কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রসঙ্গে বলেছেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম সব জায়গা থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনী বইটি প্রকাশ হওয়ার পর দেশ ও জাতি ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে কিছুটা রক্ষা পেয়েছে।
বুধবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ব্রেইল সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু যেন তাঁর নিজের জীবনের ঘটনাগুলো লিখে রাখেন, সেজন্য তাঁর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সব সময় উৎসাহ দিতেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী যে ডায়েরি, সেটা ব্রেইল প্রকাশ করা হয়েছে যাতে আমাদের দৃষ্টি প্রতিবন্ধীরাও পড়তে পারে এবং তাঁর সম্পর্কে জানতে পারে। আমি মনে করি এটা একটা মহৎ উদ্যোগ। অনুষ্ঠানের শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী বইটির ব্রেইল সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়ার জন্য সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা হিসেবে আমরা গড়ে তুলব। মুজিববর্ষে এটাই আমাদের অঙ্গীকার। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পরে বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নাম সব জায়গা থেকে মুছে ফেলা হয়েছিল। এই বই প্রকাশ হওয়ার পর সেই ইতিহাস বিকৃতির হাত থেকে কিছুটা হলেও আমরা রক্ষা পেয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বুধবার মন্ত্রী সভার সাপ্তাহিক বৈঠকের আগে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই মোড়ক উন্মোচন করেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে যেমন তাঁর জীবন গাথা আছে, পাশাপাশি তাঁর সংগ্রামেরও অনেক কথা আছে। আমাদের ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনের অনেক তথ্য এখানে পাওয়া যায়। সারাবিশ্বে বইটি ইতোমধ্যে ১৪টি ভাষায় অনুদিত হয়েছে এবং আরও কয়েকটি ভাষায় অনুবাদ করার জন্য আমাদের কাছে অনুমতি চেয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বে যারাই এটা পড়েছে তাঁদের কাছেই এটা অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য হয়েছে। জাতির পিতার জীবনী এবং তার সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যুদয়, বাঙালি জাতি হিসেবে আমাদের আত্মপরিচয় এবং আজকে যে স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছি, সেই ইতিহাস জানার এখানে সুযোগ রয়েছে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের এই সময়ে তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ৬ খন্ড ব্রেইল সংস্করণ প্রকাশ করায় প্রধানমন্ত্রী সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান।
সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ অনুষ্ঠানে সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করেন এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মজীবনী। ১৯৬৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকাকালে বঙ্গবন্ধু এটি লেখা শুরু করেছিলেন। ২০১২ সালের ১২ জুন বইটি প্রকাশিত হয়। দৃষ্টি প্রতিবন্ধী পাঠকদের কথা বিবেচনা করে ‘মুজিববর্ষ’ উদযাপন উপলক্ষে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটির ব্রেইল সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং প্রথম ধাপে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ১০০ সেট (প্রতিটি ৬ খ-) ব্রেইল সংস্করণ মুদ্রণ সম্পন্ন হয়েছে।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এবং ‘কারাগারের রোজনামচা’ দুটি বইয়ের নামকরণই জাতির পিতার ছোট কন্যা শেখ রেহানার করা, অনুষ্ঠানে জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শ্রেণী পর্যন্ত বছরের শুরুতে বিনামূল্যে যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করা হয় সেগুলোও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল আকারে প্রকাশ করা হচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে এই ব্রেইল বই প্রকাশ করার ফলে, আমি মনে করব, আমাদের সমাজের একটা মূল্যবান গোষ্ঠী, তাঁরাও ইতিহাসটা জানার সুযোগ পাবে। আর এরমধ্য দিয়ে তারাও যে আমাদেরই একজন সেটাও কিন্তু প্রমাণিত হলো।’ মোট ৬ খন্ড ব্রেইলে প্রকাশ করা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এগুলো লাইব্রেরীতে সংগ্রহের পরামর্শ দেন। কেননা ব্যক্তিগত পর্যায়ে সংগ্রহ করে দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য এগুলো পড়াটা একটু কষ্টসাধ্য হবে বলেও তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন।
প্রধানমন্ত্রী তার প্রয়াত বান্ধবী সাংবাদিক বেবী মওদুদকে নিয়ে জাতির পিতার ডায়েরিগুলো সংগ্রহ এবং একে পরিপূর্ণ বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নেন উল্লেখ করে বলেন, ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের রিপোর্টগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে বই প্রকাশ করেছি (সিক্রেট ডকুমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দি নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)। যার ৬ খন্ড ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে এবং ৭ম ও ৮ম খন্ড (মোট ১৪ খন্ডের মধ্যে) প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, এর মাধ্যমেও কিন্তু আমাদের দেশের সংগ্রামের ইতিহাস, বিশেষ করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের ইতিহাসটা বের হয়ে এসেছে এবং আমরা কিভাবে স্বাধীনতা অর্জন করেছি সেটা ধীরে ধীরে প্রকাশ পেয়েছে। বঙ্গবন্ধুর কারাগারে বসে লেখা অপর আত্মজীবনী ‘কারাগারের রোজনামচা’র বিষয়ে তিনি বলেন, ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেয়ার পর তাঁকে (বঙ্গবন্ধু) যখন গ্রেফতার করে কারাগারে রাখা হয় সে সময় তিনি এই ডায়েরিটা লেখেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৫২ সালে একটি শান্তি সম্মেলন উপলক্ষে চীন ভ্রমণ নিয়ে জাতির পিতা লেখেন ‘আমার দেখা নয়াচীন’। ১৯৫৪ সালে তিনি যখন গ্রেফতার ছিলেন তখন এই লেখাটা লিখেছিলেন। জাতির পিতার এসব ব্যক্তিগত ডায়েরি যা পরবর্তীতে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো প্রত্যেকটি খাতার ওপরই জেলখানার সেন্সরশিপের সিল এবং সই রয়েছে। সময়গুলোও সেখান থেকে খোঁজ করে বের করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুকে আত্মজীবনী লেখার জন্য বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব সব সময় উদ্বুদ্ধ করতেন উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার মা সব সময় অনুপ্রেরণা দিতেন তিনি যেন তাঁর (বঙ্গবন্ধু) জীবনীটা লিখে রাখেন। সেই থেকে তিনি কিন্তু লিখতে শুরু করেন। বাবা যতবার কারাগার থেকে মুক্তি পেতেন আমার মা জেলগেটে থেকে বাবার লেখার খাতাগুলো সংগ্রহ করে রাখতেন।’
অসমাপ্ত আত্মজীবনীর পান্ডুলিপি উদ্ধারের ইতিহাস প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো ১৯৭১ সালে এই খাতাগুলো আমরা প্রায় হারাতে বসেছিলাম। আমাদের ধানমন্ডির বাসা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী লুটপাট করে। যদিও সবকিছু লুটপাট করে, তবে এগুলো লাইন টানা রুল করা কিছু খাতা ছিল বিধায় সেগুলো তাদের নজরে পড়েনি বা তাদের কাছে এগুলোর কোন মূল্য ছিল না। যাই হোক এক সময় সেগুলো উদ্ধার করে নিয়ে আসি। যা অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ভূমিকাতে আমি লিখেছি।
তিনি বলেন, ’৭৫ এ জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর তাদের ধানমন্ডির বাসায় আবার লুটপাট হয়। ’৮৬ সালে (আওয়ামী লীগ সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর) দেশে ফিরে আসার পর জিয়াউর রহমান সে বাসায় তাকে ঢুকতে দেয়নি বরং সে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ দিয়ে খুনীদের বিচারের পথ রুদ্ধ করে তাদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃতও করেছিল। পরে যখন সে বাড়িতে ঢুকতে দেয়া হয় তখনই তিনি খাতাগুলো সেখান থেকে এবং ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলায় তার (শেখ হাসিনা) বেঁচে যাওয়ার পর এক ফুফাত ভাইসহ আরও কয়েকজনের সহায়তায় বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে ফেরার পর জেনারেল জিয়া তাকে ৩২ নম্বরের বাসায় প্রবেশ করতে দেয়নি। বাড়িটি সিলগালা করে দেয়া হয়েছিল। তখন হঠাৎ করে ১২ জুন তাদের কাছে মনে হলো বাসাটা খুলে দেবে। এরপর ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে প্রবেশ করে জাতির পিতার লেখার খাতাগুলো সংগ্রহ করি। কিন্তু অসমাপ্ত আত্মজীবনীর লেখাগুলো সেদিন পাওয়া যায়নি। তবে টাইপ করা পোকায় কাটা কতগুলো কাগজ সেদিন পাওয়ার কথা জানান তাঁর কন্যা শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন পর ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধুর এক ভাগ্নে অতি পুরনো-জীর্ণপ্রয় এবং প্রায় অসস্পষ্ট লেখার চারটি খাতা আমাকে এনে দেন। সে ওই খাতা চারটি বঙ্গবন্ধুর আরেক ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণির অফিসের টেবিলের ড্রয়ার থেকে সংগ্রহ করেন। ওই লেখাগুলোই ছিল বঙ্গবন্ধুর হারিয়ে যাওয়া আত্মজীবনীর অংশ। তিনি বলেন, খাতাগুলোর জীর্ণশীর্ণ দশা ছিল। ফটোকপি করে, স্ক্যান করে ম্যাগনিফাইং গ্লাস ব্যবহার করে অনেক কষ্ট করে সেগুলোর পাঠোদ্ধার করতে হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জেনারেল জিয়ার আদলে তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার ইতিহাস বিকৃতির পদক্ষেপ সম্পর্কে বলেন, ২০০১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত বঙ্গবন্ধু চেয়ার পর্যন্ত সরিয়ে দেয়। তিনি তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কথা পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবে আমরা গড়ে তুলব। মুজিববর্ষে এটাই আমদের অঙ্গীকার।
অনুষ্ঠানের গণভবন প্রান্তে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউস, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মোঃ তোফাজ্জাল হোসেন মিয়া, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিমসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ সচিবালয়ের মন্ত্রী পরিষদ কক্ষে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমদ, মন্ত্রী পরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
চাষী পুরস্কৃত, প্রতিবন্ধী নারীর দায়িত্ব নিলেন প্রধানমন্ত্রী
নিজে গরিব হওয়া সত্ত্বেও চাষী আমজাদ আলী শারীরিকভাবে অসুস্থ গর্ভবতী এক প্রতিবন্ধী নারীকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে ঘটনাটি জানতে পেরে মানবিক চাষী আমজাদ আলীকে পুরস্কৃত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব নিলেন ওই প্রতিবন্ধী নারীর। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।