কাজিরবাজার ডেস্ক :
জঙ্গি তৎপরতায় কৌশলগত পরিবর্তন এসেছে। প্রায় এক বছর ধরে জঙ্গি সংগঠনগুলোর হিজরত কৌশল বন্ধ রয়েছে। সুনিশ্চিতভাবে কাউকে হত্যা করতে বা বড় ধরনের নাশকতা চালাতে আগে জঙ্গি সংগঠনগুলো কয়েক জঙ্গির সমন্বয়ে একটি সুইসাইডাল স্কোয়াড গঠন করে তাদের হিজরতে পাঠাত। হিজরত করানোর আগে তারা আপনা আপনি বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যেত। আপাতত সেই প্রক্রিয়াটি বন্ধ রেখেছে জঙ্গি সংগঠনগুলো। এমন কৌশল বন্ধ রাখলেও তাদের তৎপরতা থেমে নেই। জঙ্গি সংগঠনগুলো ঢাকা থেকে জেলা পর্যায়ে থাকা আস্তানাগুলোর সঙ্গে আবারও প্রযুক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা করছে। আর ঢাকায় স্বল্প দূরত্বের ব্যবধানে আস্তানা গড়ছে। সনাতন পদ্ধতিতে লোক মারফত ও চিরকুটের মাধ্যমে ঢাকার আস্তানাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করছে।
পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিট ও কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সনাল ক্রাইম ইউনিট সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে। সূত্র বলছে, পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিট সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে চলতি বছরের ২৬ জুলাই ঢাকার রূপনগরের ২৮ নম্বর সড়কের ২৩ নম্বর বাড়ির তৃতীয় তলা থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য সোনালী ব্যাংকের মতিঝিল স্থানীয় শাখার সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার আহাম্মদ আলী (৫৬), তার স্ত্রী সালমা বেগম (৪৮), মেয়ে ফেরদৌসি রিফা (২৭) দুই ছেলে হাফেজ আবু সালেহ মোহাম্মদ জাকারিয়া (২৪) ও হাফেজ কিবরিয়াকে (২১) গ্রেফতার করে। তারা তাদের ফ্ল্যাটটিকে জঙ্গি আস্তানা হিসেবে গড়ে তুলেছিল। আস্তানায় জঙ্গিবাদের হাজার হাজার পৃষ্ঠার ডকুমেন্ট, সিডি, বোমা তৈরির রাসায়নিক পদার্থ ও পুলিশের ওপর মারাত্মক হামলা করে কয়েকজনকে হত্যার কৌশলপত্র পাওয়া যায়।
পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, অভিযানকালে আমরা প্রায় বড় ধরনের ভুল করতে বসেছিলাম। তারা প্রথমে আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করবে বলে ঘোষণা দেয়। আমাদের তাদের কাছে যেতে বলে। এতে করে সন্দেহ হয়। পরবর্তীতে পুলিশ তাতে সায় না দিয়ে তাদের বেরিয়ে আসতে বলে। তখন তারা বের হচ্ছিল না। তখনই সন্দেহ বাড়ে। এরপর আর তারা আত্মসর্মপণ করেনি। পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলি হয়। একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে গ্রেফতার হয়। অভিযানকালে দুই ছেলে ও মেয়ে রাম দা ও চাপাতি দিয়ে হামলা করলে পুলিশের তিন সদস্য আহত হন। তারা বাসার ভেতরে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটালে আগুন ধরে যায়। পরে তারা বাড়ির সব ট্যাপ ছেড়ে দিয়ে আগুন নেভায়।
পরবর্তীতে গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তারা শুধু শুধু গ্রেফতার হতে চাচ্ছিল না। আত্মঘাতী হয়ে কয়েকজন পুলিশকে হত্যার পরিকল্পনা ছিল তাদের। অবলীলায় স্বীকার করে তারা আনসার আল ইসলামের সদস্য হলেও আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট বা আইএসের অনুসারী। অভিযানকালে গুলিতে জাকারিয়া নামের একজন গুলিবিদ্ধ হয়। এমন খবর জানার পরেও পিতামাতা ভাই বোন একেবারেই নির্বিকার। জাকারিয়া পুলিশের গুলিতে মরে গেলেও, কোন অসুবিধা ছিল না বলে তারা দাবি করেন। জাকারিয়া বেহেশত পেত বলে তারা জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেন।
এই কর্মকর্তা জানান, পরিবারটি প্রায় ১২ বছর ধরে ওই বাড়িতে বসবাস করলেও আশপাশের পরিবারের সঙ্গে তাদের কোন প্রকার যোগাযোগ ছিল না। বাসা থেকে প্রাপ্ত নথিপত্র মোতাবেক, বড় ছেলে আবু সালেহ মোহাম্মদ জাকারিয়া জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ থেকে অনার্স পাস করেছেন। তিনি ২০১২ সালে জঙ্গিবাদে জড়ায়। তার মাধ্যমেই পরিবারের সব সদস্যই জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়। এমনকি তারা আত্মঘাতী জঙ্গিবাদে বিশ্বাসী। জাকারিয়ার মা সালমা বেগম রীতিমত বাসায় অন্য মহিলাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত বয়ান করতেন। একমাত্র মেয়ে রিফা উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এমএসসি পাস করেছেন। আর ছোট ছেলে কিবরিয়া একটি কলেজে অনার্সে পড়ে। সেও জঙ্গিবাদ বিস্তারে কাজ করছিল। তারা তাদের জঙ্গি নেটওয়ার্ক সম্পর্কে তথ্য দেয়।
সেই তথ্য মোতাবেক গত ২ আগষ্ট রাতে পল্লবীর ডি ব্লকের ২৫ নম্বর সড়কের একটি জঙ্গি আস্তানা থেকে মোঃ মাহাদী হাসান ওরফে শান্ত হাসান (২০) নামের আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের এক জঙ্গিকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে বহু উগ্রবাদী বই, জঙ্গিবাদের আলামত সমৃদ্ধ মোবাইল ফোন ও বিভিন্ন অপারেশনে ব্যবহৃত দুইটি বিদেশী চাকু উদ্ধার হয়।
পুলিশের এন্টি টেররিজম ইউনিটের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহিদুজ্জামান জানান, মাহাদীর বাড়ি বাগেরহাট জেলার মোড়েলগঞ্জে। সে খুলনা, ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গার অন্তত ৯টি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছে। মাহাদী ফেসবুকের মাধ্যমে জাকারিয়ার গ্রুপের সঙ্গে পরিচিত হয়। ওই গ্রুপের সদস্য ছিল অনেক। ওই গ্রুপটির মধ্যে যারা ধর্মের প্রতি বেশি ভক্ত পরবর্তীতে তারা একটি পৃথক গ্রুপ তৈরি করে। সেই বিশেষ গ্রুপের মাধ্যমেই জাকারিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। তারা একটি সিক্রেট গ্রুপের সদস্য হিসেবে জঙ্গি তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল।
গ্রেফতারকৃত জাকারিয়া ও তার কয়েকজন সহযোগী জঙ্গিসহ বিট কয়েন সংগ্রহের চেষ্টা করছিল। বিট কয়েনের মাধ্যমে সংগঠনের জন্য অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরক সামগ্রী কেনার পরিকল্পনা ছিল তাদের। সংগঠনকে শক্তিশালী করার জন্য তারা সংগঠনের ভেতরে একটি স্পেশাল সিক্রেট (বিশেষ গোপনীয়) উইং চালু করেছে।
পুলিশ কর্মকর্তা আরও জানান, এবিটি সদস্যদের প্রশিক্ষণ, উগ্রবাদী বই ক্রয়, বিতরণ, সদস্যদের অন্যান্য খরচ, অনলাইনে জঙ্গি ও উগ্রবাদ প্রচারণার জন্য বিভিন্ন উৎস থেকে মাহাদী অর্থ সংগ্রহ করত। ইতোপূর্বে গ্রেফতার হওয়া জাকারিয়ার ছোট ভাই আবু সালেহ মোহাম্মদ কিবরিয়ার মাধ্যমে দেশীয় অস্ত্র কেনার জন্য মাহাদী বহুবার জাকারিয়াকে টাকা দিয়েছে। মাহাদীর কাছ থেকে জাকারিয়া প্রশিক্ষণ নেয়ার তীর, ধনুক, চাকুসহ দেশীয় অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। পরে মাহাদী আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। জবানবন্দীতে মাহাদী দাবি করেছেন, পল্লবীর ওই ব্যাংক কর্মকর্তার পরিবারে তার যাতায়াত ছিল। তারা তাকে জঙ্গি কর্মকান্ড চালাতে টাকা দিত। বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে বিকাশের মাধ্যমে মাহাদীকে অর্থ জোগাড় করে দিত ওই ব্যাংক কর্মকর্তার পরিবারের সদস্যরা।
এ ব্যাপারে এন্টি টেররিজম ইউনিটের পুলিশের অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, প্রায় এক বছর ধরে জঙ্গি সংগঠনগুলো তাদের হিজরত কার্যক্রম বা কৌশল বন্ধ রেখেছে বলে এখন পর্যন্ত তদন্তে ও বিভিন্ন সূত্রে প্রায় শতভাগ নিশ্চিত হওয়া গেছে। আগে যেমন তারা কাউকে হত্যা করতে বা বড় ধরনের নাশকতা চালাতে একটি সুইসাইডাল স্কোয়াড গঠন করত। সেই স্কোয়াডের সব সদস্যই স্বেচ্ছায় কয়েক মাস আগে বাড়ি থেকে নিখোঁজ হয়ে যেত। তারপর তারা অপারেশন চালাত। জঙ্গি সংগঠনগুলো আপাতত হিজরত কার্যক্রম বন্ধ রেখেছে। তবে তাদের তৎপরতা থেমে নেই। তারা দেশের প্রান্তিক পর্যায়ে থাকা তাদের সদস্যদের সঙ্গে প্রযুক্তির মাধ্যমে যোগাযোগ রাখছে। আর ঢাকায় স্বল্প দূরত্বে ব্যবধানে আস্তানা গাড়ছে। যাতে হেঁটে চিরকুটের মাধ্যমে এক আস্তানা থেকে আরেক আস্তানায় জরুরী সংবাদ পৌঁছাতে পারে। পদ্ধতিটি পুরনো হলেও, জঙ্গি সংগঠনগুলো বর্তমানে এটিকেই নিরাপদ মনে করছে। তবে চিরকুটের ভাষা জটিল ও সাংকেতিক। যেটি সংশ্লিষ্ট জঙ্গি গ্রেফতার না হওয়া পর্যন্ত তার অর্থ বের করা প্রায় অসম্ভব। জঙ্গি সংগঠনগুলোর গঠিত বিভিন্ন উইং স্বল্প পরিসরে কাজ করছে। পল্লবীর ওই জঙ্গি পরিবারের সূত্রধরে হালনাগাদ আরও তিনটি অভিযান হয়েছে। সবমিলিয়ে গ্রেফতার হয়েছে নয় জঙ্গি। তাদের কাছ থেকে আরও তথ্য পাওয়ার চেষ্টা অব্যাহত আছে। অভিযানে পাওয়া নানা বিষয়াদির পর্যালোচনা চলছে। তদন্তের স্বার্থে ও অভিযানের সুবিধার্থে সেসব তথ্য প্রকাশ করতে তিনি রাজি হননি।