অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজার থেকে পেঁয়াজ উধাও ! কৃত্রিম সংকট তৈরীর চেষ্টা

52

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে বাজার থেকে পেঁয়াজ উধাও হয়ে গেছে। ‘পেঁয়াজ নেই’ বলে কৃত্রিম সঙ্কটের এই আতঙ্ক ছড়িয়ে দাম হাকা হচ্ছে ইচ্ছেমতো। অতি মুনাফা খোর ব্যবসায়ীদের কারসাজি ছড়িয়ে পড়ছে খুচরা বাজারেও। দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে দাম। শুক্রবার বিকেলে পাড়া-মহল্লায় ২৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি দেশী পেঁয়াজ। পেঁয়াজের অস্বাভাবিক এই দাম বৃদ্ধির মূলে সিন্ডিকেট ব্যবসায়ীদের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, ভোক্তা স্বার্থে পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক করতে জরুরী পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে, আপৎকালীন সঙ্কট মেটাতে আগামীকাল রবিবার থেকে জরুরী ভিত্তিতে মিসর থেকে কার্গোবিমানে করে পেঁয়াজ আনা হচ্ছে। নতুন পেঁয়াজ বাজারে না আসা পর্যন্ত প্রতিদিন কার্গো বিমানযোগে ধারাবাহিক পেঁয়াজ আনা হবে দেশে। এছাড়া সরকারী বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রথমবারের মতো তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছে। এর আগে টিসিবি দেশের অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে সেই পেঁয়াজ কম দামে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করে আসছিল। শুক্রবার বিকেলে কোন কোন বাজারে জাত ও মানভেদে ২৪০-২৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে প্রতিকেজি পেঁয়াজ। পেঁয়াজের ঝাঁজে অস্থির নিত্যপণ্যের বাজার।
জানা গেছে, পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দামে উদ্বিগ্ন সাধারণ মানুষ। স্বল্প আয়ের মানুষ ইতোমধ্যে মসলা জাতীয় এই পণ্যটির ব্যবহার বাদ দিয়েছেন। পেঁয়াজ ছাড়াই রান্না হচ্ছে তরকারি। বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন সরকার। শুক্রবার ছুটির দিন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা সারাদিন অফিস করেন। বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীনের সভাপতিত্বে একটি জরুরী বৈঠক করা হয় মন্ত্রণালয়ে। ওই বৈঠকে জরুরী ভিত্তিতে পেঁয়াজ আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। দেশের অন্যতম ব্যবসায়িক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপকে দ্রুত পেঁয়াজ আনার জন্য সরকারী নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এই শিল্প গ্রুপকে বাংলাদেশে অবস্থিত মিসর দূতাবাস সর্বাত্মক সহযোগিতা দিচ্ছে। আগামীকাল রবিবার মিসর থেকে ধারাবাহিকভাবে বিমানযোগে পেঁয়াজ আনা হবে।
এ প্রসঙ্গে বাণিজ্য সচিব ড. মোঃ জাফর উদ্দীন বলেন, পেঁয়াজের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধির জন্য অসাধু ব্যবসায়ীদের হাত রয়েছে। এ কারণে বাজার তদারকি করার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা চাওয়া হয়। একই সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং টিম সর্বদা মাঠে রয়েছে। তিনি বলেন, এর পাশাপাশি জরুরী ভিত্তিতে মিসর ও তুরস্ক থেকে পেঁয়াজ আনা হচ্ছে। কার্গো বিমানযোগে পেঁয়াজ আনার জন্য এস আলম গ্রুপকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সরকারীভাবে এই প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে। বাণিজ্য সচিব আরও বলেন, নতুন পেঁয়াজ না ওঠা পর্যন্ত কার্গো বিমানে করে মসলা জাতীয় এই পণ্য আমদানি করবে এস আলম গ্রুপ। এছাড়া মিসর ও তুরস্ক থেকে সমুদ্র পথে প্রায় ৬০ হাজার মে.টন পেঁয়াজ আনা হচ্ছে। ওই পেঁয়াজ বাংলাদেশের পথে রয়েছে। তিনি বলেন, সরকারী এসব উদ্যোগের ফলে দ্রুত পেঁয়াজের বাজার স্বাভাবিক হবে বলে আশা করছি।
প্রসঙ্গত, গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিলে দেশে সঙ্কট তৈরি হয়। অসাধু ব্যবসায়ীরা এই সুযোগ গ্রহণ করে ইতোমধ্যে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এই টাকা দেশের সাধারণ ভোক্তাদের পকেট কেটে নেয়া হয়েছে। ভোক্তাদের অভিযোগ, ভারত রফতানি বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই বিকল্প উৎস থেকে পেঁয়াজ আনার উদ্যোগ নেয়া হয়নি। আর এতে করেই অসাধু ব্যবসায়ীরা সুযোগ পেয়েছে। কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাজার থেকে পেঁয়াজ উধাও করে দেয়া হয়েছে। পাইকারি বাজার থেকে শুরু করে মুদিপণ্যের দোকানেও পেঁয়াজ মজুদ করে দাম বাড়ানো হচ্ছে। বিক্রেতারা বেশি মুনাফার আশায় পেঁয়াজ ছাড়তে