কাজিরবাজার ডেস্ক :
করনাকালের শুরু থেকে গত নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ফিরে এসেছেন ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ প্রবাসী শ্রমিক। তাদের মধ্যে একটি বড় অংশ দেশে ফিরেছেন কাজ হারিয়ে। ফেরত আসা এসব কর্মীদের আর্থিকভাবে পুনরেকত্রীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। তবে তা শুধু ঋণ ও অভিজ্ঞতা সনদ প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আর্থিক ও সামাজিকভাবে প্রবাসী কর্মীদের পুনরেকত্রীকরণের প্রক্রিয়া অনেক বড় চ্যালেঞ্জের কাজ বলে মনে করছেন এই খাতের সংশ্লিষ্টরা।
ফরিদপুরের আলাউদ্দিন ১৯ বছর ধরে কাজ করছেন সৌদি আরবে। করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই দেশে ফেরত এসেছিলেন। দেশে আসার পর ৭ মাস সংসার চালিয়েছেন ঋণের টাকায়। নতুন কাজ পাবার আশায় দিন কাটে তার। ভেবেছিলেন নতুন কাজ পেলেই ঋণ শোধ করবেন। তার প্রশ্ন চলতি ঋণ শোধের উপায় পাচ্ছি না, নতুন ঋণ নিয়ে কিভাবে কাজ করবো?
আলাউদ্দিনের মতো অসংখ্য প্রবাসী কর্মীরা কাজ না থাকায় কিংবা কাজ হারিয়ে ঋণের ওপর চালিয়েছেন জীবন। কিন্তু আয় না থাকায় সেই ঋণ পরিশোধে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। ১৮ ডিসেম্বর। প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসকে এবার জাতীয় দিবসের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। তাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস। মুজিব শতবর্ষে এই দিবসের প্রতিপাদ্য ‘মুজিববর্ষের আহ্বান , দক্ষ হয়ে বিদেশ যান’। আর এই দিনে কাজ হারানো প্রবাসী কর্মীদের প্রশ্ন, তারা এখন কী করবেন?
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবাসী কল্যাণ ডেস্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন দেশ থেকে ফিরে এসেছেন ৩ লাখ ২৬ হাজার ৭৫৮ জন, যার মধ্যে পুরুষ কর্মী আছেন ২ লাখ ৮৭ হাজার ৪৮৪ এবং নারী কর্মী আছেন ৩৯ হাজার ২৭৪ জন। ফিরে আসা কর্মীদের মধ্যে ৫০ শতাংশেরও বেশি এসেছেন কাজ হারিয়ে।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (অকাপ) সম্প্রতি র্যাপিড অ্যাসেসমেন্ট অনুযায়ী , সাড়ে ৩২ শতাংশ অভিবাসী কর্মী কাজ হারিয়েছেন। ৪৭ শতাংশ কাজ হারানো এবং বেতন কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে দেশে আসতে চাইছে না।
দেশে ফিরে আসা ৫৫৮ জন কর্মীর সঙ্গে কথা বলে ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচী একটি জরিপ চালিয়েছিল গত মে মাসে। সেখানে তারা বলছেন, দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীদের ৮৭ শতাংশেরই এখন কোনও আয়ের উৎস নেই। নিজের সঞ্চয় দিয়ে তিন মাস বা তার বেশি সময় চলতে পারবেন এমন সংখ্যা ৩৩ শতাংশ। ৫২ শতাংশ বলছেন, তাদের জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।
অন্যদিকে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) বিদেশফেরত ৫০ জন প্রবাসী কর্মীর ওপর গত জুন মাসে এক জরিপে দেখেছে যে, ৭৮ শতাংশ কর্মীর বিদেশে কিছু না কিছু পাওনা থেকে গেছে। এই পাওনার পরিমাণ কারও সাড়ে ৯ হাজার টাকা তো কারও ৫ লাখ টাকা।
৪ শতাংশ সুদে বিশেষ পুনর্বাসন ঋণ সুবিধা
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কর্মীদের জন্য ৪ শতাংশ সরল সুদে বিশেষ পুনর্বাসন ঋণের ব্যবস্থা করেছে সরকার। এই লক্ষ্যে ৭০০ কোটি টাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০ কোটি টাকা বিনা সুদে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকে দিয়েছে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড। বাকি ৫০০ কোটি টাকা প্রক্রিয়াধীন আছে। মূলত করোনা সংক্রমণের কারণে চলতি বছরের ১ মার্চের পর থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দেশে ফেরত আসা অভিবাসী কর্মীরা পাবেন এই ঋণ। নীতিমালা অনুযায়ী, এক ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক। সরল সুদের এই ঋণের মেয়াদ হবে খাত অনুযায়ী এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে।
তবে এই ঋণ প্রাপ্তিতে শর্ত কঠিন বলে মনে করেন প্রবাসী কর্মী এবং অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা। এই প্রসঙ্গে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শর্ত কঠিন নয়। চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অনেক প্রবাসী কর্মী জানেন না তারা ঋণ নিয়ে কিভাবে কাজ শুরু করবেন বা কী কাজ করবেন। যার কারণে জটিলতা তৈরি হয় ঋণ আবেদনের ক্ষেত্রে।
বিনামূল্যে পূর্ব অভিজ্ঞতার সনদ দিচ্ছে সরকার
মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা বিভিন্ন পেশার প্রবাসী কর্মীদের জন্য সরকারি খরচে আরপিএল (রিকগনিশন অব প্রায়র লার্নিং) বা অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি দিচ্ছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। বিদেশ প্রত্যাগত কর্মীদের অর্জিত দক্ষতার সনদের মাধ্যমে আবার ভাল চাকরি নিয়ে বিদেশ যেতে পারবেন। এই সনদ আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্ব বহন করবে। কর্মীরা তাদের পূর্ব অর্জিত দক্ষতার স্বীকৃতি পেলে গুণগত শ্রম অভিবাসন নিশ্চিত হবে বলে মনে করেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ।
অভিবাসন খাতের স্টেক হোল্ডাররাও মনে করেন পুনরেকত্রীকরণের কাজটি অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এটা সবাইকে মিলেই করতে হবে। ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, একজন প্রবাসী কর্মী দীর্ঘদিন কাজ করেও অনেক আয় করে দেশে ফিরতে পারে। যার ফলে সমাজ ও পরিবার থেকে সে দীর্ঘদিন ধরে এক ধরনের দূরত্বে থাকে। তাকে যদি পরিবার আর সমাজ সেভাবে গ্রহণ না করে, তাহলে কিন্তু তার জন্য সমস্যা। নারী কর্মীর ক্ষেত্রেও এরকম হলে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা কঠিন। করোনার মধ্যে যারা ফেরত এসেছেন তাদের মধ্যে অনেকেই এমন আছেন যাদের খরচের টাকাও তুলতে পারেননি। তার পরিবার তার ওপর নির্ভর ছিল। এই মানুষগুলোকে আমরা যদি সমাজে পুনরেকত্রীকরণ করতে না পারি, তাহলে কিন্তু আর্থিক এবং পারিবারিক দুই ধরনের সংকটে সে পড়ে। যার ফলে তাদের আর্থিক এবং সামাজিক পুনরেকত্রীকরণ জরুরি। করোনার কারণে এই মানুষগুলো সব হারিয়ে আসছে।
তিনি আরও বলেন, যারা অনেক টাকা নিয়ে ফেরত আসে তাদের ক্ষেত্রে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ আবার যারা শূন্য হাতে ফিরে আসে তাদের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ অন্যরকম। করোনার কারণে কাজ হারিয়ে আসছে যারা তাদের চ্যালেঞ্জের শেষ নেই। সামাজিক ক্ষেত্রে একটা দোষারোপ শুরু হয়, প্রথম বাধাটি শুরু হয় সমাজ থেকে। যার কারণে সে সব কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন বোধ করে। দ্বিতীয়ত অনেকেই মানসিক ট্রমায় থাকে। এছাড়া সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হল আর্থিক পুনরেকত্রীকরণ অর্থাৎ জীবন ধারণ। এত টাকা খরচ করে যাওয়ার পর এখন আবার ঋণ নিয়ে কী করবে, এটা হচ্ছে আর্থিক চ্যালেঞ্জ। পুনরেকত্রীকরণ অভিবাসনের একটি অংশ। যারা আমাদের রিজার্ভ বাড়াচ্ছে, ১৮ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে তাদের পাশে আমাদের দাড়াতে হবে। তাদের পাশে না দাঁড়ালে সেটা হবে অকৃতজ্ঞতা। তাদের সম্মান জানাতে তাদের পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। এটা শুধু সরকারের একার কাজ না, সরকারই বেসরকারি সংস্থা সবার দায়িত্ব।
অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (অকাপ) চেয়ারম্যান শাকিরুল ইসলাম বলেন, অভিবাসনের মাধ্যমে যে উন্নয়ন সেটিকে যদি টেকসই করতে হয় তাহলে পুনরেকত্রীকরণের কাজটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটি অনেক চ্যালেঞ্জিং একটি কাজ। কারণ যারা ফেরত আসেন তাদের এক একজনের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সক্ষমতা এক এক ধরনের। সেক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজন অনুযায়ী পুনরেকত্রীকরণের কথা চিন্তা করা না হলে কাজটি সঠিকভাবে হয় না। এক্ষেত্রে তাদের আলাদা আলাদা সাপোর্ট সার্ভিস দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের সঙ্গে পুনরেকত্রীকরণের কাজ যেসব সংস্থা করছে তাদের সাপোর্ট এবং সার্ভিসের জায়গাটি আরও জোরদার করা।
তিনি আরও বলেন, সরকার এখন যে ঋণের ব্যবস্থা করেছে সেটি পাওয়ার জন্য একজন অভিবাসী কর্মীর যে সাপোর্ট দরকার সেটি সে পাচ্ছে না। আবেদন কিভাবে করবে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কী লাগবে অথবা ব্যবসার পরিকল্পনা কিভাবে করবে এই সাপোর্টগুলো তারা কিন্তু পাচ্ছে না। যার কারণে ঋণ সুবিধা ভোগ করতে পাচ্ছে না। তাছাড়া ঋণ গ্রহণের জন্য আরেকটি শর্ত হচ্ছে সম্পদ থাকা লাগবে, অনেক অভিবাসী কর্মীর সেরকম কোনও সম্পদ নেই। তাহলে তো বিরাট একটি অংশ এমনিতে বাদ পড়ে যায়। সুতরাং এই জায়গাগুলো একটু গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত।