হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী
উপমহাদেশের শীর্ষ আলেমে দ্বীন আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)’র ১২তম ঈসালে সাওয়াব মাহফিল ১৫ জানুয়ারী বুধবার ২০২০ইং ফিরে এলো দুয়ারে। আর মাত্র দুই দিন পর জকিগঞ্জ উপজেলার ঐতিহাসিক বালাই হাওর ধর্মপ্রাণ মানুষের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠবে। আগামী মঙ্গলবার এ ক্ষণজন্মা পুরুষের ১২তম ঈসালে সাওয়াব মাহফিল উপলক্ষে জকিগঞ্জ উপজেলার ফুলতলী ছাহেব বাড়িতে সকালে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ্ (রহ.)-এর মাজার যিয়ারতের মাধ্যমে শুরু হবে দিনের কার্যক্রম। এরপর খতমে কুরআন ও দু’আর মাধ্যমে শুরু হবে মূল অনুষ্ঠান। এতে বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে খতমে বুখারী, খতমে খাজেগান, দালাইলুল খায়রাত শরীফের খতম, যিকর মাহফিল, বিষয়ভিত্তিক বয়ান ও স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা। এ মাহফিলে তা’লীম-তরবিয়ত প্রদান করবেন আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)-এর সুযোগ্য উত্তরসূরী হযরত আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী বড় ছাহেব কিবলাহ্ ফুলতলী। প্রতি বছরের মতো এবারও মাহফিলে সমবেত হবেন লাখো লাখো মানুষ। মাহফিলের সকল প্রস্তুতি এখন শেষ পর্যায়ে। বালাই হাওরে তৈরি হচ্ছে বিশাল প্যান্ডেল ও সুদৃশ্য মঞ্চ। গাড়ি পার্কিং-এর জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে নির্ধারিত মাঠ। আগত মেহমানদের খাবারের জন্য প্রতিবারের মতো করা বিশাল আয়োজনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। মাহফিলের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা সম্বলিত লিফলেট ইতোপূর্বে সিলেট বিভাগের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিতরণ করা হয়েছে। রতনগঞ্জ বাজারে ছাহেব বাড়ির প্রবেশ পথে টানানো হবে মাহফিলের মানচিত্র। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকবে পুলিশ বাহিনী। পাশাপাশি সার্বিক শৃঙ্খলার জন্য প্রস্তুত থাকবে প্রায় হাজারো স্বেচ্ছাসেবক। মাহফিলের দেশ-বিদেশের প্রখ্যাত পীর-মাশায়িখ, আলিম-উলামা, ইসলামী চিন্তাবিদ, শিক্ষাবীদ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখবেন।
জানা যায়, আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.)’র ২০০৮ সালের ১৫ই জানুয়ারী দিবাগত রাত ২টার দিকে সিলেট নগরীর সুবহানী ঘাটস্থ নিজ বাসভবনে মহান প্রভূর ডাকে সাড়া দিয়ে পরকালে উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। তিনি জকিগঞ্জ উপজেলার মানিকপুর ইউনিয়নের ফুলতলী গ্রামে ১৯১৩ সালে এক প্রখ্যাত আলেম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ.)। তাঁর পিতা মুফতি মাওলানা আব্দুল মজিদ চৌধুরী (রহ.) ছিলেন একজন স্বনামধন্য আলেমে দ্বীন। শিক্ষা জীবনে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) স্থানীয় ফুলতলী মাদ্রাসায় প্রাথমিক শিক্ষা অর্জন করে ১৩৩৬ বাংলায় হাইলাকান্দি রাঙ্গাউটি মাদরাসায় ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে অধ্যায়ন করেন। অতঃপর ১৩৩৮ বাংলায় বদরপুর সিনিয়র মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা সুনামের সাথে সমাপন করেন। এরপর তদীয় উস্তাদ ও মুর্শিদ আবু ইউসুফ শাহ মুহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (রহ.) এর নির্দেশে উচ্চ শিক্ষা অর্জনার্থে ভারতের বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদ্রাসায়ে আলীয়া রামপুরে ভর্তি হয়ে ফনুনাত শেষ করে ইলমে হাদীসের শিক্ষা হাসিলের লক্ষ্যে মাতলাউল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। তিনি উক্ত মাদ্রাসায় সুনামের সাথে অধ্যায়নের পর হাদীসের চূড়ান্ত পরীক্ষায় ১ম বিভাগে ১ম স্থান অধিকার করে ১৩৫৫ হিজরী সনে সনদ লাভ করেন। আল্লামা ছাহেব কিবলাহ (রহ.) এর শিক্ষা হিসেবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে কুরআন তেলাওয়াত তথা ইলমে ক্বিরাত শিক্ষা। ইলমে ক্বিরাতে তাঁর সুযোগ্য শিক্ষক ছিলেন তারই পীর ও মুর্শিদ হযরত আবু ইউসুফ শাহ মুহাম্মদ ইয়াকুব বদরপুরী (রহ.)