ভার্চুয়াল কোর্টের ৩৫ কার্যদিবসে জামিন আবেদন নিষ্পত্তি এক লাখ

40

কাজিরবাজার ডেস্ক :
মহামারী করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি হলেই উচ্চ আদালতসহ অধস্তন আদালতগুলোতে নিয়মিত বিচার কাজ শুরু হবে। একই সঙ্গে ঝুলে থাকা হেভিওয়েট মামলাগুলো আপীল ও ডেথ রেফারেন্স এর শুনানিও শুরু হবে। এদিকে গত ৩৫ কার্যদিবসে নিম্ন আদালতে প্রায় ১ লাখ জামিন আবেদন নিষ্পত্তি হয়েছে। প্রায় ৫০ হাজার আসামিকে জামিন দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে এখন থেকে অধস্তন আদালতে শুধু জামিন নয়, পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভার্চুয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করে দেশের দেওয়ানি, ফৌজদারি ও ট্রাইব্যুনালের মামলার কার্যক্রম চলবে। ভার্চুয়াল আদালতের পরিবর্তে নিয়মিত আদালত চালু করার জন্য সুপ্রীমকোর্টসহ সারাদেশের বার সমিতিগুলোতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির কাছে এ বিষয়ে আবেদনও করা হয়েছে। এদিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ভার্চুয়াল আইনটি স্থায়ী ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য নয়। স্বাভাবিক নিয়মে যে আদালত চলে সেটাকে সম্পূর্ণ বদলিয়ে এটা চালু করা হবে না।
ভার্চুয়াল আদালতের পরিবর্তে নিয়মিত আদালত চালু করার জন্য সুপ্রীমকোর্টসহ সারাদেশের বার সমিতিগুলোতে মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী মোমতাজউদ্দিন আহমদ মেহেদী দেশের ৬০ হাজার আইনজীবীর জীবন-জীবিকার স্বার্থে সুপ্রীমকোর্টসহ দেশের সব আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম চালু করে দিতে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের কাছে আবেদন করেছেন। তিনি সুপ্রীমকোর্টেও এ বিষয়ে মানববন্ধন করেছেন। পাশাপাশি অন্যান্য বার সমিতিতে নিয়মিত আদালত চালুর জন্য মানববন্ধন করা হয়েছে।
আইনজীবীদের একটি অংশ বলেছে ইতোমধ্যে করোনাভাইরাসে প্রায় ৪০ জন বিচারক আক্রান্ত হয়েছেন। একই সঙ্গে আইনজীবীদের একটি বড় অংশ করোনায় আক্রান্ত। এমতাবস্থায় নিয়মিত আদালত চালু হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যাবে। সুপ্রীমকোর্ট সূত্রে জানা গেছে, ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে আদালতে বিচার কাজ পরিচালনা ও দায়িত্ব পালনের সময় সারাদেশে এ পর্যন্ত অধস্তন আদালতের ৪০ বিচারকসহ মোট ২২১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এছাড়া সুপ্রীমকোর্টের ৪৫ কর্মচারী ও অধস্তন আদালতের ১৩৬ কর্মচারীও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সুপ্রীমকোর্ট। অধস্তন আদালতে এখন জামিনের পাশাপাশি সিভিল মামলাও ফাইল করা যাবে। এতদিন অধস্তন আদালতে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে জামিনের উপর শুনানি হতো। করোনা পরিস্থিতিতে ভার্চুয়াল আদালতের কার্যক্রম ইতোমধ্যে তরুণ আইনজীবীদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। যদিও অনেকে বলছেন, আইনজীবীদের প্রশিক্ষণ খুবই জরুরী।
এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ভার্চুয়াল কোর্টের আইনটি স্থায়ী ব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য নয়। আদালত প্রচলিত ভাবেই চলবে। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবে আদালতের কাজ পরিচালনা করা যায় না। তখন ভার্চুয়াল আইনের সহায়তা নেয়া হয়। আইনজীবীদের এতে কাজের কোন ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। ভার্চুয়াল আদালত না থাকলে করোনা পরিস্থিতিতে কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতা যেখানে ৪০ হাজার সেখানে আসামি ৯০ হাজার হয়েছিল। করোনা যদি সেখানে হতো তা হলে অবস্থাটা কি দাঁড়াত। এসব বিশেষ পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য ভার্চুয়াল আদালত করা হয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মে যে আদালত চলে সেটাকে সম্পূর্ণ বদলিয়ে দিয়ে এটা চালু করা হবে না। এর আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, সরকার ভার্চুয়াল আদালত অধ্যাদেশকে একটি স্থায়ী আইনে পরিণত করতে যাচ্ছে এবং খুব শীঘ্রই এটি কার্যকর করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এই আইন পাস হলে কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনা করা যাবে এবং এর ফলে মামলা নিষ্পত্তিতে অর্থ ও সময় উভয়ই কম ব্যয় হবে। মানবাধিকার এবং কোভিড-১৯ পরবর্তী সামাজিক নিয়ম-নীতির প্রতিফলন শীর্ষক জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচীর (ইউএনডিপি) বার্ষিক সভা-২০২০ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি আলোচক হিসেবে যুক্ত হয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এসব কথা বলেন।
