কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভালো নেই বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দলটির প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর থেকেই জাপার রাজনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় শূন্যের খাতায়। নেতাকর্মীরা বলছেন, একদিকে নেতৃত্বের কোন্দল। তিন ভাগে বিভক্ত জাপার কেন্দ্রীয় রাজনীতি। সারাদেশে সাংগঠনিক কার্যক্রম একেবারেই বেহাল। ৪০টির বেশি সাংগঠনিক জেলায় কমিটি নেই বছরের পর বছর। তৃণমূল পর্যন্ত সংগঠন এখন অস্তিত্বহীন বলা চলে। অন্যদিকে যোগ্য নেতৃত্বের অভাব তো আছেই। কর্মসূচীর অভাবে দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম একেবারে ‘নাই’ হয়ে গেছে। সব মিলিয়ে বেহাল দশা নিয়ে নামকাওয়াস্তে টিকে আছে সাবেক সামরিক শাসকের গড়া এ দল। যদিও করোনা সঙ্কটের দোহাই দিয়ে সংগঠন ভাল আছে এমন সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা শীর্ষ নেতাদের।
অথচ আগামী ১৪ জুলাই এরশাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নানা কর্মসূচী হাতে নিয়েছে জাতীয় পার্টি। শীর্ষ নেতৃত্বে কোন্দলের কারণে এই কর্মসূচী কতটা ফলপ্রসূ হবে এ নিয়েও সন্দেহ আছে অনেক নেতার। তাছাড়া এরশাদের মৃত্যুর এক বছরের মাথায় জাপার সাংগঠনিক অবস্থা চরম বেহাল হওয়ায় অনেকে হতাশা প্রকাশ করেছেন।
এরশাদের অবর্তমানে কেমন চলছে জাতীয় পার্টি। এ নিয়ে দলের অন্তত এক ডজন নেতার সঙ্গে কথা হয়। কথা হয় সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে অন্তত ২০ কর্মীর সঙ্গেও। তারা বলছেন, বছরের পর বছর কোন রকম দলীয় কর্মকান্ড না থাকায় বর্তমানে ৯০ শতাংশ নেতাকর্মীই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছেন। অথচ সংসদে বিরোধী দল হিসেবে দীর্ঘ সময় পাড়ি দিচ্ছে জাতীয় পার্টি। অথচ সুসময়ে দলকে চাঙ্গা করার উদ্যোগ নেই কোন পক্ষ থেকেই। বিরোধী দলের এমন শোচনীয় অবস্থা দেশে আর আগে কেউ হয়ত দেখেনি।
নেতাকর্মীরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের প্রভাব কেটে গেলেও তাদের অনেককেই আর দলের রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দেখা যাবে না। বড় একটি অংশ দলছুটও হতে পারেন। নেতৃত্বের সঙ্কট ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। তারা মনে করছেন, বর্তমান নেতৃত্বের হাত ধরে এই দলের নিজস্ব শক্তিতে টিকে থাকা হবে কষ্টসাধ্য। টিকে থাকলেও তা হবে নামসর্বস্ব।
দলের কয়েকজন প্রেসিডিয়াম সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এরশাদের মৃত্যুর পর জাপার কান্ডারি হতে চেয়েছিলেন তার স্ত্রী রওশন। কিন্তু ভাই জিএম কাদেরকে এরশাদ নিজেই ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দিয়ে যান। এরপর কাউন্সিলে জিএম কাদের আনুষ্ঠানিক চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সম্মেলনে করা নতুন কমিটিতে রওশনপন্থী অনেক সিনিয়র নেতাই স্থান পাননি। পরে তাদের অনেকেই যোগ দেন রওশনের পক্ষে। বাবার মৃত্যুর পর এরশাদের অপর পুত্র এরিখ ছিলেন বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে। জমি সম্পদ এরশাদ ট্রাস্টের নামে দিয়ে গেলেও এ নিয়ে জটিলতা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট পার্কে এরিখের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন মা বিদিশা। ফলে বিদিশার সঙ্গে জাপার বঞ্চিত একটি অংশ যোগ দেয়।
