কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক এই তালিকা প্রকাশ করে বলেছেন, যারা শান্তি কমিটিতে ছিল তাদেরও নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে। ’৭১ সালে কার কী ভূমিকা ছিল জাতি ও বিশ্ববাসীকে তা জানানোর জন্যই এই তালিকা প্রকাশ। ইতিহাসের স্বার্থেই এটা জাতির জানা প্রয়োজন। একাত্তরে খুন ধর্ষণ নির্যাতন লুণ্ঠনে যারা হানাদার পাকবাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল, সেসব রাজাকারের তালিকার প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হলো রবিবার। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্তের কাজ চলছে। আগামী ২৬ মার্চ তা প্রকাশ করা হবে। মহান বিজয় দিবসের প্রাক্কালে রবিবার সচিবালয় সংলগ্ন সরকারী পরিবহন পুল ভবনের ৬ তলায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে সংবাদ সম্মেলনে এ তালিকা ঘোষণা করেন তিনি।
সাংবাদিকদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, আপনারা অবগত আছেন, হানাদার পাকবাহিনী দীর্ঘ ৯ মাস তাদের এ দেশীয় দোসর জামায়াত, মুসলিম লীগ, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও শান্তি বাহিনীর সহায়তায় বর্বরোচিত হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ৩০ লাখ বাঙালীকে হত্যা করে। একই সঙ্গে দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ঘটায়। এসব স্থানীয় দোসর পাকিস্তানীদের সহযোগিতা না করলে এমন নির্মম হত্যাকান্ড ও অত্যাচার সংঘটিত হতো না। মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়ও ত্বরান্বিত হতো। তাদের এসব সহযোগীর অনেকেই মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ছিল।
তিনি বলেন, আমরা বলেছিলাম ১৬ ডিসেম্বরের আগেই রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করব। এখানে একটি বিষয় স্পষ্ট করতে চাই, আমরা কোন তালিকা তৈরি করছি না। যারা একাত্তরে রাজাকার আলবদর, আলশামস বা স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিল এবং যেসব পুরনো নথি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সংরক্ষিত ছিল সেটুকুই প্রকাশ করছি। মন্ত্রী আরও বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নথি পর্যালোচনা করে প্রথম ধাপে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের তালিকা প্রকাশ করা হলো। এ তালিকা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে িি.িসড়ষধি.মড়া.নফ পাওয়া যাবে।
মোজাম্মেল হক বলেন, তৎকালীন বিভিন্ন জেলার রেকর্ড রুম ও সে সময়ের বিজি প্রেসে ছাপানো তালিকা সংগ্রহেরও চেষ্টা চলছে। যাচাই-বাছাই করে ধাপে ধাপে আরও তালিকা প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংরক্ষণাগারে মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা দালিলিক প্রমাণাদি রয়েছে, সে সময়ের সংরক্ষিত তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য ডিসিদের অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, আমরা আশানুরূপ সাড়া পাইনি। অবশ্য আমরা ফের তাদের অনুরোধ করব, জানুয়ারির মধ্যে সে সময়ের তথ্যাদি পাঠিয়ে সহযোগিতা করুন।
মন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বা স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা ও নথিসমূহ বিভিন্নভাবে নষ্ট করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার স্বাধীনতাবিরোধীদের আইনের আওতায় আনতে বদ্ধপরিকর। এরই ধারাবাহিকতায় এবং মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে জানাতে এ তালিকা প্রকাশ। তালিকাভুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যদি কোন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ থেকে থাকে তাহলে আজকের এ তালিকা প্রকাশের মাধ্যমে তাদের বিচারের দ্বার উন্মোচিত হবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, রাজাকারদের চেয়েও যারা উচ্চ পদে ছিল অর্থাৎ পিস কমিটির সভাপতি বা অন্য পদে যারা ছিল তাদেরও নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে। একাত্তরে খুন, ধর্ষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠনে যারা পাকিস্তানী বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিলেন, সেসব রাজাকারের ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নামের তালিকার প্রথম পর্ব প্রকাশ করা হয় রবিবার। এদিনের প্রকাশিত তালিকায় কোন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি বা মন্ত্রী পর্যায়ের লোকের নাম আছে কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনারা যাদের ইন্ডিকেট (ইঙ্গিত) করে এ প্রশ্ন করছেন তিনি রাজাকার নন, পিস কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। আপনি যদি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে ইঙ্গিত করেন, পরবর্তীকালে যিনি মন্ত্রী, স্পীকার, রাষ্ট্রপতি- সবই হয়েছিলেন। তিনি বরিশালে পিস কমিটির সভাপতি ছিলেন।
পিস কমিটি কিন্তু রাজাকার ছিল না। এরা আরও উচ্চপদস্থ। আরও অনেক বড় দালাল। তবে তারা রাজাকার ছিল না। তারা ছিল উচ্চ পর্যায়ের। এ ধরনের উচ্চ পর্যায়ে স্বাধীনতাবিরোধী তথা পিস কমিটিতে যারা ছিল তাদের নামের তালিকা প্রকাশ করা হবে কি-না, জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, জাতি যেভাবে চাচ্ছে তাতে করে জাতির চাহিদা তো পূরণ করতেই হবে। মোজাম্মেল হক বলেন, প্রথম ধাপে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত একাত্তরে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস বা স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নিযোগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন এমন ১০ হাজার ৭৮৯ রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করলাম।
তিনি বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংরক্ষণাগারে মুক্তিযুদ্ধের সময় নানা দালিলিক প্রমাণাদি রয়েছে, ওই সময়ের সংরক্ষিত তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য জেলা প্রশাসকদের অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা আশানুরূপ সাড়া পাইনি। তবে আমরা আবারও তাদের অনুরোধ করব, জানুয়ারি মাসের মধ্যে সেই সময়ের তথ্যাদি পাঠিয়ে সহযোগিতা করতে।
মন্ত্রী বলেন, দ্বিতীয় ধাপে আমরা জেলা প্রশাসকদের এবং বিজি প্রেস থেকে সমস্ত তালিকা সংগ্রহ করতে পারব। সেগুলোর শতভাগ সত্যতা নিশ্চিত হয়ে আগামী স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রাক্কালে প্রকাশ করব। শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কোন তালিকা আমরা প্রকাশ করব না। মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত তালিকা ২৬ মার্চ প্রকাশ করা হবে। আইনে একটা কথা রয়েছে, ১০টা অপরাধী যদি বেঁচেও যায় তবুও একজন নিরপরাধ ব্যক্তি যেন শাস্তি না পায়। তাই আমরা চাই না কোন একজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে এ কলঙ্কজনক তালিকায় নিয়ে আসতে। এ বিষয়ে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয় সচেতন।
তিনি আরও বলেন, আমি জাতিকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, অন্যায়ভাবে কেউ এ তালিকায় আসবে না। ইতোমধ্যে এ তালিকার বিষয়ে শত শত মানুষ আমাকে ফোন করে জানতে চেয়েছেন যে, কতজনের তালিকা, তালিকায় কারা কারা আছেন? মন্ত্রী বলেন, মনে হয় এ বিষয়টা নিয়ে অনেকেই শঙ্কিত। তাই আমি বলছি, সরকারের কাছে সংরক্ষিত তালিকার বাইরে কেউ যদি কোন নাম অন্তর্ভুক্ত করাতে চান, সেটা গ্রহণ করব না। অনেকে রাজাকারদের তালিকা দিয়ে বই প্রকাশ করেছেন, আবার জেলাভিত্তিক তালিকা তৈরি করেছেন। আমরা সেগুলোকে তথ্য হিসেবে নেব। কিন্তু কোন অবস্থাতেই আমরা সেটা সরকারীভাবে প্রকাশ করব না।
তিনি বলেন, আগামীতে যাদের নাম এই তালিকায় আসবে, তাদের (অভিযুক্ত) কথা শোনা হবে। তারপর তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এ তালিকায় থাকাদের বিরুদ্ধে কোন আইনী পদক্ষেপ নেয়া হাবে কি-না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পর্যাপ্ত প্রমাণ ছাড়া কারও বিরুদ্ধে কোন মামলা করব না। এ তালিকা তৈরি করা হচ্ছে শুধু জাতি ও বিশ্ববাসীর জানার জন্য যে, ১৯৭১ সালে কার কী ভূমিকা ছিল। ইতিহাসের স্বার্থেই এটা জাতির জানা প্রয়োজন।
২৬ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা : মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা চূড়ান্তের কাজ চলছে জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, এই তালিকা আগামী ২৬ মার্চ প্রকাশ করা হবে। তিনি বলেন, তালিকার প্রাথমিক খসড়া আমাদের কাছে রয়েছে। বর্তমান তথ্যমতে, কোন না কোন তালিকায় অন্তর্ভুক্তির সংখ্যা ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৮৫৬। এর মধ্যে দাবিদার মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৫১ হাজার ২৮৫।
আর বর্তমানে ভাতাভোগী ২ লাখ ১ হাজার ৪৬১ মুক্তিযোদ্ধা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিন্তু ২ লাখ ৫১ হাজার ২৮৫ জনের নামে একাধিক গেজেট ও অন্য দলিল থাকায় মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা বেশি মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এ সংখ্যা ২ লাখ ১০ হাজারের বেশি নয়।
একই মুক্তিযোদ্ধার নাম একাধিক গেজেট ও দলিলে থাকার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, তার নিজের নামই পাঁচটা দলিলে রয়েছে। এছাড়া কারও কারও নাম বারোবার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। একাধিক দলিলভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত একক তালিকা তৈরির কাজ প্রক্রিয়াধীন জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, এ খসড়া তালিকা উপজেলা থেকে পরীক্ষণ সম্পন্ন করে প্রকাশ করা হবে।