নবীগঞ্জের ইউপি চেয়ারম্যান ইমদাদুর রহমান মুকুল বরখাস্ত

12

নবীগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
হতদরিদ্রদের তালিকা প্রণয়নে ব্যাপক অনিয়ম, নিয়ম বহির্ভূতভাবে ডিলারকে দিয়ে তালিকা প্রস্তুত করা, মৃত ব্যক্তির নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, একই ব্যক্তির নাম একাধিকবার, বরাদ্দকৃত চাল সঠিক ব্যক্তির কাছে বিতরণ না করার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ইমদাদুর রহমান মুকুলকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার বিভাগ ইউনিয়ন-২ শাখার উপসচিব মোহাম্মদ ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী গত ৭ জুলাই স্বাক্ষরিত স্মারক নং ৪৬.০০.০০০০.০১৭.০০২.২০২০ (অংশ-২)-৬৪৩ এর প্রজ্ঞাপন জারী করা হয়েছে।
অপর এক পত্রে কেন ইমদাদুর রহমান মুকুলকে চূড়ান্তভাবে অপসারণ করা হবে না মর্মে কারণদর্শাও নোটিশ প্রদান করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নে চেয়ারম্যান ইমদাদুর রহমান মুকুলের বিরুদ্ধে খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির হতদরিদ্রদের তালিকা প্রণয়নে ব্যাপক অনিয়ম, নিয়ম বহির্ভূতভাবে ডিলারকে দিয়েপ তালিকা প্রস্তুত করা, মৃত ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্তি, একই ব্যক্তির নাম একাধিকবার, বরাদ্দকৃত চাল সঠিক ব্যক্তির কাছে বিতরণ না করার অভিযোগ স্থানীয় তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে এবং জেলা প্রশাসক হবিগঞ্জে বর্ণিত ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর ৩৪ ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছেন।
যেহেতু নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমদাদুর রহমান মুকুল এর খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির হতদরিদ্রদের তালিকা প্রণয়নে ব্যাপক অনিয়ম, নিয়ম বহির্ভূতভাবে ডিলারকে দিয়ে তালিকা প্রস্তুত করা, মৃত ব্যক্তির নাম অন্তর্ভুক্তি, একই ব্যক্তির নাম একাধিকবার, বরাদ্দকৃত চাল সঠিক ব্যক্তির কাছে বিতরণ না করার অভিযোগ তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় তার দ্বারা ইউনিয়ন পরিষদের ক্ষমতা প্রয়োগ প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ সমীচীন নয় মর্মে সরকার মনে করে।
সেহেতু নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমদাদুর রহমান মুকুল কর্তৃক সংঘটিত অপরাধমূলক কার্যক্রম পরিষদসহ জনস্বার্থের পরিপন্থি বিবেচনায় স্থানীয় সরকার (ইউনিয়ন পরিষদ) আইন ২০০৯ এর ৩৪(১) অনুযায়ী চেয়ারম্যানকে স্বীয় পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হল।
এদিকে, ইউপি চেয়ারম্যান মুকুল বরখাস্তের খবর প্রচার হলে ভুক্তভোগীদের মধ্যে আনন্দ বিরাজ করছে।
অপর দিকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় স্থানীয় সরকার বিভাগ ইউনিয়ন-১ শাখা স্মারক নং ৪৬.০০.০০০০.০১৭.০০২.২০২০ (অংশ-২)-৬৪৪ এর কারণ দর্শাও নোটিশে বলা হয়েছে, খাদ্য বান্ধব কর্মসূচির হতদরিদ্রদের তালিকা প্রণয়নে ব্যাপক অনিয়ম, নিয়ম বহির্ভূতভাবে ডিলারকে দিয়ে তালিকা প্রস্তুত করা, মৃত ব্যক্তির নাম অন্তর্ভূক্তি, একই ব্যক্তির নাম একাধিকবার, বরাদ্দকৃত চাল সঠিক ব্যক্তির কাছে বিতরণ না করার অভিযোগ স্থানীয় তদন্তে প্রমাণিত জেলা প্রশাসক হবিগঞ্জের প্রস্তাব মোতাবেক জনস্বার্থে আপনাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কেন আপনাকে স্বীয় পদ থেকে চূড়ান্তভাবে অপসারণ করা হবে না তার জবাব পত্র প্রাপ্তির ১০ কার্যদিবসের মধ্যে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।
