স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ ॥ রক্তাক্ত একাত্তরে জকিগঞ্জ

16

জেড.এম. শামসুল :

১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর তিন দিক ঘেরা জকিগঞ্জ প্রস্তাবিত মহকুমা হিসাবে প্রতিষ্ঠা পায়। দীর্ঘ ২৩ বছর তথা কথিত পাকিস্তান আমলে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় জকিগঞ্জ প্রস্তাবিত মহকুমা পূর্ণ মহকুমার স্বাদ পায়নি। দীর্ঘ ২৩টি বছর বিজাতীয় শাসন, শোষন, অত্যাচার আর নিপিড়নের বিরুদ্ধে জকিগঞ্জবাসীর অবদান কম ছিল না। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১৯ এপ্রিল থেকে ২১ নভেম্বর পর্যন্ত ২২৩ দিন ছিল জকিগঞ্জবাসীর উপর হত্যা, নির্যাতন আর লুট-পাটের করুন ইতিহাস। এ ২২৩ দিন ছিল জকিগঞ্জের নিরীহ মানুষের উপর চরম নির্যাতন। এ নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, পুরুষ-মহিলাসহ শিশুরাও রক্ষা পায়নি।
এ ২২৩ দিন রাত দিন ছিল পাকিস্তানী বাহিনী আর তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস, মুজাহিদ বাহিনী ছাড়াও দুর্দান্ত পিস কমিটি নামক নর ঘাতকদের নির্মম ইতিহাস। আজও এদের কথা স্মরণ হলে শরীর শিউরে উঠে। মনে পড়ে করুণ কাহিনী। আজও এসব পাকিস্তানী ঘাতক বাহিনীর দোসরদের দৌরাত্ম কম নয়। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এসব দোসরা বিভিন্ন সময়ে সরকারী দলের সাথে মিশে গিয়ে তাদের অপতৎপরতায় লিপ্ত রয়েছে। এদের বিষ দাঁত ভেঙ্গে দিতে ব্যর্থ হলে বাঙালি জাতির এত রক্তক্ষরণের মূল্যায়ন হবে না।
স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘ সময় পার হলেও সে সময়কার স্বচক্ষে দেখা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে যোগসাজসে এদেশের কুসন্তানদের অপকর্মের ইতিহাস ভুলতে বসেছে নতুন প্রজন্ম। নতুন প্রজন্মদের জন্যই লিখতে হচ্ছে।
উল্লেখ করা খুবই প্রয়োজন যে, সত্তরের সাধারণ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন পাওয়ার পর তথা কথিত পাকিস্তান সরকার আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হস্তান্তর না করে বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখতে নানা ফন্দি-ফিকির শুরু করে। তাই পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধে দুর্বার গণ-আন্দোলনসহ অহসযোগ থেকে বৃহত্তর মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছে। তাই সত্তরের মার্চ মাসের শুরু হওয়া সকল হরতাল, আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলসহ সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে ১৯ এপ্রিল থেকে জকিগঞ্জের সাধারণ মানুষ সুরমা-কুশিয়ারা নদী সাঁতার কেঠে বা নৌকা দিয়ে নদীদ্বয় পাড়ি দিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের ভারতের করিমগঞ্জ শহরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। মার্চ মাসের অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে জকিগঞ্জ থানা শহরে সিলেট জেলা ন্যাপের এবং জেলা আওয়ামী লীগের অনেক নেতৃবৃন্দ অবস্থান করেছিলেন। হানাদার বাহিনী এদিন দুপুরে জকিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করার পর সকলকে জকিগঞ্জ শহর ছেড়ে যেতে হয়। এদিন সন্ধ্যার আগেই আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ সমর্থকদের করিমগঞ্জে চলে যান,তবে জকিগঞ্জের সনাতন ধর্মাবলম্বী মার্চের আন্দোলন চলাকালিন সময় থেকে শুরু করে ৯ এপ্রিল হানাদার বাহিনী জকিগঞ্জ প্রথম যাওয়ার পর থেকেই জকিগঞ্জের অসংখ্যক মানুষ ভারতের করিমগঞ্জ শহরে যাওয়া শুরু করে।
[জকিগঞ্জে হানাদার বাহিনীর আগমনী বার্তা যে ভাবে দু‘জন ভবঘুরে “মউজুফ” ব্যক্তি জানিয়ে দেয়; সত্তরের সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে শহরের ভেড়াই নামক একজন “মউজুফ” ব্যক্তির সাথে যুক্ত হলো অপরিচিত “মউজুফ” ব্যক্তি জকিগঞ্জের সমস্ত শহর ও কুশিয়ারা নদীর জলধার পর্যন্ত শুধু ঘুরে ভেড়াতো। কাউর সাথে কোনো প্রকার কথা বলত; না, কোনো-কোনো সময়ে মদির‘র দোকান থেকে শুকনো মরিচ ঝাঁপটা মেরে নিয়ে খেতে দেখা যেত। তবে এ “মউজুফ” ব্যক্তি কখনও মুখোমুখি হতো না। রাত-দিন একেক জন-বাজারের একেক গলি দিয়ে চলাচল করতো। মার্চ মাসের আন্দোলনের সময়ে আমরা স্কুলে আসলেও কোনো ক্লাস হতো না, তাই আমার সহপার্টিদেরকে নিয়ে জকিগঞ্জে আনাজ আঁটি নামে পরিচিত বাজারের ঐতিহ্যবাহি বিশালাকৃত আম গাছের নীচে আমাদের প্রতিটি সভা-সমাশের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে মুচকি হেঁসে-হেঁসে শুধু শোনা যেত বলছে; ‘ভাগ-ভাগ”। তারা দু‘জনই একেই কথা বলে ভেড়াতো। যেদিন হানাদার বাহিনী প্রবেশ করে সে দিনের ২/৩ আগে জকিগজের মাছ বাজারে আগুন লাগিয়ে অপরিচিত “মউজুফ” লোকটি নদীর ওপর পাড়ে করিমগঞ্জের চর বাজারে চলে যায়। ভেড়াই মিয়া জকিগঞ্জের বাজারে খুবই তাঁড়াহুড়া করে চলাচল করতে দেখা যায়। অনেকে বলতেন যে কোনো একটি বিপদের অশনি সংকেত, সত্যিই ৯ মার্চ সকালে জকিগঞ্জ থানা সদরে হানাদার বাহিনী জলপাই রংয়ের বেশ কয়েকটি নিয়ে জকিগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী কাস্মট্স অফিসের সামনে গিয়ে গাড়ী ব্যাক করে ফিরে আসে।
“৭১ এর মার্চ মাসের আন্দোলন-সংগ্রামের সময়ে প্রতিটি সভা-সমাবেশ শেষে সখাই মিয়ার চা স্টলে চলতো গরম-গরম পিয়াজি আর ছানা ভোনা খাওয়ার ধুম। যা এখনও জকিগঞ্জ শহরে গেলে মনে পড়ে। বর্তমানে এসবের কোনো অস্তিত্ব নেই বলে চলে। তৎকালিন সময়ে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ বলেছিলেন স্বাধীনতার পর ঐতিহাসিক আমতলা ও কাস্টাম্স ঘাটে স্থায়ী ভাবে স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি করা হবে, কিন্তু এখনও জকিগঞ্জে মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি স্তম্ভ তৈরি হয়নি। অথচ ৭২ সালে পুরোপুরি জকিগঞ্জের সম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ স্বরূপ আমিই নিজে জকিগঞ্জে প্রথম স্থায়ীভাবে শহীদ মিনার স্থাপন করলেও এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের কোনো স্মৃতিমূলক স্তম্ভ স্থাপন হয়নি, এবং স্থাপনের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। এনিয়ে স্বাধীনতাকামী মানুষের মধ্যে অসন্তেুাষ বিরাজ করছে।
