কাজিরবাজার ডেস্ক :
উচ্চ আদালতে আইনজীবীদের ই-মেলে আবেদনের মাধ্যমে ভার্চুয়াল কোর্টের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। সোমবার আইনজীবীগণ ইমেইলের মাধ্যমে আবেদন শুরু করেছেন। অনলাইনের মাধ্যমে আইনজীবীরা তাদের মক্কেলের জামিন চেয়ে আবেদন করছেন। এর মধ্য দিয়ে নতুন এক ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করছে দেশের বিচার ব্যবস্থা। শুরু হলো ভার্চুয়াল কোর্টের যাত্রা। আজ মঙ্গলবার থেকে শুরু হতে পারে উচ্চ আদালতে ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে শুনানি। এদিকে আইনজীবীগণ এ পদ্ধতিকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে অতি জরুরী বিষয়গুলোর শুনানি হবে। আদালত দীর্ঘদিন করোনা ভাইরাসের কারণে বন্ধ রয়েছে। ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে শুনানি হলে বিচারপ্রার্থীরা খুবই উপকৃত হবেন। ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনা আইন একটি যুগান্তকারী আইন। অন্যদিকে অধস্তন আদালতে ভার্চুয়াল কার্যক্রম পরিচালনার পদ্ধতি সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করেছে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন।
সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন ২১ দফা ‘বিশেষ প্র্যাকটিস নির্দেশনায়’ অধস্তন আদালতের জামিন শুনানির পদ্ধতি বর্ণনা করেছে। পাশাপাশি ইউএনডিপির উদ্যোগে ভার্চুয়াল কোর্ট বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের আইন কর্মকর্তাদের নিয়ে এক ভার্চুয়াল প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভার্চুয়াল উপস্থিতির মাধ্যমে আপীল বিভাগ ও হাইকোর্টের তিনটি বেঞ্চে আবেদন দেয়ার জন্য ই-মেল দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে বেশ কিছু আবেদন পড়েছে বলে জানা গেছে।
আপীল বিভাগের বিচারপতি মোঃ নুরুজ্জামানকে চেম্বার জজ হিসেবে মনোনীত করা হয়েছে। তিনি ১৪ ও ২০ মে বেলা সাড়ে ১১টায় শুনানি নেবেন। এই বেঞ্চে জরুরী ভিত্তিতে শুনানির জন্য আবেদন করতে পারবেন chamberjudge@ gmail.com| অন্যদিকে হাইকোর্টের বেঞ্চ তিনটি হলো- বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের একটি বেঞ্চ। যেখানে অতীব জরুরী সকল প্রকার রিট ও দেওয়ানি মোশন এবং এ সংক্রান্ত আবেদনপত্র গ্রহণ করা হবে। courtannex19@ gmail.com| বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চে অতীব জরুরী সকল প্রকার ফৌজদারি মোশন এবং ওই সংক্রান্ত জামিনের আবেদন নেয়া হবে। courtannex5@ gmail.com| বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের বেঞ্চে অন্যান্য মামলার শুনানির জন্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এই সমস্ত ই-মেলে আবেদন করা যাবে।
ভার্চুয়ালকোর্ট প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার উদ্দেশে প্রণীত ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ, ২০২০’ তথা ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনা আইন একটি যুগান্তকারী আইন। এটি বাংলাদেশকে আরও একটি নতুন অধ্যায়ে সূচিত করার আইন। অন্যদিকে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহম্মেদ বলেছেন, যেগুলো জরুরী ভিত্তিতে শোনার প্রয়োজন আদালত তা শুনবে। করোনাভাইরাসের সময় এই পদ্ধতিটি খুবই ভাল পদক্ষেপ। এতে করে বিচারপ্রার্থী জনগণ অনেকাংশে উপকৃত হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, সরকারের এ উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। অবশ্যই এটি ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ। এটি আরও আগে হওয়া উচিত ছিল। দেরিতে হলেও এটি একটি ভাল উদ্যোগ বলে আমি মনে করি। কেননা করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ধরে আদালত বন্ধ। মনে হচ্ছে দেশে কোন আদালতই নেই।
হাইকোর্টের নির্ধারিত বেঞ্চে মক্কেলদের পক্ষে কয়েকজন আইনজীবী আবেদন করেন। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত হাইকোর্টের নির্ধারিত বেঞ্চে খবর নিয়ে জানা যায়, সংশ্লিষ্ট কোর্টে একাধিক জামিন আবেদন জমা পড়েছে। হাইকোর্টে বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চে তিনটি জামিন আবেদন জমা পড়েছে। আইনজীবী দেওয়ান মোঃ আবু ওবায়েদ হোসেন জানান, প্রত্যেকটা জামিনই জরুরী। কিন্তু এক বছর ধরে আমার মক্কেল কারাগারে। তার জামিন দরকার। এ জামিন আবেদন আগেও করেছিলাম। কিন্তু তখন শুনানি হয়নি। ভার্চুয়াল কোর্টের বিষয়ে তিনি বলেন, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে আগে থেকে এটি ছিল। এটা সময়ের দাবি। আমরা একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে শুরু করেছি। এটা ভাল উদ্যোগ। ঢাকা জজকোর্টের মহানগরের পিপি আব্দুল্লাহ আবু বলেছেন, জজকোর্টে এই প্রক্রিয়া এখনও শুরু হয়নি। পত্রিকায় দেখেছি দুই এক দিনের মধ্যেই এই পদ্ধতিতে শুনানি শুরু হবে।
করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতে সাধারণ ছুটিতে আদালত বন্ধ রেখে গত ২৬ এপ্রিল ভার্চুয়াল কোর্ট চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়। এ জন্য সুপ্রীমকোর্টের রুলস কমিটি পুনরায় গঠন এবং ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ওইদিন প্রথমবারের ভিডিও কনফারেন্সে প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে ফুলকোর্ট সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়। এ অবস্থায় গত ৬ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গণভবনে মন্ত্রী সভার বৈঠকে ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০’ এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়। এর ২দিন পর ৯ মে ভার্চুয়াল কোর্ট সম্পর্কিত অধ্যাদেশ জারি করা হয়। অধ্যাদেশে বলা হয়, সুপ্রীমকোর্টের আপীল বিভাগ বা ক্ষেত্রমতে হাইকোর্ট বিভাগ, সময় সময়, প্র্যাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) জারি করতে পারবে।
এদিকে ইউএনডিপির উদ্যোগে রবিবার ভার্চুয়াল কোর্ট বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের আইন কর্মকর্তাদের নিয়ে এক ভার্চুয়াল প্রশিক্ষণ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। এই ভার্চুয়াল সভায় সভাপতিত্ব করেন আপীল বিভাগের বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী। ভার্চুয়াল সভায় অংশগ্রহণ করেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম, বিচারপতি খুরশিদ আলম সরকার, এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম, অতিরিক্ত এ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা, অতিরিক্ত এ্যাটর্নি মোমতাজ উদ্দিন ফকির, ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ, একেএম আমিন উদ্দিন মানিক, মোঃ বশির উল্লাহ, বশির আহমেদ, প্রতিকার চাকমা, জাহাঙ্গীর হোসেন, সমরেন্দ্র নাথ বিশ্বাসসহ ১১ জন ডিএজি ও বেশকিছু এএজিসহ সর্বমোট ৩১ জন।
অন্যদিকে অধস্তন আদালতে ভার্চ্যুয়ালি কার্যক্রম পরিচালনার পদ্ধতি সংক্রান্ত নির্দেশনা জারি করেছে সুপ্রীমকোর্ট প্রশাসন। ২১ দফা ‘বিশেষ প্র্যাকটিস নির্দেশনায়’ অধস্তন আদালতের জামিন শুনানির পদ্ধতি বর্ণনা করা হয়। আদালত কর্তৃক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০ এর ৫ ধারার ক্ষমতাবলে করোনায় নিরাপদ শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিতকল্পে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল মোঃ আকবর আলী স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এই নির্দেশনা জারি করা হয়।
নির্দেশনায় বলা হয়, অধস্তন আদালতে শুধু ভার্চ্যুয়ালি জামিন সংক্রান্ত বিষয়ে শুনানি হবে। যোগাযোগের জন্য প্রত্যেক আদালতের একটি ই-মেল আইডি ও নিজস্ব ফোন নম্বর থাকবে, যা আইনজীবী সমিতিকে সরবরাহ করতে হবে। জামিন শুনানির জন্য দালিলিক কাগজপত্রাদি এবং ওকালতনামা আদালতের নির্ধারিত ই-মেল আইডিতে ই-ফাইলিংয়ের মাধ্যমে জামিনের আবেদন দাখিল করতে পারবেন। নির্দেশনায় আরও বলা হয়, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শুনানি আদালত চলাকালে অনুষ্ঠিত হবে। শুনানি গ্রহণ, শুনানির তারিখ ও সময় অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ব্যবহৃত হবে ও কজলিস্টের পোর্টালে থাকবে, যা মোবাইল ও ই-মেলের মাধ্যমে উভয়পক্ষের কৌঁসুলিকে অবহিত করতে হবে।
গৃহীত আবেদনের ওপর একটি ভিডিও কনফারেন্সিং কেস নং (ভিসি কেস নং) ব্যবহৃত হবে এবং পরবর্তী সব প্রয়োজনে এই নম্বর ব্যবহৃত হবে। আবেদন গৃহীত হওয়ার পর আবেদনকারী অথবা তার আইনজীবী আদালতে ও প্রতিপক্ষের ই-মেলে ২৪ ঘণ্টা আগে ইমেজ আকারে ১০ এমবির মধ্যে পাঠানো হবে। আদালত কর্তৃক নির্ধারিত ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম জুম, গুগল মিট বা মাইক্রোসফট টিম ব্যবহার করে উভয়পক্ষের আইনজীবী শুনানিতে অংশ নেবেন। শুনানির ১৫ মিনিট আগে আইনজীবী ও প্রয়োজনে তার সহায়ক আইনজীবী আদালতের কার্যক্রমে অংশ নেবেন। ভিডিও কন্ট্রোলরুম থেকে ১৫ মিনিট ভিডিও কনফারেন্সিং ব্যবস্থার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হবে।
শুনানিকালে স্ক্রিন শেয়ার অপশন থেকে গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট শেয়ার করতে হবে এবং মামলা সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র সংযুক্তি আকারে আদালতের ই-মেলে পাঠাতে হবে, যার একটি কপি প্রতিপক্ষের আাইনজীবীকেও দিতে হবে। শুনানির ফল তাৎক্ষণিকভাবে জানানো সম্ভব না হলে ই-মেলে ও খুদে বার্তার মাধ্যমে উভয়পক্ষের আইনজীবীকে জানাতে হবে।
জামিন হলে বন্ড ও রিলিজ অর্ডার পূরণ করে স্ক্যানকপি আদালতের ই-মেলে পাঠাতে হবে। বিচারক বেল বন্ড ও রিলিজ অর্ডার এক কপি প্রিন্ট করে অফিসিয়াল ফাইলে সংগ্রহ করবেন। আর এক কপি জেল সুপারের অফিসিয়াল মেলে পাঠাবেন।