চাচ্ছে না। পাইকারি বাজারখ্যাত রাজধানী ঢাকার কাওরানবাজার, শ্যামবাজার, মোহাম্মদপুর কৃষিমার্কেট ও মৌলভীবাজারসহ সব জায়গা থেকে পেঁয়াজ উধাও হয়ে গেছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে-মজুদকৃত পেঁয়াজ সরিয়ে ফেলছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। অতি মুনাফা পেলে পেঁয়াজ ছাড়া হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে শ্যামবাজারের পাইকার ও আমদানিকারক ব্যবসায়ী আবদুল মাজেদ বলেন, আমদানি না হওয়ার কারণে পেঁয়াজ ফুরিয়ে আসছে। আর এই কারণেই দাম বাড়ছে। তিনি বলেন, বাজার স্বাভাবিক করতে দ্রুত পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
এদিকে, পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধির ঘটনায় এখন সর্বত্র আলোচনার বিষয় মসলা জাতীয় এই পণ্যটি। গত কয়েক দশকে এত দাম আর বাড়েনি। এর ফলে পেঁয়াজ নিয়েই এখন যত আলোচনা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেঁয়াজের বাজারে এত বড় সঙ্কট অথচ বাণিজ্যমন্ত্রী কোন কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছেন না। তিনি বিদেশ সফর করছেন। জরুরী এই সময়ে বাণিজ্যমন্ত্রী দেশে থাকলে তড়িৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে পেঁয়াজের ব্যবস্থা করা সম্ভব হতো। অথচ এ রকম কোন উদ্যোগ চোখ পড়েনি। মুগদা বড়বাজারে পেঁয়াজ কিনতে এসেছিলেন মান্ডার বাসিন্দা মতিন খান। তিনি বলেন, পেঁয়াজের কেজি ৩০০ টাকা ছুঁইছুঁই করছে। অথচ সংশ্লিষ্টদের কোন মাথা ব্যথা নেই। তিনি বলেন, সরকারীভাবে এই সঙ্কট দূর করার তড়িৎ ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন।
এদিকে, ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকেও এ পর্যন্ত পেঁয়াজের দাম কমানোর ব্যাপারে কোন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সংগঠনটির শীর্ষ নেতারা এ বিষয়ে সরকারী উদ্যোগের কথা জানান। যদিও ইতিপূর্বে যখনই কোন ভোগ্যপণ্য নিয়ে সঙ্কট তৈরি হয়েছে এফবিসিসিআই সাড়া দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, দ্রুত এ বিষয়ে সংগঠনটির এগিয়ে আসা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যবসায়ী বলেন, কোন পণ্যের সঙ্কট তৈরি হলে শীর্ষ সংগঠন হিসেবে এফবিসিসিআই দায় এড়াতে পারে না। কারণ এফবিসিসিআইয়ের জেনারেল বডির সদস্যরাই পেঁয়াজ আমদানি করছেন কিংবা পাইকারি ব্যবসায়ী হিসেবে রয়েছেন। ইতিপূর্বে চিনির সঙ্কট তৈরি হলে তখন এফবিসিসিআই ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দাম নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। পেঁয়াজ সঙ্কট দূরীকরণেও উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।
আন্তঃমন্ত্রণালয় দলের অভিযান : লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না পেঁয়াজের দাম। ইতোমধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ পাঁচ সরকারী প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় আভিযানিক দল পেঁয়াজের রাশ টেনে ধরার জন্য অভিযান শুরু করেছে। শুক্রবার রাজধানীর মিরপুরের শাহআলী এবং পল্লবী থানা এলাকায় পেঁয়াজের পাইকারি বাজার এবং খুচরা বাজারে ভ্রাম্যমাণ টিম? পরিচালনা করে আন্তঃমন্ত্রণালয় অভিযানিক দল। অভিযান পরিচালনা করেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার মণ্ডল। পেঁয়াজের মূল্য তালিকা না টানিয়ে দাম বৃদ্ধিতে কারসাজি করার অপরাধে কয়েকটি দোকানের মালিককে জরিমানা করা হয়। এতে ৭ প্রতিষ্ঠানকে পৌনে এক লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল জব্বার মণ্ডল জানান, মিরপুরের শাহআলী এবং পল্লবী এলাকায় পেঁয়াজের মূল্য তালিকা না টানিয়ে মূল্যবৃদ্ধিতে কারসাজি করার অপরাধে আনসারের মুদি দোকানকে ২ হাজার টাকা, আইয়ূবের মুদি দোকানকে ২ হাজার টাকা, এনামুল হকের মুদি দোকানকে ২ হাজার টাকা, সোনার বাংলা ট্রেডার্সকে ৫ হাজার টাকা, এনায়েত ট্রেডার্সকে ১০ হাজার টাকা এবং অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে খাদ্য সামগ্রী উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণ করা এবং বাসি খাবার ফ্রিজের একই চেম্বারে কাঁচা মাছ-মাংসের সঙ্গে সংরক্ষণ করার অপরাধে ঢাকা বিরানি হাউসকে ৫ হাজার টাকা ও আল্লাহর দান কাবাব এ্যান্ড কফি হাউসকে ৫০ হাজার টাকাসহ ৭ প্রতিষ্ঠানকে সর্বমোট ৭৬ হাজার টাকা অর্থদণ্ড প্রদান করা হয়। উক্ত তদারকি কাজে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা সার্বিক সহযোগিতা করেন। জনস্বার্থে এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে।