কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশের অদক্ষ সকল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার আদেশ দিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। বিদ্যুতের দাম নির্ধারণের আদেশে কমিশন বলছে ৩১ বছর অতিক্রান্ত হলেও সরকারী বিদ্যুত কেন্দ্র চলছে। উৎপাদনে অদক্ষ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে বিবেচনায় কমিশন বলছে এসব কেন্দ্র বন্ধ করে দিতে হবে। একই সঙ্গে বিদ্যুত ক্রয় চুক্তি শেষ হওয়ার পর চুক্তি নবায়ন না করার পাশাপাশি কেন্দ্রগুলোকে অবসরে পাঠানোর নির্দেশও দিয়েছে কমিশন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন পিডিবির অদক্ষ ব্যবস্থাপনার জন্যই এবার বিদ্যুতের দাম বেড়েছে। কমিশনের এই আদেশে তারই প্রতিফলন ঘটেছে।
বিইআরসি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল জানান, আমরা স্পষ্টভাবেই বলেছি চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আর নতুন করে তা নবায়ন করা যাবে না। এছাড়া কমিশন যেখানে গ্যাসের সরবরাহ ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে তরল জ¦ালানি নির্ভর বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ না করার পরামর্শ দিয়েছে।
কমিশন আদেশ দিলেও পিডিবির কাছে বরাবরই তা গুরুত্বহীন। এর আগে ২০১৭ সালে কমিশন দাম বৃদ্ধির আদেশের সঙ্গে ১৪০ মেগাওয়াটের চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের আদেশ দিয়েছিল। কিন্তু পিডিবি সেই আদেশ বাস্তবায়ন করেনি। কমিশন বলছে হাইলি ইনএফিশিয়েন্ট বা অতি মাত্রায় অদক্ষ বিবেচনায় চার বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করতে বলা হয়েছিল। কেন্দ্র চারটি হচ্ছে ভেড়ামারা-৬০ মেগাওয়াট, সৈয়দপুর-২০ মেগাওয়াট, রংপুর-২০ মেগাওয়াট এবং বরিশাল-৪০ মেগাওয়াট। বছরের বেশিরভাগ সময় কেন্দ্র চারটি কোন বিদ্যুৎ উৎপাদন করে না। এর সবগুলো বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেশি। এরপরও কেন্দ্রগুলো অবসরে দেয়া হচ্ছে না।
কেন কেন্দ্রগুলো অবসরে দেয়া হচ্ছে না জানতে চাইলে পিডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, কেন্দ্রগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে যারা চাকরি করছেন তাদের কি হবে এই বিবেচনাই কেন্দ্রগুলো বন্ধ করা হচ্ছে না। তিনি স্বীকার করেন অদক্ষ এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে আলোচনা হলেও ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে পিডিবি। বিষয়টির সঙ্গে পিডিবির শ্রমিক রাজনীতি সম্পৃক্ত।
পিডিবি সূত্র বলছে, সরকারের তরফ থেকেও বার বার এসব কেন্দ্র বন্ধ করে দেয়ার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে পিডিবির গাফিলতি রয়েছে। পুরাতন কেন্দ্রকে নানাভাবে পিডিবির এক শ্রেণীর কর্মকর্তা ব্যবসার হাতিয়ার বানানোর চেষ্টা করেন। একটি পুরাতন কেন্দ্র ওভারহোলিং বা সংরক্ষণের জন্য বছরে যে পরিমাণ ব্যয় দেখানো সম্ভব নতুন কেন্দ্রের জন্য তা সম্ভব নয়। কেন্দ্রগুলো সংস্কারের কথা বলে বছরে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়া খুব সহজ। সঙ্গত কারণে কেন্দ্রগুলো বন্ধ হলে পিডিবির শীর্ষ কোন কোন কর্মকর্তার ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে এই বিবেচনায়ও পুরাতন কেন্দ্র বন্ধ করতে চায় না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন শ্রমিকরা চাকরি হারানোর ভয়ে আর কর্মকর্তারা বাড়তি আয় বন্ধের শঙ্কায় এসব কেন্দ্র বন্ধ করার পক্ষে নন।
