সাবেক অর্থমন্ত্রী ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, সিলেটের সংস্কৃতিকে বিশ^দরবারে তুলে ধরতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অবদান অতুলনীয়। শতবর্ষ পূর্বে সিংহবাড়ীর সদস্যরা যেভাবে কবিগুরুকে বরণ করেছিলেন শতবর্ষ পরেও সে বাড়ির তৃতীয় প্রজন্ম যেভাবে তা উপস্থাপন করলেন তা অবিস্মরণীয়। সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিকাশই আমাদের সমাজকে আরো আলোকিত করতে পারে।
তিনি গতকাল ৬ নভেম্বর বুধবার বিকাল সাড়ে ৪টায় নগরীর চৌহাট্টাস্থ সিংহবাড়ীতে রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ স্মরণোৎসব উদযাপন অনুষ্ঠানে কবিগুরুর সৃষ্টিশীল কর্মকান্ড নিয়ে আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে উপরোক্ত কথাগুলো বলেন।
সাংস্কৃতিক সংগঠক সুমন্ত গুপ্ত ও সুকান্ত গুপ্তের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত ‘রবি বন্ধনা’ অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সমাজসেবী জ্যোর্তিময় সিংহ মজুমদার চন্দন।
সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা মন্ত্রী এম.এ মান্নান এমপি সিংহবাড়ীর পক্ষ থেকে নান্দনিক এ আয়োজনের প্রশংসা করেন। মুখ্য আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন গৌহাটি বিশ^বিদ্যালয়ের ভূতপূর্ব ডীন অধ্যাপক উষা রঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি তার বক্তব্যে সিলেটের মণিপুরী নৃত্যকে বিশে^র দরবারে তুলে ধরতে এবং সিলেটবাসীর সাহিত্যানুরাগ বাড়াতে কবিগুরুর অবদান তুলে ধরেন।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সিলেটের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ প্রফেসর এম.এ আজিজ বলেন, শতবর্ষ পূর্বে কবিগুরু যে সিলেট এসেছিলেন, তখনকার কেউ আজ বেঁচে নেই। কিন্তু সিংহবাড়ীর উত্তরাধিকারীরা আজও তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছেন।
অন্যান্যের মধ্যে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন প্রাক্তন সচিব এম.এ মুমিন, সিলেটে রবীন্দ্রনাথ শতবর্ষ স্মরণোৎসব উদ্যাপন পর্ষদের সদস্য সচিব সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, যুগ্ম আহবায়ক ব্যারিস্টার আরশ আলী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরী, সিলেট সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ¦ আশফাক আহমদ প্রমুখ।
এদিকে সকাল সাড়ে ৮টায় কবিগুরুর প্রতিকৃতি সহ চৌহাট্টা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার সম্মুখ থেকে শুভাযাত্রা সহকারে সিংহবাড়ীতে আগমন, স্থাপন ও প্রতিকৃতিতে মাল্যদান তৎপর উদ্বোধনী সংগীতের মাধ্যমে মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জলন করে দিনের প্রথম পর্বের শুভ উদ্বোধন করেন সিলেট রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমের সম্পাদক শ্রীমৎ স্বামী চন্দ্রনাথানন্দজী মহারাজ ও সিলেটের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক বিজিত কুমার দে। স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিংহবাড়ীর পক্ষে এডভোকেট সুজয় সিংহ মজুমদার। সকাল ৯টায় প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
১ম অধিবেশনে ‘চিত্রকল্পে রবীন্দ্রনাথ’ তরুণ প্রজন্মের ১১জন চিত্রশিল্পী তাদের ভাবনায় রবীন্দ্রনাথকে ফুটিয়ে তুলেন মনের ক্যানভাসে। অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন সিলেটের বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী অরবিন্দ দাশ গুপ্ত।
বৈকালিক অধিবেশনে অংশ গ্রহণ করেন শিল্পাঙ্গন, অনির্বান, গীতবিতান বাংলাদেশ, শ্রুতি, আনন্দলোক, নৃত্যশৈলী, রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ, ছন্দ নৃত্যালয়, রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী সংস্থা, এমকা, শান্তনা দেবী (দলীয় মণিপুরী নৃত্য)।
অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট সংগীত শিল্পীদের মধ্যে সংগীত পরিবেশন করেন রানা কুমার সিনহা, প্রতীক এন্দ, অনিমেষ বিজয় চৌধুরী, সুমনা আজিজ, বর্ষা মজুমদার পাপড়ি, শুক্লা চৌধুরী, সুস্মিতা চৌধুরী শাওন, অরুন্ধতী দত্ত পৃথা, ঢাকার বিশিষ্ট সংগীত শিল্পীদের মধ্যে সংগীত পরিবেশন করেন আঞ্জুমান আরা বকুল, নার্গিস রাহমান, মারিয়া ফারিন উপমা, প্রোটন বিশ^াস, ভারত থেকে আগাত সংগীত শিল্পী শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদার ও ড. পূবালী দেবনাথ।
দিনব্যাপী অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন সাংস্কৃতিক সংগঠক সুমন্ত গুপ্ত, সুকান্ত গুপ্ত ও নন্দিতা দত্ত। অনুষ্ঠানে ভারত, ঢাকা ও সিলেটের বিপুল সংখ্যক সাহিত্যামোদী ও সংস্কৃতিসেবীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণে এক মিলন মেলায় পরিণত হয় সিলেটের সিংহবাড়ী। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিদেরকে আপ্যায়ন করা হয়।
উৎসবে দল মত নির্বিশেষে সকলের অংশ গ্রহণ ও সহযোগিতায় এক সার্থক অনুষ্ঠান উপস্থাপনে সিংহবাড়ীর পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন অবসর প্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা সঞ্জয় সিংহ মজুমদার, ডাঃ সুধাময় মজুমদার ও ব্যাংক কর্মকর্তা সৌমিত্র সিংহ মজুমদার শুভ।
এদিকে বাতিঘর প্রকাশিত ‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯’ বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে।
বুধবার (৬ নভেম্বর) সন্ধ্যা ৭টায় পূর্ব জিন্দাবাজারস্থ বাতিঘর সিলেটে প্রকাশনাঅনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। রবীন্দ্র সঙ্গিত পরিবেশনের মাধ্যমে বই প্রকাশনা অনুষ্ঠানের সূচনা হয়।
প্রকাশনাঅনুষ্ঠানে সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেন, লেখক গবেষণায় অত্যন্ত পারদর্শী। তাই বইয়ের জন্য রবীন্দ্রনাথের জীবনের ১৯১৯ সালকে বেঁচে নিয়েছেন। এই সালে সিলেটে আসা ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের জীবনে অনেক উল্লেখ্য যোগ্য ঘটনা ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথ সিলেটে আসায় আমরা সমৃদ্ধ হয়েছি।
বইয়ের লেখা ও লেখার পেছনের গল্প নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন বইয়ের লেখক রবীন্দ্রগবেষক উষারঞ্জন ভট্টাচার্য। এছাড়াও ‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ১৯১৯’ বইয়ের বিভিন্ন লেখার বিশ্লেষণ করেন অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা এবং কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শুভেন্দু ইমাম। কবি প্রণব কান্তি দেবের সঞ্চালনায় স্বাগত বক্তব্য দেন বাতিঘরের স্বত্ত্বাধিকারী দীপঙ্কর দাশ।
বইয়ের লেখক উষারঞ্জন ভট্টাচার্য ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দকে রবীন্দ্রনাথের জীবনে এক মাইলফলক হিসেবে উল্লেখ করেন। এছাড়াও জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ডের (১৩ এপ্রিল) প্রতিবাদে কবি ইংরেজ সরকারের দেওয়া ‘নাইটহুড’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করে ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডের কাছে চিঠি লেখেন (৩০ মে) তেজোদ্বীপ্ত ভাষায়। মনের ভার কমাতে পেরে কবি আত্মস্থ হন, যেন ফিরে পান নিজেকে। লিপিকা-র অসামান্য গদ্যগুলো সেসময়ে লেখা।
১৯১৯ সালে কবির সিলেট ভ্রমণ নিয়ে লেখক বলেন, একবারমাত্র, কবি সিলেট ভ্রমণ করেন। আগমন ৪ নভেম্বর, প্রস্থান ৮ নভেম্বর। এই কদিনে বিভিন্ন সংবর্ধনা সভায় তিনি যে স্মরণীয় বক্তৃতা পেশ করেন সেগুলো আজও খুব প্রাসঙ্গিক মনে হয়। করিমগঞ্জ রেলস্টেশনে ট্রেন দাঁড়াত মিনিট তিনেক, কবির সম্মানে অভ্যর্থনার জন্য সেদিন রেল-কর্তৃপক্ষ বিরতির ব্যবস্থা করেছিলেন পঁচিশ মিনিট। সিলেটের মণিপুরী নৃত্য কী গভীর অনুপ্রেরণা সঞ্চারিত করেছিল কবির মনে তা বোঝা যায় তার নিজেরই নৃত্যনাট্যের ছাঁচে বা পরিকল্পনায়। এমন বহু মনোরম ও কৌতুহলোদ্দীপক তথ্য রয়েছে ‘সিলেটে রবীন্দ্রনাথ১৯১৯’ বইতে।
কবি ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শুভেন্দু ইমাম বলেন, এই বই পড়ে রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে ১০০ বছর আগের ইতিহাস জানা যাবে। সিলেট এসে কী করেছিলেন তা সম্পর্কে লেখা আছে এই বইয়ে। উনি তাৎক্ষনিক ভাবে বইটি লিখেছিলেন। লেখকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
অধ্যাপক গোলাম মোস্তাফা বলেন, এই বই লিখে তিনি রবীন্দ্রনাথ যে সিলেটে এসেছিলেন সেটা মনে করে দিয়েছেন। একজন গবেষকের প্রধান কাজ হচ্ছে তথ্য উদঘাটন করা এবং সুন্দর করে উপস্থাপন করে তোলা পাঠকদের কাছে। এক্ষেত্রে লেখক সফল। বিজ্ঞপ্তি