জেড. এম. শামসুল
আজ ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাংশের প্রধান শহর সিলেট মহান মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে হানাদারমুক্ত হয়। এ অঞ্চলের প্রথম শত্র“মুক্ত জকিগঞ্জ। সেখানে সর্বপ্রথম বাংলার আকাশে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়েছিল। পরবর্তী সময়ে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন এলাকা হানাদারমুক্ত হতে থাকে। পাক হানাদার বাহিনী পিছু হটে জেলা শহরের দিকে পলায়ন করে। একইভাবে মিত্র বাহিনীর সহযোগিতায় ৪ ও ৫নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা বীর বিক্রমে পূর্ব দক্ষিণ ও পশ্চিম দিক থেকে স্থল ও আকাশ পথে হামলা চালায়। পাক হানাদার বাহিনী শহর ছেড়ে উত্তর দিকে সালুটিকর বিমানবন্দরে গিয়ে জড়ো হয়। এদিনই পাক হানাদার বাহিনী মিত্রবাহিনী ও বাংলার সূর্যসন্তান মুক্তিবাহিনীর কাছে আতসমর্পন করে। তার পরের দিন তারা অস্ত্র সমর্পন করে। এ খবর ছড়িয়ে পড়ার পর জনগণের ঢল নামে রাজপথে।
উল্লেখ্য একাত্তরের ২৫ মার্চ রাত ১২ টায় হানাদার বাহিনী সন্ধ্যা আইন জারী করে শহরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিন রাতে বিশিষ্ট চা বাগান মালিক ও সাংবাদিক আমীনুর রশিদ চৌধুরীর বাসভবনে তৎকালীন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান ফরিদ গাজী, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মসুদ আহমদ চৌধুরী, প্রবীণ সাংবাদিক ও জেলা আওয়ামীলীগ নেতা এ এইচ শাহাদত খান, আওয়ামীলীগ নেতা সিরাজ উদ্দিন আহমদ, ন্যাপ নেতা সেনগুপ্ত (পচুসেন) ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আবু তাহের মিলিত হয়ে সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করছিলেন। এ সময় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের মাধ্যমে খবর পেয়ে নেতৃবৃন্দ নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। ২৫ মার্চ ভোর থেকে তৎকালীন ছাত্র যুবক সহ সর্বস্তরের জনতা শহর ও শহরতলীর সড়ক সমূহে প্রতিরোধের লক্ষ্যে ব্যারিকেড তৈরী করে। হানাদার সেনাদের পথরোধ করতে গিয়ে সর্বপ্রথম মিরাবাজারে হানাদার বাহিনীর গুলির আঘাতে জীবন দিতে হয় প্রগতিশীল কর্মী আব্দুস সামাদ ফকরিকে। তবে ভোর রাতে টিলাগড় চৌমুহনায় মেজর (অব:) এম এ মুত্তালিবের গুলিতে দু’জন হানাদার নিহত হয়।
হানাদার বাহিনী ২৮শে মার্চ সকালে কয়েক ঘন্টার জন্যে সন্ধ্যা আইন তুলে নিলে রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা সহ সাধারণ মানুষ মালপত্র ফেলে প্রাণ নিয়ে পালাতে শুরু করে। অনেকে দক্ষিণ সুরমাস্থ জেলা ন্যাপ নেতা আব্দুল হামিদের বাড়ীতে আশ্রয় নেন। সন্ধ্যা আইনে চলাকালীন সময়ে হানাদার বাহিনী শহরের আনাচে কানাচে গণহত্যা চালিয়ে রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে তোলে।
এছাড়াও তারা প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য দেওয়ান ফরিদ গাজী, এডভোকেট আব্দুর রহিম, এডভোকেট হাবিবুর রহমানের বাসা সহ অসংখ্য বাড়ীতে হামলা, লুট ও ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। অনেককে আহত ও গ্রেফতার করে।
৩০ মার্চ হানাদার বাহিনী সন্ধ্যার দিকে সিলেট শহরতলীর আখালিয়াস্থ ইপিআর ক্যাম্পে হামলা চালায়। কিন্তু প্রাক্তন সুবেদার আব্দুল জলিল ও অবসরপ্রাপ্ত সুবেদার মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে বাঙালি জোয়ানরা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচন্ড প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এক টানা কয়েক ঘন্টা যুদ্ধ চলে। এতে অনেক বাঙালি ইপিআর প্রাণ হারায়, তবে তার কোন তালিকা পাওয়া যায়নি।
সিলেট শহর ও শহরতলীর প্রাথমিক প্রতিরোধে গোলাবারুদ শেষ হয়ে যাওয়ায় ভোলাগঞ্জ হয়ে বাঙালী জোয়ানরা ভারতে চলে যান এবং জকিগঞ্জ ও সুতারকান্দি সীমান্ত দিয়ে ভারতের করিমগঞ্জে গিয়ে আশ্রয় নেন।
