কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে দেয়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপীলের শুনানি শীঘ্রই হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার পর নিয়মিত আদালত চালু হলেই এ মামলার শুনানি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন এ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, আমরা মামলাটি শুনানির জন্য প্রস্তুত। এখন লকডাউনে আদালত সীমিত পরিসরে চলছে। আদালত নিয়মিতভাবে চালু হলেই আমরা এ মামলার শুনানির উদ্যোগ নেব।
২০১৩ সালের ১ আগষ্ট হাইকোর্টের বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজাউল হকের সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর ও বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। একই সঙ্গে আদালত ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করার সনদ দেন। দলটির পক্ষ থেকে হাইকোর্টের ওই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে আপীলও করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় ৮ বছর পার হলেও আপীলটি নিষ্পত্তি হয়নি। হাইকোর্টের রায়ের পর ২০১৩ সালের ২ নবেম্বর তিন বিচারপতির স্বাক্ষরের পর পূর্ণাঙ্গ রায়টি প্রকাশ করা হয়। ২০১৩ সালের ১ আগস্ট উন্মুক্ত আদালতে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেয়া ওই রায়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে মত দেন। ভিন্নমত জানান বেঞ্চের প্রিসাইডিং বিচারক বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন। সংক্ষিপ্ত রায়ে বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন বলেন, ‘বাই মেজরিটি, রুল ইজ মেইড এ্যাবসলিউট এ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন গিভেন টু জামায়াত বাই ইলেকশন কমিশন ইজ ডিক্লেয়ার্ড ইলিগ্যাল এ্যান্ড ভয়েড।’ পূর্ণাঙ্গ রায়ের মূল অংশটি লিখেন বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক। তিনি লেখেন, ‘জামায়াত এবং নির্বাচন কমিশন যুক্তি দেখিয়েছে, নিবন্ধনটি সাময়িক ছিল। কিন্তু সাময়িক নিবন্ধন দেয়া যায় বলে আমরা কোন বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে পাইনি। নিবন্ধন সনদেও সাময়িক নিবন্ধন বলে কোন বিষয় আমরা পাইনি।’
১৫৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে পাঁচ বছর আগে জামায়াতে ইসলামীকে কর্তৃত্ব বহির্ভূতভাবে নির্বাচন কমিশন নিবন্ধন দিয়েছিল বলে বলা হয়েছে। রায়ে বলা হয়, এই দলের প্রতীক দাঁড়িপাল্লা নিয়ে আর কেউ নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না। সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেয়া ওই রায়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক নিবন্ধন বাতিলের পক্ষে মত দেন। তবে ওই বেঞ্চের সিনিয়র বিচারক বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন তাতে ভিন্নমত পোষণ করেন। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন বলেন, যেহেতু এই বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের কাছে একটি দরখাস্ত রয়েছে। এখান থেকেই নিষ্পত্তি হওয়া দরকার। আদালতের আমলে নেয়ার দরকার নেই। ‘বাই মেজরিটি, রুল ইজ মেইড এ্যাবসলিউট এ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন গিভেন টু জামায়াত বাই ইলেকশন কমিশন ইজ ডিক্লেয়ার্ড ইলিগ্যাল এ্যান্ড ভয়েড।’ বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হক বলেছেন, এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিধান নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। যেতেতু এটা সাংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়েছে, সংবিধান সংশোধন করেনি। সে জন্য নিবন্ধন বাতিল বলে ঘোষণা করা হলো। “জামায়াত এবং নির্বাচন কমিশন যুক্তি দেখিয়েছে, নিবন্ধনটি সাময়িক ছিল। কিন্তু সাময়িক নিবন্ধন দেয়া যায় বলে আমরা কোন বিধান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে পাইনি। নিবন্ধন সনদেও সাময়িক নিবন্ধন বলে কোন বিষয় আমরা পাইনি।’ অন্য বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম বলেন, অত্র রুলটি নিরুঙ্কুশ করে বিচারপতি কাজী রেজাউল হক যে রায় ও সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন তার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে আমি আমার কিছু নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত ও সংযোজন করছি।
২০০৮ সালে ৩৮টি দলের সঙ্গে আগের সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী জামায়াতও নিবন্ধন পায়। আইন অনুযায়ী, শুধু নিবন্ধিত দলগুলোই বিগত নির্বাচনে অংশ নিতে পারে। জামায়াতকে নিবন্ধন দেয়ার সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে তরিকত ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী, জাকের পার্টির মহাসচিব মুন্সি আবদুল লতিফ, সম্মিলিত ইসলামী জোটের প্রেসিডেন্ট মাওলানা জিয়াউল হাসানসহ ২৫ জন ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে একটি রিট আবেদন করে। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট একটি রুল জারি করে। রাজনৈতিক দল হিসাবে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় ওই রুলে। পূর্ণাঙ্গ রায়ে বলা হয়, ‘সংশ্লিষ্ট বিধিতে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে এটা বলেছে, শর্ত পূরণ না করে দেয়া গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে এ ধরনের কোন নিবন্ধন দেয়ার এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের নেই। অথবা নির্বাচন কমিশন ওই গঠনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে শর্ত পূরণে জামায়াতকে অনুরোধ করতে পারে না। কারণ ওই নিবন্ধন প্রথম আইনী কর্তৃত্ব বহির্ভূতভাবে করা হয়েছে।’ ‘এর মাধ্যমে আমরা এটা বলতে পারি, এ বিষয়ে জারি করা রুলের সারবত্তা রয়েছে। রুলকে চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে ২০০৮ সালের ৪ নবেম্বর জামায়াতকে দেয়া নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং ফলহীন ঘোষণা করা হচ্ছে।’এম ইনায়েতুর রহিম কাজী রেজাউল হক রায়ের সঙ্গে একমত পোষণ করে একটি সংযুক্তি দেন। অন্যদিকে বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন তার দুই সহকর্মীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে তার রায়ে বলেন, জামায়াতের নিবন্ধন নিয়ে করা রিট আবেদন গ্রহণ যোগ্য নয়। ‘আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন নির্বাচন কমিশন নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দিয়ে রুল নিষ্পত্তি করলে ন্যায়বিচার হবে। সে মতে, যুক্তিযুক্ত দ্রুত সময়ে আইন অনুসারে জামায়াতের নিবন্ধন ইস্যু নিষ্পত্তি করার নির্দেশনা দিচ্ছি।’