সম্প্রতি এরিখের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে তাদের প্রেসিডেন্ট পার্কে দেখা গেছে। আবার এরশাদের রংপুরের আসনে নির্বাচন করে পাস করা ‘সাদ’ সম্প্রতি রংপুরের পল্লী নিবাসে দলীয় নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন। এ নিয়ে পার্টিতে চলছে তুমুল দ্বন্দ্ব। চলছে বহিষ্কার আর পাল্টা বহিষ্কার। রংপুরের দুর্গ হিসেবে পরিচিত জাপার রাজনীতি এখন ভেঙ্গে খান খান। গোটা উত্তরাঞ্চলের চিত্র একই রকম বলা চলে। সব মিলিয়ে তিন ধারার রাজনীতিতে জাপার মেরুদন্ড বাঁকা হওয়ার দশা।
দলটির নেতারা বলছেন, এরশাদের মৃত্যুর পর দল পরিচালনাকে কেন্দ্র করে সঙ্কটের শুরু। শেষ পর্যন্ত রওশন এরশাদ সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা আর জি এম কাদের পার্টির চেয়ারম্যান পদ মেনে নিতে সম্মত হলে ভাঙ্গন ঠেকে। তবে সাংগঠনিকভাবে দলটি আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। দুর্বল সংগঠনকে চাঙ্গা করতে নতুন করে কোন পদক্ষেপও নিতে দেখা যায়নি।
শীর্ষ কয়েক নেতা বলছেন, দলের ৯০ শতাংশ নেতাকর্মীই এখন নিষ্ক্রিয়। বনানী ও কাকরাইল অফিসে লোকজনের এখন আর ভিড় নেই। মাঝে মাঝে অফিস খোলা হলেও নেতাকর্মীরা খুব একটা আসেন না। যে কজন আসেন তারা নিজেরা যোগাযোগ করে এসে আড্ডা দেন। তার ওপর দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে নেতাকর্মীদের কোন যোগাযোগ নেই।
নেতাকর্মীরা বলছেন, দলের ২২ জন নির্বাচিত ও চার জন সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্যের কেউ সাংগঠনিক দায়িত্ব নিতে চান না। তাদের সঙ্গেও নেতাকর্মীদের দূরত্ব রয়েছে। তারা বিরোধী দলীয় সংসদ সদস্য হিসেবে সুযোগ-সুবিধা নিয়েই ব্যস্ত। অভিযোগ আছে, আসন ভাগাভাগি আর মনোনয়নের চক্করে নেতাকর্মীদের সঙ্গে পার্টি চেয়ারম্যান-মহাসচিবও খুব একটা যোগাযোগ রাখেন না। ফলে দেশব্যাপী করোনা ভাইরাস মহামারী চললেও জাতীয় পার্টি তেমন কোন ভূমিকাই রাখতে পারছেন না। যদিও এ নিয়ে দলের কোন মাথাব্যথাও নেই।
এদিকে, রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্ব এখনও চলমান। দেবর-ভাবির ঠান্ডা লড়াই এখনও প্রশমিত হয়নি। জানা গেছে, দলের শীর্ষ এই দুই নেতা নিজ নিজ বলয়ের মধ্যেই থাকেন। তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গাও। তিনিও নিজের মতো করে একটি বলয় নিয়ে চলেন। এতে করে সাধারণ নেতাকর্মীরা দলের মধ্যে দল খুঁজে পান না। তাতে করে তারা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছেন।
জাপার এক নেতা বলেন, দলের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ। এরশাদ যখন ছিলেন, তিনি যেভাবেই হোক, যে কোন কর্মসূচী বা আয়োজনকে সামনে রেখে অর্থ জোগাড় করে ফেলতেন। দলের প্রয়োজনেও খুব একটা হাত খোলেন না কেউ। ফলে দলের কর্মসূচী না থাকার পেছনে আর্থিক সক্ষমতার অভাবটাও ভূমিকা রাখে। পার্টির চেয়ারম্যান ইচ্ছা করলেই কিছু করতে পারেন না টাকার অভাবে।
বর্তমান পরিস্থিতির মতো জাতীয় পার্টি ‘ধুঁকে ধুঁকে’ কতদিন চলবে, তা নিয়েই শঙ্কা অনেকের। তারা বলছেন, দলের শীর্ষ ১০/১২ জন নেতা বিএনপির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। আর শীর্ষ নেতৃত্ব ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে চলছে। এ অবস্থায় করোনাভাইরাসের প্রকোপ কমার পর দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে রাজনৈতিক কর্মকান্ড যখন শুরু হবে, তখন অনেক নেতাই দলছুট হতে পারেন। তাদের সঙ্গে ছুটবেন অনুসারীরাও।
জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, জাপার প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এরশাদ বেঁচে থাকতেই দলের ভাঙ্গন প্রকাশ্য হয়েছিল। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে কাকে অগ্রাধিকার দেবেন, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। আর ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে দল তো প্রায় দুই ভাগই হয়ে গিয়েছিল। এরশাদ সুতো হয়ে জোড়া লাগিয়ে রেখেছিলেন। এখন তার অবর্তমানে এই দল হয়তো এভাবেই আধা সক্রিয় হয়ে চলবে।
জানতে চাইলে দলের নানা ধরনের দুর্বলতার কথা স্বীকার করেন নেন প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। তিনি বলেন, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আজ নেই। কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অভাব অনুভূত হচ্ছে। তিনি যেভাবে দলকে আগলে রাখতেন, তেমনভাবে দলকে আগলে রাখার কেউ নেই। ফলে দলের নিয়মিত সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রেই নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে।
তিনি বলেন, দল চালানোর জন্য শীর্ষ নেতাকে তো নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। প্রয়োজনে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হয়, প্রয়োজনে নরম হতে হয়। এরশাদ বেঁচে থাকতে পরিস্থিতি বুঝে সেভাবে কাজ আদায় করে নিতেন। তার মতো করে আসলে দলের জন্য সিদ্ধান্ত কেউ নিতে পারছেন না।
অপর প্রেসিডিয়াম সদস্য মীর আবদুস সবুর আসুদ বলেন, করোনা সঙ্কটের কারণে রাজনীতি বলতে দেশে কিছু নেই। সব কিছু স্থবির। আমি মনে করি জাতীয় পার্টিকে মানুষ ভালবাসে। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে দল ঘুরে দাঁড়াবে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের সঙ্গে। তিনি অবশ্য এসব অভিযোগ-সঙ্কটকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, এখন তো করোনা ভাইরাসের কারণে সব দলের অবস্থাই খারাপ। সব দলই তো সাংগঠনিক কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক কার্যক্রমও করোনা পরিস্থিতির কারণে স্থবির হয়ে পড়েছে। এটি বড় সমস্যা নয়। করোনা কেটে গেলে আমরা আবার আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রমকে শক্তিশালী করব।
১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকী : আগামী ১৪ জুলাই জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে- করোনা সংক্রমণজনিত বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার দল। মৃত্যুবার্ষিকী পালনে দলের চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের এমপি- পার্টির মহাসচিব মোঃ মসিউর রহমান রাঙ্গা এমপিকে আহ্বায়ক এবং প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপিকে সদস্য সচিব করে একটি কমিটি গঠন করেছেন। তারা এই কমিটিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য অন্তর্ভুক্ত করবেন।
১৪ জুলাই কর্মসূচীর মধ্যে থাকবে, সারাদেশে জাতীয় পার্টির সকল কার্যালয়ে দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা, সকল দলীয় কার্যালয়ে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত কোরআন তেলাওয়াত, এরশাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া মাহফিল এবং আলোচনা সভা, কবর জিয়ারত প্রভৃতি।