ধর্মঘটে জনভোগান্তি, পণ্য পরিবহন ও যাত্রী চলাচলে সঙ্কট ॥ মারমুখী শ্রমিক, যানবাহন ভাংচুর, হামলা

19

কাজিরবাজার ডেস্ক :
পরিকল্পিতভাবে যানবাহন বন্ধ করে জনভোগান্তির মধ্যে সড়ক পরিবহন আইন সংশোধন চান পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। যার ধারাবাহিকতায় বুধবার প্রায় সারাদেশে বন্ধ ছিল পরিবহন চলাচল। ফলে আন্তঃজেলা রুটে যাত্রী ও পণ্যবাহী যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কিছু কিছু এলাকায় যানবাহন চালানোর চেষ্টা করা হলে চালকরা হামলা ও বাধার শিকার হন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা চালকদের মুখে পোড়া মবিল মাখিয়ে দেন বিভিন্ন এলাকায়। এদিকে সারাদেশের মতো রাজধানী ঢাকার রাস্তাও কার্যত ফাঁকা ছিল। বেশিরভাগ সিটি সার্ভিস সকাল থেকেই বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা থেকে আন্তঃজেলা রুটের বাস খুব একটা ছেড়ে যায়নি। দিনভর তেজগাঁও ও যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, চট্টগ্রাম মহাসড়কসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন পরিবহন শ্রমিকরা।
পরিবহন শ্রমিকদের স্বেচ্ছা কর্মবিরতিতে দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরের বেশ কিছু জেলায় দুদিন ধরেই বাস চলাচল বন্ধ। বুধবার সকাল থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কেও দূরপাল্লার বাস চলাচলে বাধা দেয়া হয়। সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনসহ নয় দফা দাবিতে বুধবার সকাল ৬টা থেকে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করা হয় বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্যপরিষদের পক্ষ থেকে। ফলে গত দুদিনের তুলনায় বুধবার জনদুর্ভোগ আরও বাড়ে। অচল হয়ে যায় গোটা দেশ।
বাস্তবতা হলো বাস মালিকরা বলছেন, তারা ধর্মঘটের ডাক দেননি। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কর্মকর্তারাও বলছেন, ধর্মঘটের সঙ্গে তাদের কোন সম্পর্ক নেই। স্থানীয় শ্রমিক ইউনিয়নগুলো নিজেদের দায়িত্বে গাড়ি চলাচল বন্ধ রেখেছে। প্রশ্ন হলো তাহলে তাদের ইশারায় সারাদেশে একযোগে বাস চলাচল বন্ধ। সেইসঙ্গে শ্রমিকরা রাস্তায় এত বেপরোয়াই বা কেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিভিন্ন পরিবহন কোম্পানির চালক ও শ্রমিক নেতারা বলছেন, সারাদেশের পরিবহন শ্রমিকরা মালিকদের হাতে রীতিমতো জিম্মি। মালিক ও শ্রমিক ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতাদের ইশারা ছাড়া কোন অবস্থাতেই সারাদেশে একযোগে ধর্মঘট হতে পারে না। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান ও চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, সারাদেশের মানুষকে জিম্মি করে অধিকার আদায় ঠিক নয়। যদি কোন দাবি দাওয়ার বিষয় থাকে তাহলে মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনা হতে পারত। কোন প্রকার চাপের মুখে আইন বাস্তবায়ন থেকে সরকারকে সরে না আসতে পরামর্শ দেন তিনি।
চলমান সঙ্কট নিরসনে মঙ্গলবার রাতে ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্যপরিষদের নেতাদের সঙ্গে কোন রকম সমঝোতা ছাড়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক শেষ হয়। আজ বৃহস্পতিবার ও আগামীকাল শুক্রবার বৈঠক আহ্বান করেছে কেন্দ্রীয় শ্রমিক ফেডারেশনের নেতারা। তারা বলছেন, এই বৈঠকে সারাদেশের নেতাদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। তাদের দাবি-দাওয়াগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের জমা দেয়া হবে।
এদিকে পণ্যবাহী পরিবহনের ধর্মঘটের ফলে পণ্য পরিবহনে বড় ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। সবজিসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্যের দাম বাড়ার আশঙ্কা করছেন অনেকে। বাংলাদেশ ট্রাক-কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্যপরিষদের আহ্বায়ক মোঃ রুস্তম আলী খান বলেন, দেশজুড়ে তাদের কর্মবিরতি চলছে। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মসূচী চলবে।
তিনি বলেন, মঙ্গলবার আমরা কর্মসূচী ঘোষণা করার পর রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে একটা বৈঠক হয়েছিল। কিন্তু সেখানে দাবি পূরণে আশ্বাস পাইনি। এজন্য কর্মবিরতি চলছে, এটা চলবে।
সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে বলে জানিয়েছেন সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম। তিনি বলেন, ট্রাক শ্রমিকরা বিভিন্ন স্থানে বাস চলাচলে বাধা দিচ্ছে। বাস শ্রমিকরাও সড়ক আইনের বিরোধিতা করছেন, তারা কাজ করছেন না। যাত্রী নিয়ে ঢাকা আসার পথে কুমিল্লার আলেখারচরে ট্রাক শ্রমিকরা বাসের হেলপার, চালকদের মারধর করছে এবং গাড়ি আটকে রাখছে বলে জানান আবুল কালাম। আবার ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পথে নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড, মদনপুর ও ডেমরায় বাস আটকে দেয়া হয়। মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, শ্রমিকরা কাজে ফিরছেন না। তাই সকাল থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন রুটে বাস চলাচল বন্ধ।
শাস্তির মাত্রা বাড়িয়ে নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের শুর থেকে তার বিরোধিতা করে আসছিলেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। এক নবেম্বর ঘোষণা হলেও সোমবার থেকে আইনটি কার্যকর শুরুর পর কোন চাপে পিছু হটবেন না বলে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ঘোষণা দেন। এরপর পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা দৃশ্যত চাপ বাড়িয়ে দেন। আবুল কালাম বলেন, সড়ক পবিরহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় শিথিল হতে বললেও তা হচ্ছে না। এ কারণে বাস চালক-শ্রমিকরাও আতঙ্কিত, তারা বাস চালাচ্ছে না।
সড়কের বিভিন্ন জায়গায় বাধা এবং চালকদের ‘অনীহার’ কারণে মহাখালী থেকে চলাচলকারী বেশিরভাগ পরিবহনের বাস বন্ধ রয়েছে বলে জানান মহাখালী আন্তঃজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল মালেক। তিনি বলেন, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর বাসগুলো আর ফেরত আসছে না। তিনদিন ধরে এ অবস্থা। এখান থেকে গিয়ে ওইপার থেকে আর গাড়ি ছাড়ে না। টুকটাক গাড়ি যাচ্ছে, যাত্রীরাও ভয়ে আসছে না। আবার গাড়ি ছেড়ে গেলে বিভিন্ন জায়গায় ব্যারিকেডে পড়ছে।
ধর্মঘট শ্রম আইন পরিপন্থী : পরিবহন সেক্টরে অচলাবস্থা নিরসনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক সভাকক্ষে পরিবহন সেক্টরের বিভিন্ন সংগঠনের শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে জরুরী মতবিনিময় সভা ডাকা হয় বিকেলে। সভায় সভাপতিত্ব করেন শ্রম অধিদফতরের মহাপরিচালক এ কে এম মিজানুর রহমান। বৈঠকে মহাপরিচালক ধর্মঘটী ট্রাক কাভার্ডভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্যপরিষদের নেতাদের উদ্দেশে বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের এই পরিবহন ধর্মঘট অবৈধ। কোন নোটিস ছাড়াই ধর্মঘট আহ্বান করা হয়েছে। তাই অবিলম্বে ধর্মঘট প্রত্যাহার করার আহ্বান জানান তিনি। জবাবে পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, আমরা চাপের মুখে কর্মসূচী ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছি।
হবিগঞ্জে ট্রাক মালিক-শ্রমিকরা কর্মবিরতিতে : সকাল থেকে লাগাতার কর্মবিরতিতে গেল হবিগঞ্জ ট্রাক কাভার্ডভ্যান পণ্য পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ। হবিগঞ্জ ট্রাক মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক জানান, কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী ওই কর্মসূচীর প্রতি তারা একত্মতা পোষণ করেছেন। দাবি না মানা পর্যন্ত এই কর্মবিরতি চলবে।