এর বাইরে আরও এক হাজার ২৯৪ মেগাওয়াট সরকারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রর বিষয়ে কমিশন পর্যালোচনা দিয়েছে তাতে দেখা গেছে এসব কেন্দ্রের বয়স ৩১ বছর পেরিয়ে গেছে। এরপরও কেন্দ্রগুলো চালানো হচ্ছে। অতিপুরাতন এসব কেন্দ্র বন্ধের বিষয়েও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।
এসব কেন্দ্রের মধ্যে ঘোড়াশালের চারটি ইউনিট রয়েছে। চারটি সরকারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ৫৩০ মেগাওয়াট। চারটি ইউনিটই সিম্পল সাইকেল। চারটি ইউনিটের মধ্যে ঘোড়াশাল-১ এবং ২ নাম্বার ইউনিটের আয়ুস্কাল বহু আগে শেষ হয়েছে। ফলে ইউনিট দুটিকে অবসরে পাঠানো উচিত বলে মনে করছে কমিশন। এর বাইরে অন্য ৩ এবং ৪ নাম্বার ইউনিট রিপেয়ারিং বা সংস্কার করে কম্বাইন্ড সাইকেলে রূপান্তর করা হচ্ছে।
এর বাইরে আশুগঞ্জের ৫টি বিদ্যুৎ ইউনিট রয়েছে। যে কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ পর্যায়ক্রমে ২০২৩ সালের মধ্যে শেষ হবে। কেন্দ্রগুলোর মেয়াদ শেষ হচ্ছে যথাক্রমে ১৭ ডিসেম্বর ২০২১, ৫ এপ্রিল ২০২২ এবং ২১ মার্চ ২০২৩। কমিশন বলছে ক্রয় চুক্তি শেষ হওয়ার পর কেন্দ্রগুলোকে অবসরে পাঠাতে হবে।
সরকারী হিসেব মতে দেশে বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ২৩ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গ্রীষ্মে চাহিদা হতে পারে সর্বোচ্চ ১৩ হাজার মেগাওয়াট। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে ১০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশি রয়েছে। এই কেন্দ্রগুলো না চালালেও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট ঠিকই পরিশোধ করতে হয়।
বিইআরসি সদস্য রহমান মুর্শেদ বলছেন, এবার যে কারণে দাম বেড়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট। উৎপাদন না করেও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দেয়ার কারণে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। এতে করে দাম বাড়ানোর প্রয়োজন পড়েছে।
পিডিবি তার আবেদনে বলেছে চলতি বছরের বিদ্যুৎ উৎপাদনে ঘাটতি হবে সাত হাজার কোটি টাকার বেশি। এরমধ্যে সরকার তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে সম্মত হয়েছে। বাকি অর্থ গ্রাহকের কাছ থেকে দাম বাড়িয়ে তুলে দিচ্ছে বিইআরসি।
বিইআরসির এক প্রতিবেদন বলছে চলতি বছর ২০ হাজার ৩১ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে গবে। ইউনিট প্রতি ২ দশমিক ৯৪ টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে। এই ক্যাপাসিটি পেমেন্ট এর একটি বড় অংশই বিদ্যুৎ কেন্দ্র না চালিয়ে নিয়ে যাবে কেন্দ্রগুলো। পরিকল্পিতভাবে কেন্দ্র নির্মাণ করলে বিশাল এই ঘাটতিতে পড়ত না বিদ্যুতখাত। এখন যে দাম রয়েছে তাতে লোকসানের বদলে লাভে থাকত পিডিবি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, আমরা গ্যাস উন্নয়ন এবং বিদ্যুত উন্নয়ন তহবিল গঠন করেছিলাম। এর উদ্দেশ্য ছিল বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখা। এখন সেই তহবিলের টাকাও খরচ হচ্ছে আবার আমাদের টাকা দিতে হচ্ছে ভর্তুকিও দিতে হচ্ছে। এ ধরনের কমিশন জনগণের কথা না ভেবেই সিদ্ধান্ত নেয়াতে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।