একাত্তরের এই দিনে জকিগঞ্জে পাকিস্তানীরা হানা দেয় : ৯ এপ্রিল ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সীমান্তিক থানা সদর জকিগঞ্জে প্রথমবারের মতো হামলা চালায়। ঐদিন দুপুরে অন্যান্য দিনের মতো জকিগঞ্জে অফিস আদালত স্কুল সহ সকল প্রতিষ্ঠান চালু ছিল। থানা সদরে ছিল স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের সভা সমাবেশ। আর বাংলার মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন। আমরা অন্যান্য দিনের মত জকিগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্লাস করছি। দুপুর ১২টার দিকে আকস্মিকভাবে দেখতে পাই স্কুলের সামন দিয়ে পাকিস্তানী পতাকাবাহী কয়েকটি সাজায়ো গাড়ী কাস্টমস্ অফিসের দিকে যাচ্ছে। সাথে সাথে স্কুলের ছাত্র শিক্ষকদের মধ্যে তীব্র আতংক ছড়িয়ে পড়ে। প্রধান শিক্ষক ও সহকারী প্রধান শিক্ষক অফিস ছেড়ে বারান্দায় এসে সকল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে দৌঁড়াদৌঁড়ী না করে শ্রেণি কক্ষে বসে থাকার নির্দেশ দিলেন। সকল শিক্ষক, ছাত্র-ছাত্রীরা ভয়ে নীরব হয়ে পড়েছিল। তবে আমাদের ৬ষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষক গোলামুর রহমান স্যার আমাদেরকে অভয় দিলেন। যদি পাকিস্তানীরা স্কুলে ঢুকে পড়ে তবে তোমাদের কিছু হবে না। কিছু যদি একটা হয় তবে শিক্ষকদের হবে। অসুবিধা হলে স্কুলের পিছন দিয়ে সবাই চলে যাবে। হানাদার বাহিনী সোজা কাস্টমস্ অফিস থেকে ঘুরে জকিগঞ্জ বাজারের লঞ্চঘাট পরিদর্শন করে স্থানীয় চৌমুহনীতে ২০/২৫ মিনিট অবস্থান নেয়। এ সময় তাদের দোসররা পাকিস্তানী পতাকা নিয়ে তাদের সাথে মিলিত হয় এবং চৌমুহনীতে তাদের সাথে আলাপ করে জকিগঞ্জ ত্যাগ করে সিলেট চলে আসে। তবে সন্ধ্যার মধ্যে জকিগঞ্জ থানা সদর লোকশূন্য হয়ে পড়েছিল। পাকিস্তানী সৈন্যরা স্থান ত্যাগের পর স্থানীয় স্বাধীনতাপ্রিয় ছাত্র-জনতা জকিগঞ্জ থানা সদরে সমাবেশ করে। ইতোপূর্বে সিলেট থেকে যেসব নেতারা জকিগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছিলেন তারা জকিগঞ্জে অবস্থান করা নিরাপদ নয় ভেবে করিমগঞ্জ পাড়ি জমান। ঐদিন থেকে জকিগঞ্জবাসীর মধ্যে হানাদার আতংক বিরাজ করতে থাকে। ধীরে ধীরে অনেকে জকিগঞ্জ ছেড়ে ওপারে করিমগঞ্জ গিয়ে ভীড় জমাতে থাকেন। এদিকে সিলেট শহরে হানাদার বাহিনীর হাতে ঐদিনই সিলেট সদর হাসপাতালে হামলা করে অস্ত্রোপাচাররত অবস্থায় ব্রাশফায়ার করে নির্মমভাবে হত্যা করে ডাঃ শামছুদ্দিন, ডাঃ শ্যামল কান্তি লালা, সেবক মাহমুদুর রহমান, এ্যাম্বুলেন্স চালক ফুরকান আলীকে। এ ঘটনার মাত্র ৫ দিন পরই বাসভবন থেকে ধরে এনে নির্মমভাবে হত্যা করে ওসমানী মেডিকেল কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ ও হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক লেঃ কর্ণেল জিয়াউর রহমানকে। স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে সিলেটের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে সমাহিত করে। এভাবে ঘাতকরা প্রতিনিয়ত তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যাকান্ড চালিয়ে বাঙালী জাতিকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করে। (চলবে)