এ ব্যাপারে হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. কামরুল হাসান ইউপি চেয়ারম্যান মুকুলের বরখাস্তের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
উল্লেখ্য, নবীগঞ্জ উপজেলার গজনাইপুর ইউনিয়নে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির ১০ টাকা কেজি দরের চাল প্রাপ্তির তালিকায় মোট উপকারভোগী ১ হাজার ১৮৫ জনের নাম রয়েছে। ২০১৬ সালে ওই তালিকাটি প্রণয়ন করা হয়। তখন থেকে উপকারভোগীদের চাল পাওয়ার কথা থাকলেও অনেকেই এখনও পাননি সে সুবিধা। একটি অভিযোগের সত্যতা যাচাই করতে অনুসন্ধানে নেমে পাওয়া গেছে ব্যাপক অনিয়মের চিত্র।
তালিকা যাচাইয়ে দেখা যায়, কোন নাম ৪ বার, কোন ৩ বার করে তালিকায় রয়েছে। এদেরই একজন কুটি মিয়া। বাড়ি সাতাইহালে। তার নাম রয়েছে তালিকার ক্রমিক নং ৬৬৬, ৬৮০, ৭২০, ১০৭৩ অর্থাৎ ৪ বার। এরকম আরো অনেকের নাম আছে। একাধিকবার নাম প্রায় ৫০টির মতো রয়েছে তালিকায়। প্রাথমিক যাচাইয়ে পাওয়া গেছে এর সত্যতা। রয়েছে কয়েকজন মৃত ব্যক্তির নামও। কয়েকটি গ্রামে হিন্দু পরিবার না থাকলেও দেয়া হয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভুয়া নাম। তালিকায় রয়েছেন অথচ একবারও চাল পাননি, এমন লোকের সংখ্যাও অনেক।
আলোচিত এই তালিকাটিতে তারালিয়া গ্রামের প্রায় ২২ জনের নাম আছে তালিকায়, বাস্তবে চাল পায় ৩ জন। ৪৯৯ নং থেকে ৫০৮ পর্যন্ত সরকার সম্প্রদায়ের বেশ কয়েক জনের নাম রয়েছে সুবিধাভোগী হিসেবে। রাইধনী সরকার, বিজু সরকার নামের পাশে গ্রাম লেখা রয়েছে তারালিয়া।
তালিকাটি নিয়ে তারালিয়া গ্রামে গিয়ে জানা গেল- গ্রামটিতে গোপ সম্প্রদায়ের লোকজনের বসবাস। তালিকায় যে সরকার সম্প্রদায়ের নাম রয়েছে গ্রামবাসী কাউকেই চিনেন না। তাদের দাবী নামগুলো ভুয়া। ভুয়া নাম ব্যবহার করে সংশ্লিষ্টরা চাল আত্মসাৎ করেছেন এমনটাই অভিযোগ গ্রামবাসীর।
তালিকায় রয়েছে বেশ কয়েকজন মৃত ব্যক্তির নাম। তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথেও আলাপ করে জানা গেছে তারা জীবিত থাকতেও কোন সময় চাল পাননি, মারা যাবার পরও তারা জানেনই না যে তালিকায় নাম আছে।
যে গ্রামের নামে ইউনিয়নের নাম, সেই গজনাইপুর গ্রামে নেই কোন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকের বসবাস। ওই তালিকায় অনিয়মগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি অনিয়ম হিসেবে যেটা নিয়ে মানুষ সমালোচনা করছেন সেটা হলো- স্বামী মুসলমান-স্ত্রী হিন্দু, পুত্র হিন্দু- পিতা মুসলমান। অনেকেই হয়তো ভাবছেন এটা কি করে সম্ভব ? বাস্তবে এমন অসম্ভবকেও সম্ভব করা হয়েছে গজনাইপুর ইউনিয়নের এই তালিকায়। তালিকার ৫৮২ নং থাকা নাম আঃ আহাদ, পিতা: পিরিজা সরকার। ৫৮৬ নং মহেশ সরকার পিতা: সুনুজ উল্লা। ৫৯২ স্বরসতী সরকার, স্বামী আকবর মিয়া। অর্থাৎ এই পরিবারের দুই সম্প্রদায়ের লোক ! বাস্তবে না হলেও এই তালিকাতে এমটাই লেখা হয়েছে।
গজনাইপুর ইউনিয়নের কয়েকজন ইউপি সদস্যের সাথে আলাপকালে তারা বলেন, ইউপি চেয়ারম্যানের নির্দেশে তারা ৫০টি করে নাম দিয়েছেন। নিজ এলাকার ভূয়া নাম তালিকায় দেখে তারা হতবাক।
এ ব্যাপারে গজনাইপুর ইউপি চেয়ারম্যান ইমদাদুর রহমান মুকুল বলে ছিলেন, সকলের (সদস্যদের) সমন্বয়ের মাধ্যমেই করা হয়েছে এ তালিকা। তবে তালিকায় ত্র“টি রয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেছিলেন।