মৌলভীবাজারে নেই করোনা পরীক্ষার ল্যাব, আইসিইউও সংকট

16

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা সংক্রমের ঝুঁকির দিক থেকে দেশের মধ্যে শীর্ষে মৌলভীবাজার। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু থেকে এমন ঝুঁকি ও শঙ্কা এ জেলায় এখনো চলমান। মৃত ও আক্রান্তের পরিসংখ্যান অত্যন্ত এমনটিই জানান দিচ্ছে। তারপরও প্রবাসী ও পর্যটন অধ্যুষিত এ জেলায় নেই করোনা পরীক্ষার পিসিআর ল্যাব। আর আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য আইসিইউও সংকট চরমে।
সরকারী আর প্রাইভেট হাসপাতাল মিলে ৮টি আইসিইউ ভরসা পুরো জেলাবাসীর। সরকারী যে ৫টি আছে সেগুলোও স্থাপন হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। জানা যায় গেল বছর করোনা ভাইরাস সংক্রমণের শুরুর দিকে সংগৃহীত নমুনা পরীক্ষা নিয়ে নানা বিড়ম্বনায় পড়তে হয় এ জেলার স্বাস্থ্য বিভাগকে। চরম দুর্ভোগ আর মানসিক যন্ত্রণা পোহান পরীক্ষার রিপোর্টের জন্য অপেক্ষমান ব্যক্তিরা। সংগৃহীত নমুনা প্রেরণের ১০-১২ দিন পর ঢাকা কিংবা সিলেট থেকে আসত রিপোর্ট। এজন্য তখন থেকেই অনেকে করোনার পরীক্ষায় অনিহা দেখান। রিপোর্টের ধীরগতির কারনে আক্রান্ত ব্যক্তির অজান্তেই অন্যজনও হন সংক্রমিত। এমন অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য জেলাবাসীর পক্ষে জোরালো দাবি উঠে দ্রুত করোনা পরীক্ষার জন্য পিসিআর ল্যাব স্থাপনের। এ দাবিতে রাজপথেও হয় আন্দোলন। এনিয়ে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী ও স্থানীয় দুইজন এমপি ল্যাব স্থাপনের সুপারিশ (ডিও লেটার দেন) করেন সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। আশ^স্ত হন জেলাবাসী। কিন্তু সে দাবি আজও উপেক্ষিত।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ৭টি উপজেলা থেকে প্রতিনিয়তই নমুনা সংগৃহীত হচ্ছে। সংগৃহীত ওই নমুনা পরীক্ষার জন্য তারা নিজস্ব ব্যবস্থায় সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ল্যাবে প্রেরণ করছেন। সেখান থেকে ১-২ দিন পর রিপোর্ট পাচ্ছেন। তবে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করে বলছেন জেলায় পিসিআর ল্যাব না থাকায় নমুনাও সংগৃহীত হচ্ছে কম। কারন সাথে সাথে রিপোর্ট পেলে করোনা আছে কিনা তা পরীক্ষার জন্য মানুষের আগ্রহ বাড়ত।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা গেল, পুরো জেলায় প্রতিদিন গড়ে ৪০-৫০টি নমুনা সংগ্রহ হচ্ছে। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে যা খুবই অপ্রতুল। জানা যায় জেলার ৭টি উপজেলায় ৫টি পৌরসভা। ৬৭টি ইউনিয়ন আর ২০১৫টি গ্রাম। সব মিলিয়ে এ জেলার বাসিন্দা প্রায় ২৩ লক্ষাধিক। এর মধ্যে প্রবাসী রয়েছেন ৫-৬ লক্ষাধিক।
সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, এ জেলায় করোনা সংক্রমণের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ১৪টিরও বেশি নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকা ও সিলেটে পাঠানো হয়। এর মধ্যে পজিটিভ এসেছে ২ হাজার ২২০৮টি। জেলা বিবেচনায় সারা দেশে সবচেয়ে বেশি শনাক্ত করোনা রোগী রয়েছে মৌলভীবাজারে। অথচ নেই পরীক্ষার ল্যাব।
এ জেলায় সংক্রমণের হার চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ছিল ৫ শতাংশ। মার্চের তা বেড়ে দাঁড়ায় ২২ দশমিক ২ শতাংশে। চলতি মাসেও সংক্রমণের হারও উঠানামা করছে। তবে প্রধম ধাপের চেয়ে দ্বিতীয় ধাপে বেড়েই চলেছে করোনা সংক্রমণের হার। রোগী শনাক্তের গুরুত্ব বিবেচনা করে গত বছর মৌলভীবাজারের ২৫০ শয্যার হাসপাতালে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের জন্য স্বাস্থ্যমন্ত্রী বরাবর চাহিদাপত্র (ডিও লেটার) দিয়েছিলেন মৌলভীবাজার-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নেছার আহমদ, মৌলভীবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য ও পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি জোহরা আলাউদ্দিন।
জানা যায়, এ জেলায় করোনা টিকার জন্য নিবন্ধন করেছেন প্রায় ৭৯ হাজার জন। এর মধ্যে প্রথম ডোজ টিকার নিয়েছেন ৬৬ হাজার। দ্বিতীয় ধাপে টিকা নিয়েছেন ৯ হাজার ৩৯৫ জন। জেলায় মোট টিকা এসেছে ১১ হাজার ৪৮৮ ভায়াল। জেলায় করোনা রোগীর চিকিৎসার জন্য জেলা সদর হাসপাতালসহ ছয়টি উপজেলা হাসপাতালে ১৪১টি বেড বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে ২৫০ শয্যা সদর হাসপাতালে ৫টি আইসিইউ বেড ও ৫০টি সাধারণ বেড। রাজনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৩০টি, কুলাউড়ায় ৫টি, জুড়ীতে ১৮টি,বড়লেখায় ৫টি,কমলগঞ্জে ২০টি ও শ্রীঙ্গলে ৮টি। বর্তমানে হাসপাতালের আইসোলেশনে ৪ জন রোগী চিকিৎসাধীন। করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সরকারি হিসাবে জেলায় মারা গেছেন ২৬ জন। তবে মৃত ব্যক্তির পরিবার ও জেলার বাহিরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু নিয়ে বেসরকারি পরিসংখ্যানে মোট মৃত্যু হয়েছে ৪২ জনের।
সম্মিলিত সামাজিক উন্নয়ন পরিষদের সভাপতি নাট্যব্যক্তিত্ব খালেদ চৌধুরী বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকে পিসিআর ল্যাব, আইসিইউসহ জেলায় মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য আন্দোলন করে আসছি। কিন্তু এখনো জেলাবাসীর অতি প্রয়োজনীয় সে প্রাণের দাবি উপেক্ষিত হচ্ছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মৌলভীবাজার জেলা সভাপতি ডা. ছাদিক আহমদ ও মৌলভীবাজার জেলা নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব বকশী ইকবাল আহমদ বলেন, পিসিআর ল্যাব না থাকায় ধীরগতিতে রিপোর্ট আসায় আক্রান্ত ব্যক্তির অজান্তেই অন্যরা সংক্রমিত হচ্ছেন। তাছাড়া আইসিইউ সেবা নামমাত্র। যেগুলো আছে সেগুলোও ব্যক্তি উদ্যোগে দেওয়া। দ্রুত এই দুটি দাবি বাস্তবায়নের জোর দাবি রাখছি।
মৌলভীবাজার পৌরসভার মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. ফজলুর রহমান বলেন, প্রবাসী ও পর্যটন অধ্যুষিত এ জেলায় মেডিকেল কলেজ স্থাপনের দাবি দীর্ঘদিনের। সেই সাথে করোনার শুরু থেকে পিসিআর ল্যাব স্থাপনের দাবিও ছিলো জোরালো। জেলাবাসীর পক্ষে পিসিআর ল্যাব ও ২৫০ শয্যা হাসপাতালে পূর্ণাঙ্গ আইসিইউ সেবা চালুর জোর দাবি জানাচ্ছি।
সিভিল সার্জন চৌধুরী ডা. জালাল উদ্দিন মুর্শেদ জানান, পিসিআর ল্যাব স্থাপনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র সংশ্লিষ্ট বিভাগে প্রেরণ করেছেন। তিনি বলেন, সংগৃহীত নমুনা রিপোর্ট আমরা সিলেটের ল্যাব থেকে এখন অনেকটাই সহজেই পাচ্ছি। আর আইসিইউর সংখ্যা কম তবে অক্সিজেন সরবরাহ থাকায় এখনো বড় ধরনের সমস্যা পোহাতে হচ্ছে না। তিনি জেলাবাসীকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে ও টিকা গ্রহণ করতে অনুরোধ জানান।