৩১ মার্চ ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন, আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতৃবৃন্দ করিমগঞ্জে পায়ে হেঁটে গিয়ে পৌঁছেন। সেখানে গিয়ে সেখানকার সামরিক বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ আলোচনা করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার চেষ্টা করেন। এ সময় জাতীয় পরিষদ সদস্য এডভোকেট আব্দুর রহিম, প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এম এ লতিফ, মসুদ আহমদ চৌধুরী, মনিরুল ইসলাম চৌধুরী, জমির উদ্দিন আহমদ, ইসমত আহমদ চৌধুরী, সিরাজ উদ্দিন আহমদ, ইসহাক মিয়া, মজম্মিল আলী, জেলা ন্যাপ সভাপতি কফিল উদ্দিন চৌধুরী, ছাত্রলীগ নেতা আব্দুল বাছিত, ইপিআর জোয়ান আব্দুল হক, আনসার অধিনায়ক আব্দুল মছব্বির, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আকরাম আলী ও আবুল বাইছ প্রমুখ বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় গোলাপগঞ্জের ঢাকাদক্ষিণে মুক্তিযুদ্ধা প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।
২ এপ্রিল দেওয়ান ফরিদ গাজী, কর্নেল (অব:) এম এ রব, মোঃ ইলিয়াস সহ অন্যান্য নেতারা শ্রীমঙ্গলে এক সভা করে সিদ্ধান্ত নেন সিলেট অঞ্চলে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। এ দিনই মেজর খালেদ মোশারফ শ্রীমঙ্গলে পৌঁছে সরকার গঠনের জন্যে নেতৃবৃন্দকে চাপ সৃষ্টি করেন। এর পরের দিন ভারতের কৈলাশ শহরে ভারতীয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন এবং অল্প কিছু অস্ত্র পাওয়া যায়। ৪ এপ্রিল মেজর (অব:) এম এ মুত্তালিবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট তামাবিল সড়ক দিয়ে সিলেট শহরে প্রবেশ করে। এদিনই মানিক চৌধুরীরর নেতৃত্বে আনসার মুজাহিদ ও ছাত্র জনতার এক বাহিনী সিলেট-ঢাকা মহাসড়কে ধাওয়া করে দক্ষিণ সুরমা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। এদিন বিকালের দিকে হানাদার বাহিনী পিছু হটে সালুটিকর বিমানবন্দরের দিকে পলায়ন করে।
৬ এপ্রিল আওয়ামীলীগ সহ অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরা শহরে প্রবেশ করে। পরদিন সকাল থেকে বিমান হামলা জোরদার করা হয়। কিন্তু ৯ এপ্রিল হানাদার বাহিনী প্রচন্ড লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে সিলেট শহর দখল করে নেয় এবং শহরে ব্যাপকভাবে গণহত্যা চালায়। হানাদার বাহিনীর দালাল, রাজাকার, আলবদরের সহযোগিতায় স্থানীয় মেডিকেল কলেজ, শহরের দাড়িয়াপাড়া ও সোবহানীঘাট সহ প্রতিটি পাড়ায় বর্বরোচিত হামলা চালায়। শুধু জেলা শহর নয় ১১টি থানায় গিয়ে হাজার হাজার বাড়ীঘর লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ এবং অসংখ্য নারীর সম্ভ্রম লুটে নেয়া সহ প্রতিটি থানা সদরে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে মুক্তিযোদ্ধারা সীমান্তের দিকে সরে পড়ে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধারা হামলা চালাতে থাকে। ৪ ও ৫নং সেক্টরের অধীনে পরিচালিত গেরিলা হামলার মাত্রা বাড়তে থাকে। এ সমস্ত হামলার নেতৃত্ব দেন মেজর সি.আর দত্ত, মেজর মীর শওকত আলী, মেজর (অবঃ) এম এ মুত্তালিব, সুবেদার বি আর চৌধুরী, দেওয়ান মাহবুবুর সাদী, ক্যাপ্টেন আব্দুর রব, লে. জহির উদ্দিন ছাড়াও জিয়াউর রহমানের জেড ফোর্স। বাংলার সূর্য সন্তানরা দৃঢ় শপথ নিয়ে শেরপুর, আটগ্রাম, জাফলং, তামাবিল, সুতারকান্দি, শেওলা, জৈন্তাপুর, গোয়াইনঘাট ও জকিগঞ্জ সহ বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় প্রচন্ড যুদ্ধ চালায়। হানাদার বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ১৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। এ খবর জানাজানি হওয়ার সাথে সাথে সিলেট শহর ১৫ ডিসেম্বর ভোর থেকে আনন্দ আর উল্লাসে মুখরিত হয়ে উঠে। কিছুক্ষণের জন্য আত্মীয়-স্বজন হারানোর ব্যাথা ভুলে যায়। কিন্তু আজও শহরবাসীর মনে সে দিনকার নির্যাতন আর বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের কথা স্মরণ হলে অনেকের চোখের জল আসতে দেখা যায়। এদিনই সিলেট শহর হানাদারমুক্ত হয়।