স্টাফ রিপোর্টার :
স্বনামধন্য ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিট সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাস এলাকায় ক্যাম্পাস থেকে এক গৃহবধূ তরুণীকে (১৯) তুলে নিয়ে গণধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল সিলেট। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন রাস্তায় নেমে টাওয়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভে ফেটে পড়েছেন।
তাদের অভিযোগ, করোনা পরিস্থিতিতে কলেজ বন্ধ থাকার পরেও ছাত্রাবাস কিভাকে খোলা রাখেন কলেজ কর্তৃপক্ষ। এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডের বিষয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের অবগত থাকার পরেও কেন ছাত্রাবাস বন্ধ করে দেয়া হল না। গত শুক্রবার আমাদের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপিঠে কলংকের দাগ লেগেছে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ধর্ষণের ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান। অন্যায় তারা আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা দেয়ার হুঁশিয়ারী দেন।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ওই গৃহবধূ তরুণীর স্বামী শুক্রবার বিকেলে স্ত্রীকে নিয়ে এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরতে যান। সন্ধ্যার দিকে একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনের কয়েকজন ওই দম্পতিকে ধরে নিয়ে এমসি কলেজ মাঠে চলে যায়। সেখানে তরুণীর স্বামীকে বেধড়ক মারপিট করে তারা। এক পর্যায়ে ওই তরুণীকে ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার ৭ নং ব্লকের সামনে একটি সাদা রঙের প্রাইভেট কারের ভেতরে রেখে পালাক্রমে সবাই মিলে ধর্ষণ করে। এরপর তারা চলে যায়। পরে পুলিশ এসে তাদেরকে উদ্ধার করে। এ খবর পাওয়ার পর রাত ১২টার দিকে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার সোহেল রেজা, শাহপরাণ থানার সহকারী কমিশনার মইনুল আফসর, র্যাব-৯ এর এএসপি সামিউল আলম, শাহপরান থানার ওসি মো: আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল সংখ্যক সদস্য ঘটনাস্থলে ছুটে যান। পরে গভীর রাতে ধর্ষিত তরুণীকে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) ও তার স্বামীকে একই হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। রাতে যে কারের ভেতরে তরুণীকে ধর্ষণ করা হয় সেটি এবং ধর্ষণকারীদের ফেলে যাওয়া একটি মোটরসাইকেলও পুলিশ জব্দ করেছে। এছাড়া ঘটনার পরপরই হোস্টেলে অভিযান পরিচালনা করেছে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় অভিযুক্তদের কক্ষে তল্লাশী চালানো হয়। শুক্রবার রাত আড়াইটার দিকে ধর্ষণে অভিযুক্ত সাইফুর রহমানের কক্ষে তল্লাশীকালে পরিমাণ ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়। শাহপরাণ থানা পুলিশের একটি টিম জানায়, ধর্ষণে অভিযুক্ত সাইফুর রহমানের কক্ষ থেকে ১টি দেশীয় তৈরী পাইপগান, ৪টি রামদা, ২ টি চাপাতি এবং ১টি ছোরা উদ্ধার করা হয়েছে। ধর্ষক সাইফুর রহমান হোস্টেল সুপারের রুম দখল করে দীর্ঘদিন ধরে সে বসবাস করে আসছিলো। ওই রুম থেকেই অস্ত্রগুলো উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনার সাথে শাহ রনি, সাইফুর, তারেক, অর্জুন, রবিউল, মাহফুজের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, তারা টিলাগড়ের সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠনের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।
এদিকে এ ঘটনায় শাহপরান থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন ও অস্ত্র আইনে পৃথক দুটো মামলা দায়ের করা হয়েছে। নারী নির্যাতন মামলাটি (নং : ২১) দায়ের করেছেন নির্যাতিতার স্বামী মাইদুল ইসলাম ও অস্ত্র মামলাটি (নং : ২২) দায়ের করেছেন এসআই মিল্টন রায় চৌধুরী। নারী নির্যাতন মামলায় ৬ জনের উল্লেখ করে আরো ১/২ জনকে আসামি করা হয়েছে। অস্ত্র মামলায় একমাত্র আসামি করা হয়েছে সাইফুরকে।
পুলিশ সূত্র জানায়, গণধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের ধরতে পুলিশের ৭টি দল সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ধর্ষকদের ধরতে কোতোয়ালি থানার এসআই শ্যামলাননন্দ ঘোষ এএসআই মাসুদের নেতৃত্বে হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জে একটি অভিযান চলছে। এছাড়া সুনামগঞ্জসহ বিভাগের বিভিন্ন স্থানে আরও ৬টি অভিযান চলছে। এছাড়া গতকাল শনিবার এ ঘটনায় দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া। এ সময় তিনি বলেন, ঘটনা তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ছাত্রাবাসের একাধিক আবাসিক শিক্ষার্থী জানান, সাইফুর খুবই উগ্র ছিল। সে বেপরোয়া চলাফেরা করত। মিছিল-মিটিংয়ে কোন শিক্ষার্থী না গেলে তাদের তার কক্ষে নিয়ে বেধড়ক মারধরও করত সে। এছাড়া কলেজ ক্যাম্পাসেও নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে বারবার আলোচনায় এসেছিল সে। তবুও তার কোন বিচার হয়নি। সে কারণে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে সাইফুর। তারা আরও বলেন, ছাত্রাবাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা ছাড়া বহিরাগত প্রায় ১০/১৫ জন ছিল। এরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড করলেও কলেজ কর্তৃপক্ষ এসব ব্যাপারে নির্বিকার থাকতো। এ বিষয়ে হোস্টেল সুপারকে অবগত করলেও তেমন কোনও লাভ হয়নি। যদি ওই সময়ে বহিরাগতসহ যারা নিয়ম না মেনে ছাত্রাবাসে বিশৃঙ্খলা করছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতো তাহলে ছাত্রাবাসের ভেতরে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটতো না।
এমসি কলেজের অধ্যক্ষ সালেহ আহমদ বলেন, পুলিশ বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন। এছাড়া অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে কলেজ ও ছাত্রাবাসে বিপুল সংখ্যাক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
শাহপরান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো: আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী জানান, ঘটনার পর থেকে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া আসামীদের গ্রেফতারের জন্য বিভাগজুড়ে অভিযান চলছে।
অভিযুক্ত ৬ জনের ৫ জনই বহিরাগত: গণধর্ষণে অভিযুক্ত ৬ জনের মধ্যে ৫ জনই বহিরাগত বলে জানিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। কয়েক বছর আগে তাদের ছাত্রত্ব বাতিল হলেও তারা কখনো মেসে আবার কখনো রাতের আঁধারে এসে কলেজ হোস্টেলে অবস্থান করতো। অভিযুক্ত ৬ জন হচ্ছে- কলেজ ছাত্রলীগ নেতা এম. সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেক আহমদ, অর্জুন লঙ্কর, রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান। একমাত্র মাহফুজুর রহমান ছাত্রাবাসে দ্বিতীয় ব্লকের আবাসিক ছাত্র। আর বাকিরা বহিরাগত। এ ঘটনার পর তার সিট সাময়িকভাবে বাতিল করা হয়েছে।
৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন: গণধর্ষণের ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে প্রধান করে এ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অপর ২ সদস্য হলেন-রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জীবন কৃৃষ্ণ (হোস্টেল সুপার শ্রীকান্ত ব্লক) ও অপর হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিন। কমিটিকে এক সপ্তাহের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। এম সি কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর সালেহ আহমদ এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ছাত্রাবাসের ২ গার্ড বরখাস্ত: গণধর্ষণের ঘটনায় হোস্টেলের ২ গার্ডকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। গতকাল শনিবার কলেজের একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় দায়িত্বে অবহেলার দায়ে তাদের দুজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তারা হচ্ছে সবুজ আহমদ রুহান ও রাসেল উদ্দিন।
প্রশাসনকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কঠোর বার্তা: গৃহবধূ (১৯) ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতারে প্রশাসনকে কঠোর বার্তা দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য ড. এ কে আব্দুল মোমেন।
আসামীদের গ্রেফতার ও শাস্তির আওতায় আনার জন্য সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া এবং র্যাবের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লে. কর্ণেল আবু মুসা মো. শরীফুল ইসলামের সাথে কথা বলেছেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অপরাধী যে দলেরই হোক, অপরাধ করলে শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে। একজন গৃহবধূকে ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠের ছাত্রাবাসে ধর্ষণ করে তারা কলেজকে কলুষিত করেছে। যার কারণে তাদের কোন ছাড় নেই। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত কর্মকর্তা শফিউল আলম জুয়েল।