সুপ্রীমকোর্টের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক বলেছেন, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেই উচ্চ আদালতসহ নিম্ন আদালতে নিয়মিত বিচার কাজ চলবে। বর্তমানে আপীল বিভাগের চেম্বার জজ ২৮ জুলাই পর্যন্ত ভার্চুয়াল আদালতের সময় বাড়িয়েছেন। হাইকোর্টে আগের নিয়মই আছে। অন্যদিকে নিম্ন আদালতে এখন জামিনের শুনানির পাশাপাশি সিভিল মামলাও ফাইল করা যাবে।
গত ২৮ জুন থেকে ২ জুলাই পর্যন্ত সারাদেশে অধস্তন আদালতে ভার্চুয়াল শুনানিতে ১০,৮৬৬টি জামিন দরখাস্ত নিষ্পত্তি এবং ৪,৯৬০ জন আসামির জামিন মঞ্জুর হয়েছে। ১১ মে থেকে ২ জুলাই, পর্যন্ত মোট ৩৫ কার্যদিবসে সারাদেশে অধস্তন আদালতে ভার্চুয়াল শুনানিতে মোট ৯৫,৫২৩টি জামিন-দরখাস্ত নিষ্পত্তি এবং ৪৯,৭৫০ জন আসামির জামিন মঞ্জুর হয়েছে। (শিশু আদালত সহ) ২ জুলাই থেকে ৩৫ কার্যদিবসে ভার্চুয়াল শুনানিতে মোট জামিন প্রাপ্ত শিশুর সংখ্যা ৬০৮ জন। এ পর্যন্ত সমাজসেবা অধিদফতর এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশ এর সহায়তায় আভিভাবকের কাছে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে ৫৮৩ শিশুকে।
পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ভার্চুয়াল কোর্টে শুনানির জন্য সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। করোনা সঙ্কট কেটে গেলে উচ্চ আদালতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ পিটিশনের শুনানি, হলি আর্টিজান মামলার জেল আপীল, ফেনীর সোনাগাজী ফাজিল মাদ্রাসার শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ডাদেশ অনুমোদন) ও আসামিদের করা আপীল এবং জেল আপীল, মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী ও কায়সার বাহিনীর প্রধান সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার ও এটিএম আজাহারুল ইসলামের দন্ডের বিরুদ্ধে রিভিউ করা হবে। এ ছাড়া বিডিআর হত্যা মামলায় হাইকোর্টেও রায়ের বিরুদ্ধে আসামীরা আপীল, রমনার বটমূলে বোমা বিস্ফোরণ মামলা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, নারায়ণগঞ্জ সাত খুনের মামলা, চট্টগ্রামে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলা, হরতালের সময় বিশ্বজিৎ হত্যা মামলা, টঙ্গীর আহসান উল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলা, রাজন হত্যা মামলা, রবি হত্যা মামলা, কোটালিপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখার মামলাসহ গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর কয়েকটি মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামির আপীল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
আইনজীবী মোমতাজউদ্দিন আহমদ মেহেদী আবেদনে বলেন, বিগত তিন মাস নিয়মিত কোর্ট করতে না পারায় অধিকাংশ আইনজীবী চরম অর্থ সঙ্কটে পড়েছেন এবং বিচারপ্রার্থী জনগণের চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। ইতোমধ্যে সরকার ভার্চুয়াল বিচার ব্যবস্থা চালু করেছে। বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ আইনজীবী প্রশিক্ষণ না থাকায় এবং ইন্টারনেট সুবিধার অভাবে ভার্চুয়াল কোর্টে মামলা করতে পারছেন না। অধিকাংশ আইনজীবীর সঞ্চিত টাকা নেই। জীবন তো আর থেমে থাকতে পারে না এবং জীবিকা ছাড়া জীবন অচল। তাই প্রধান বিচারপতির কাছে দেশের সব আদালত খুলে দিতে অনুরোধ জানাচ্ছি। করোনা ভাইরাসজনিত উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থী জনগণ যাতে এই ভাইরাসে আক্রান্ত না হন সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি ও হাইকোর্টের প্র্যাকটিস ডাইরেকশন অনুসরণ করে গত ১১ মে থেকে সুপ্রীমকোর্ট ও অধস্তন আদালতে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিচার কাজ পরিচালনার নির্দেশনা দেয়া হয়। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নির্দেশে ভার্চুয়াল কোর্টের মেয়াদ কয়েক ধাপে বাড়ানো হয়।