাদের সংগঠিত করতে চেষ্টা করে। ফলে ফ্লাস্কে করে রক্ত সংগ্রহ করে তা কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত ফ্রিজে সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়। মূলত চল্লিশের দশকে মেট্রোপলিটন শহরে এবং পঞ্চাশের দশকে জেলা শহরগুলোতে ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। সব ব্লাড ব্যাংকগুলোই পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বলে অনেক বেসরকারি ব্লাড ব্যাংক প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করা হয়। ১৯৮৫ সালে স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কলকাতায় প্রথমবারের মতো তিন দিনব্যাপী ন্যাশনাল সেমিনার এন্ড ওয়ার্কশপ অনুষ্ঠিত হয়। এই সেমিনারে রক্ত পরিসঞ্চালন বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়। স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রমকে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে তখন থেকে ‘গিফট অফ ব্লাড’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। জনস্বার্থে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ১৯৯৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে সকল প্রকার রক্তের কেনাবেচা বন্ধের ঘোষণা দেয় এবং স্বেচ্ছা রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করার জন্যে স্টেট ব্লাড ট্রান্সফিউশন কাউন্সিল গঠনের জন্যে সরকারকে নির্দেশ প্রদান করে।
বাংলাদেশে সর্বপ্রথম ১৯৭২ সালের ১০ই জুন জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর ডা. নুরুল ইসলাম নিজ রক্তদানের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্বেচ্ছায় রক্তদানের সূচনা করেন। ১৯৭৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজের কিছু ছাত্রের উদ্যোগে সন্ধানী নামে প্রথম রক্তদান সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। এছাড়া ১৯৮১ সনে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, ১৯৮২ সালে অরকা, ১৯৯৬ সনে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন, ১৯৯৭ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের উদ্যোগে স্বেচ্ছায় রক্তদান সংগঠন ‘বাঁধন’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এ পথ ধরেই ৫ মে ২০০৫ সালে ব্লাড-ফ্রেন্ড সোসাইটি প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে স্বেচ্ছায় রক্তদান কার্যক্রম নতুন মাত্রা যোগ করে। দেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে চার লক্ষ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। প্রয়োজনীয় রক্তের সরবরাহের অভাবে পেশাদার রক্ত বিক্রেতার দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালনের মাধ্যমে সিফিলিস, হেপাটাইটিস-বি, হেপাটাইটিস-সি বা এইডসের মতো সংক্রামক রোগ ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই দূষিত রক্তের পরিসঞ্চালন থেকে মুমূর্ষু মানুষকে রক্ষার জন্য নিরাপদ ও সুস্থরক্তের প্রয়োজনে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উদ্বুদ্ধ সচেতন নাগরিকদের সমন্বয়ে বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গড়ে ওঠেছে।
রক্তদান ও পরিসঞ্চালন সম্পর্কিত প্রচলিত আইনঃ বাংলাদেশে নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বহুমুখী উদ্যোগ নিয়েছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সরকার ‘নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন, ২০০২’ শিরোনামে ২০০২ সনের ১২ নং আইন পাশ করে। আইন প্রণয়নের উদ্দেশ্য ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে উল্লেখ করা হয় যে, নিরাপদ রক্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং রোগীর দেহে পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকল্পে প্রণীত আইন। এই আইন ২০০২ সনের ১০ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এই আইনে রক্ত বলতে পরিপূর্ণ মানব রক্ত এবং রক্তদানকে একটি সেবামূলক কাজ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। আইন অনুসারে অনুমোদিত ব্যক্তি নিরীক্ষিত রক্ত অনুমোদিত পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও পরিসঞ্চালন করতে পারবে। ডাক্তার কর্তৃক রক্ত পরিসঞ্চালন চিকিৎসা প্রদানকালে প্রদেয় রোগীর বা রক্ত গ্রহীতার রক্তের সঠিক চাহিদা, রক্তের উপাদানের প্রকৃতি, রোগী বা রক্ত গ্রহীতার বিদ্যমান শারীরিক অবস্থা এবং রক্ত পরিসঞ্চালনের ধরন বা পদ্ধতি ব্যবস্থাপত্রে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। এমবিবিএস বা সমমানের ডিগ্রিধারী এবং রক্ত পরিসঞ্চালন মেডিসিন বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিবিএসএন্ডটি, এমটিএম, এমডি, পিএইডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত ডাক্তারগণ ‘রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষজ্ঞ’ বলে বিবেচিত হবেন। এই বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সরকার এক বা একাধিক বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করবেন এবং তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেবেন।
স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রীর সভাপতিত্বে একুশ সদস্য বিশিষ্ট ‘জাতীয় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কাউন্সিল’ রয়েছে। এতদসংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও উদ্ভূত আনুষঙ্গিক বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ প্রদান এই কাউন্সিলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। ‘হিউম্যান ইমিউনো ভাইরাস অর্থাৎ এইচআইভি’, ‘হেপাটাইটিস বি ভাইরাস’, ‘হেপাটাইটিস সি ভাইরাস’, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিসসহ সর্বপ্রকার রক্ত বাহিত রোগ থেকে মানব দেহকে রক্ষার জন্য; নিরাপদ রক্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও পরিসঞ্চালনের পদ্ধতি নির্ধারণ; রক্তদাতাদেরকে স্বেচ্ছায় রক্তদান, স্বজনকে রক্তদান এবং রক্তের বিনিময়ে রক্তদানকে উৎসাহিত করা; পেশাদার রক্তদাতাদেরকে রক্তদানে পর্যায়ক্রমে নিরুৎসাহিত করার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব উক্ত কাউন্সিলের। এই কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত নীতিমালার ভিত্তিতে বেসরকারী রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত; রক্তদাতাদের পরিসংখ্যান সংরক্ষিত ও সরকারী হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র পরিচালিত হয়ে থাকে। (অসমাপ্ত)