। তার দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি ক্বিরাতের আরো শিক্ষা গ্রহণ করেন উপমহাদেশের বিখ্যাত ক্বারী হযরত মাওলানা হাফিয আব্দুর রউফ করমপুরী শাহবাজপুরী (রহ.) এর কাছ থেকে। শাহবাজপুরী ছিলেন হযরত ইরকসুস মিশরী (রহ.) এর ছাত্র। ১৯৪৪ ইং সালে আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) মক্কা শরীফ গমন করে কিরাতের আরো উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেন শায়খুল কুররা হযরত আহমদ হিজাযী (রহ.) এর কাছ থেকে। আহমদ হিজাযী (রহ.) ছিলেন হারাম শরীফ সহ তৎকালিন বিশ্বের খ্যাতিমান কারীগণের উস্তাদ ও পরীক্ষক। যথারীতি তিনি শায়খুল কুররা হযরত আহমদ (রহ.) এর কাছ থেকে ইলমে কিরাতের সনদ লাভ করেন ১৯৪৬ ইং সালে। কর্মজীবনের প্রারম্ভে আল্লামা ছাহেব কিবলাহ (রহ.) ১৯৪৬ সালে বদরপুর আলিয়া মাদরাসায় নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত অত্যান্ত দক্ষতার সাথে শিক্ষকতার দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৫৪ ইং সালে গাছবাড়ী জামেউল উলুম আলিয়া মাদ্রাসায় মুহাদ্দিস হিসেবে যোগদান করে ছয় বছর সুনামের সাথে পাঠদান করেন। তিনি এ সময় ভাইস প্রিন্সিপাল ও প্রিন্সিপাল হিসেবে গুরু দায়িত্ব আন্জাম দেন। এরপর সুদীর্ঘকাল সৎপুর আলিয়া মাদ্রাসা ও ইছামতি আলিয়া মাদ্রাসায় হাদীসের খিদমত আনজাম দেন। পারিবারিক জীবনে হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ (রহ.) ১৩৪৫ বাংলায় তাঁর পীর ও মুর্শিদ হযরত ইয়াকুব বদরপুরী (রহ.) এর তৃতীয় কন্যা মুছাম্মৎ খাদিজা খাতুনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ তরফ থেকে তাঁর চার পুত্র ও তিন কন্যা। তারা হলেন মাওলানা ইমাদ উদ্দীন চৌধুরী ফুলতলী (বর্তমান পীর ছাহেব), মাওলানা নজমুদ্দীন চৌধুরী, মোছাম্মৎ করিমুন নেছা, মাওলানা শিহাবুদ্দীন চৌধুরী, মোছাম্মৎ মাহতাবুন নেছা, মোছাম্মৎ আফতাবুন নেছা ও মুফতি মাওলানা গিয়াস উদ্দীন চৌধুরী। বদরপুরী ছাহেব কিবলাহ ’র ছাহেবজাদী খাদিজা খাতুন আল¬াহর রেজামন্দী তথা ইবাদত বন্দেগীর এক পর্যায়ে সংসারের প্রতি বিরাগভাজন হওয়ার প্রেক্ষিতে তিনি স্বীয় পীর ও মুর্শিদ হযরত হযরত বদরপুরী (রহ.) এর নির্দেশে ফুলতলী গ্রামের মরহুম আব্দুর রশীদ খাঁনের কন্যা নেহারুন নেছার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
এ তরফে তাঁর ৩ পূত্র। তারা হলেন মাওলানা কমরুদ্দীন চৌধুরী, হাফিজ মাওলানা ফখরুদ্দীন চৌধুরী ও মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী। দশ সন্তানের জনক হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ্ (রহ.) সাত ছেলের সকলেই স্ব স্ব ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। নাতি-নাতনিরাও নানার আদর্শ অনুস্বরণ করে সেভাবেই নিজেদের গড়ে তুলছেন। এছাড়া হযরত আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলাহ্ (রহ.) এর হাতে গড়া সংগঠন বাংলাদেশ আনঞ্জুমানে আল-ইসলাহ ও বাংলাদেশ আনঞ্জুমানে তালামীযে ইসলামিয়া দেশব্যাপী ধর্মপ্রাণ মানুষের মধ্যে আলোড়ন তৈরী করেছেন। দেশ-বিদেশে তাঁর হাতে গড়া শত শত প্রতিষ্ঠান আজ দ্বীনি শিক্ষা বিস্তারের অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মসজিদগুলো ধর্মপ্রাণ মানুষের ইবাদত-বন্দেগীতে মুখরিত। দারুল ক্বেরাত মজিদিয়া ফুলতলী ট্রাস্ট সহীহ শুদ্ধ ক্বোরআন শিক্ষার জন্য দেশ-বিদেশে ব্যাপক সুনাম অর্জন করেছে।
মহান আল্লাহ তায়ালা এই মহান ওলিকে জান্নাতের উচ্চ মাকাম দান করুন আল্লাহুম্মা আমিন।