শোকার্ত অনুভূতির অমর নাম শেখ রাসেল

65

ফনিন্দ্র সরকার

শেখ রাসেল ছিল এক মানবাত্মার মূর্ত প্রতীক। সে জীবিত না থাকলেও অসংখ্য ভক্তসজ্জনের মাঝে বেঁচে আছে। অন্তরের গভীরে রাসেলের অবস্থান সুস্পষ্ট। সে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
আজ শেখ রাসেলের ৫৫তম জন্মদিন। হ্যাঁ, শেখ রাসেল আমাদের মহান নেতা জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছার কনিষ্ঠ পুত্র। এরা সবাই প্রয়াত। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগষ্টের অভিশপ্ত প্রত্যুষে একদল ঘাতকের বুলেটে এরা নিহত হন। স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত শক্তি তথা দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের যৌথ পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই এমন কলঙ্কজনক ঘটনার জন্ম হয়। স্বাধীনতার ৪৮ বছরেও ওই ষড়যন্ত্রকারীরা সক্রিয় রয়েছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক নানা ঘটনার পরম্পরায় আমাদের যাত্রা অব্যাহত আছে। ১৫ আগষ্টের ঘটনা সম্পর্কে সবাই জানেন। একটি রাজনৈতিক পরিবার, যে পরিবারটি গোটা বাঙালি জাতির আশা ভরসার কেন্দ্রস্থল ছিল। সেই পরিবারের ওপর যে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছিল তার বর্ণনায় গা শিহরিয়ে ওঠে। সেদিন মাত্র ১১ বছরের শিশু ছিল শেখ রাসেল। ফুটফুটে সুন্দর কোমলমতি উদ্ভাসিত একটি শিশুর জীবন কীভাবে শেষ করা হয়েছিল তা ভাবতে গেলে এখনো চোখের জল বাঁধ মানে না। সেই রাসেলের জন্মদিন নিয়ে লিখতে গিয়ে নানা প্রশ্নের অবতারণা হয় মনের মাঝে। জন্ম-মৃত্যু প্রকৃতির নিয়ম। এ নিয়মকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু মৃত্যুর নির্মমতায়, বিশ্ব বিবেককে কাঁদায়। শিশু রাসেল কোনো রাজনীতিক ছিল না। ওই বয়সে সে খেলনা নিয়ে খেলতো। তার দিনলিপি ছিল অন্য সাধারণ শিশুদের মতোই। তার পিতা রাষ্ট্রনায়ক বাংলাদেশের অধিকর্তা এমন ভাবনাও তার মধ্যে ছিল না। তা স্বাভাবিক কারণেই। ভবিষ্যতে সে কী হতে পারতো, কিংবা কী হতো পারতো না- তা আলোচনার দাবি রাখে না। তবে বাংলার সাধারণ মানুষের মনস্তাত্ত্বিক ভাবনার মধ্যে এ বিষয়টি স্থান পাওনা নিশ্চয়ই অমূলক নয় যে, রাসেলও বেঁচে থাকলে সুযোগ্য রাষ্ট্রনায়কই হতো। কেননা, তার শরীরে ছিল শৌর্য বীর্যের সাহসী রক্ত। আমি সামনা সামনি তাকে দেখিনি কখনো। কিন্তু একজন মহানায়কের পুত্র হিসেবে পর্দায় ভেসা উঠার চেহার কথা আজও জ্বলজ্বল করে। এ এক অভাবনীয় দৃশ্য। বঙ্গবন্ধু তার শিশুপুত্রকে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিয়ে যেতেন। ওই বয়সেও তাকে নির্ভীক একজন দেশ প্রেমিক সৈনিকের মতোই মনে হতো। চাহুনী কথা বলার ঢং ও অন্যান্য শিশুসুলভ আচরণের মাঝেও একটা ব্যক্তিত্বের ছাপ ফুটে উঠতো। কথায় আছে, বৈশিষ্ট্যমন্ডিত চেহারা নির্দেশ করে বড় হয়ে সে কী হবে। আমাদের অনুভূতির গভীরতায় শেখ রাসেলের চেহারায় যেন অন্য এক মহীয়ান পুরুষের অস্তিত্ব লুকিয়ে আছে। আশা-ভালোবাসা জাগানো হৃদয়ের অকৃত্রিম অনুসঙ্গ হিসেবে তিনি এখনো চলাচল করছে। তাকে ঘিরেই কিছু স্মৃতি হানা দেয় মনের দুয়ারে। ১৯৭৫ সালে আমি সবে এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি। মনে আছে ৩০ এপ্রিল আমাদের পরীক্ষা হয়েছিল। ঢাকা জেলার অন্তর্গত বর্তমানে সাভার উপজেলার নামকরা সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয় থেকে আমি এসএসসি পরীক্ষা দেই। এখনকার মতো এত দ্রুত রেজাল্ট হতো না। তাই ৩০ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত পরীক্ষার ফল বেড় হয়েছিল ১৫ আগষ্টের পর। সঠিক তারিখটা মনে পড়ছে না। আমার এক বড় ভাই ঢাকা কলেজের ছাত্র নিখিল দাস কলেজের মাইনরিটি হোস্টেলে থাকতেন। আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন তিনি। আমিও ঢাকা কলেজে পড়ব এমন আকাক্সক্ষা ছিল মনে। ১৯৭৫, ১৪ আগষ্টে আমি ঢাকা আসি। ঢাকা কলেজ দেখে খুবই আনন্দ পাই। স্থির করি নিখিলদার সঙ্গে হোস্টেলে গেস্ট হিসেবে থাকব কয়দিন, থেকে গেলাম। হোস্টেলের ডাইনিং-এ খাওয়া-দাওয়া সেরে রাতে ঘুমাই নিখিলদার সঙ্গে ডাবলিং করে। হোস্টেলের সব ছাত্রকেই ঘুম থেকে ভোর পাঁচটায় ওঠার নিয়ম ছিল। হোস্টেলের সামনে একটি বিরাট মাঠ। সেখানে বিভিন্ন ধরনের শরীর চর্চা করত ছাত্ররা। কেউ ফুটবল খেলত। সাড়ে ৬টা-৭টার দিকে আমি ও নিখিলদা কলেজের মূল ফটকে আসি। তখনও কলেজের প্রধান ফটকটির গেট খুলেনি। ফটকের সামনে আসামাত্র দেখি সেনাবাহিনীর কয়েকটা গাড়ি। গাড়িতে সেনারা অনেকটা বীভৎস মূর্তিতে অস্ত্র তাক করে বসে আছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই সেনারা আমাদের বাইরে আসতে বারণ করলো। আমরা ভেতরে চলে এসে হোস্টেলের রুমে ঢুকলাম। হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। এমন সময় হোস্টেলের ২য় তলায় থাকেন সহকারী তত্ত্বাবধায়ক স্যার ফনিভূষণ রায় মহাশয়। তিনি নিচে নেমে এসে সব ছাত্রদের উদ্দেশ্যে ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, “তোমরা রাস্তায় বেড় হবে না। বঙ্গবন্ধুকে মেরে ফেলেছে সৈনিকরা। কী অবিশ্বাস্য কথা। ওনার বাসায় সাদাকালো একটা টিভি ও একটি রেডিও ছিল। রেডিওতে বারবার ঘোষণা আসছে মেজর ডালিমের। ডালিমের কর্কশ ঘোষণা শুনে হতবাক হয়ে পড়ি। আমি বাড়িতে আসার জন্য ছটফট করতে থাকি। আমার বাড়ি ধামরাই থানার (বর্তমানে উপজেলা) আড়ালিয়া গ্রামে। সাভারের খুব কাছে বিধায় মাধ্যমিক পড়াশোনা করেছি সাভার অধরচন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে। যা হোক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর শুনলেও সপরিবারে হত্যার বিষয়টি তখনও বুঝতে পারিনি। ১৫ আগষ্ট বিকেলের দিকে সব কিছু খোলসা হলাম। বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ বেঁচে নেই। সেই সঙ্গে শেখ মণি সাহেব ও বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি রব সেরনিয়াবত সাহেবের বাড়িতেও হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। সন্ধ্যায় তত্ত্বাবধায়ক স্যারের বাসার ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখলাম। সমস্ত ঘটনা শুনে শোকে-দুঃখে-বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পড়লাম। পরিস্থিতি এমন কাঁদতেও পারছি না। ১৬ তারিখে শহরের পরিস্থিতি শান্ত হলে আমি বাড়িতে চলে যাই। আগস্ট মাস মানে ভাদ্র মাস, গ্রামে তখনও নৌকা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। সাভার থেকে নৌকায় আমাদের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেই। আমাদের গ্রামের বাজার ঘাটে নামামাত্রই পরিচিত একজন আমাকে বলে, “কিরে তোগ বঙ্গবন্ধুতো মইরা গেছে চাদ্দ করবি না? বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ছাও-আন্ডা শুদ্ধ মাইরা ফালাইছে!” বেবাকের চাদ্দ এক সঙ্গেই কইরা ফালা, মাথা ছুলবি না। টিটকারি সহকারে অনেক কথা বলে। তার সঙ্গে কথা না বাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে আসি। যিনি আমাকে টিটকারি দিয়ে ওই কথাগুলো বলছিল তিনি বর্তমানে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বড় নেতা। বিত্তবৈভবে টইটুম্বুর অবস্থা তার। সরকারি নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে কুলস্না ইউনিয়নের বেশ কিছু কৃষি জমিতে ইটখোলা নির্মাণ করেছে। এতে কৃষি জমি নষ্ট হচ্ছে। পরিবেশেরও ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। সহজ সরল দরিদ্র কৃষকদের লোভ-লালসার ফাঁদে ফেলে তাদের জমি ভাড়া নিচ্ছে কারও জমির মাটি কিনে ইট তৈরি করছে। ভবিষ্যতে ঐ সব জমি আত্মসাতের সুন্দর একটি নকশা তৈরি করে ফেলছে। তিনি ভূমি দুস্যতায় নেমেছেন। আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার সুবাদে তার বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দ করতে সাহস পাচ্ছে না। স্থানীয় সংসদ সদস্যও রহস্যজনক কারণে নীরব। যাক, এসব কথা- শেখ রাসেলের জন্মদিনে একথা বলার অর্থ হচ্ছে- ওই ব্যক্তিটি এখন শেখ পরিবারের ভক্ত হিসেবেই ঔদ্ধ্যত্ব প্রকাশ করছে। কার্যত, এটা তার অভিনয়। যে অভিনয়টা ঢাকার ক্যাসিনো গংরা করে আসছে। এতে শেখ রাসেলের আত্মা কষ্ট পাচ্ছে কিনা? জানি না। কষ্টতো পাবারই কথা। একটি নিষ্পাপ শিশুকে যে প্রক্রিয়ায় হত্যা করা হয়েছে তার বিচার সম্পন্ন হলেও শোকের ভার কমেনি এতটুকুও।
জীবের শ্রেষ্ঠত্ব মানব জন্ম। মানব জীবনের মানুষ নিজেকে ক্ষুদ্র চাওয়া পাওয়ার মধ্যে সম্পৃক্ত রেখে হয়েছে মোহগ্রস্ত। এই মোহগ্রস্ত থেকেই জিজ্ঞাসার উৎপত্তি। যারা জিজ্ঞাসা চরিতার্থ করতে রাসেলের মতো নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করেছে তাদের জীবনে দুঃখ, অশান্তি ও বিশৃঙ্খলা আমরা দেখেছি। জীবন ধারণের জন্য সাহায্য ও ব্যবহার্য দ্রব্যাদির প্রয়োজন অনস্বীকার্য। কিন্তু এগুলোকে জীবন সর্বস্ব করা চলে না। যারা এগুলোকে জীবন সর্বস্ব করতে পৈশাচিক হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে আজ তাদের স্থান কোথায়? ভেবে দেখুন!
শেখ রাসেল ছিল এক মানবাত্মার মূর্ত প্রতীক। সে জীবিত না থাকলেও অসংখ্য ভক্তসজনের মাঝে বেঁচে আছে। অন্তরের গভীরে রাসেলের অবস্থান সুস্পষ্ট। সে আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
সব উদার মানসিকতায়, সহযোগিতা এবং সব মৌলিক অনুভূতিতে রাসেল স্মরণীয় হবে বহুভাবে। সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে একটি চেতনা জাগ্রত হবে রাসেলের নিষ্পাপ দৃষ্টিকে কেন্দ্র করে। জাতি হিসেবে আমরা মানবতার প্রেম সিন্ধুতে অবগাহন করে পূর্ণ করব রাসেলের প্রত্যাশা। যে প্রত্যাশার বাণী অলৌলিকভাবেই পৌঁছে যাবে মানুষের দুয়ারে দুয়ারে।
লেখক : কলাম ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক।