মো. শামসুল ইসলাম সাদিক
অশান্তি দ্বন্দ্ব-সংঘাতে ঘেরা পৃথিবী। মানব জীবনের চেয়ে সস্তা কিছু নেই। বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় মাত্র ১০ টাকার জন্য খুন হচ্ছে মানুষ। সংবাদপত্রে চোখ রাখলেই নিহত স্বজনের আহাজারীর দৃশ্য দেখা যায়। সন্তানের হাতে পিতা, পিতার হাতে সন্তান, স্বামীর হাতে স্ত্রী, স্ত্রীর হাতে স্বামী, শিক্ষকের হাতে ছাত্র, ছাত্রের হাতে শিক্ষক, কর্মচারীর হাতে মালিক, মালিকের হাতে কর্মচারী, নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সাধারণ নাগরিক, নাগরিকের হাতে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য খুন যেন অস্বাভাবিক নিয়মের মধ্যে পড়ে। উন্নত ও সভ্য দেশগুলো দেওলিপনা দেখাতে গিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আগ্রাসন চালিয়ে খুন করা হচ্ছে নিরপরাধ মানুষ। মুসলিম দেশগুলোকে মানবাধিকারের দোহাই দেয়, অথচ তারাই মজলুম মুসলিম দেশগুলোয় প্রতিনিয়ত নিষ্পাপ শিশু ও অসহায় নারী ও বৃদ্ধদের ওপর বোমা নিক্ষেপ করছে। পৃথিবীর চারদিকে মুসলিমদের খুনের ছোপছোপ দাগ। বাংলাদেশের নাগরিকরাও হত্যার নৈরাজ্য থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না। লাশের মিছিল থেমে নেই বরং দীর্ঘতম হচ্ছে। এমতাবস্থায় ইসলামই হতে পারে হতাশায় আলোকদিশা। আমাদেরকে অবশ্যই ইসলামের শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে। তুলে ধরতে হবে ইসলামের মহান আদর্শ।
কুরআন ও হাদিস মানব হত্যাকে হারাম ঘোষণা করেছে। অন্যায়ভাবে অপরের প্রাণ হরণ করা বড় গুনাহ। শুধু তা নয় পৃথিবীতে বড় গুনাহ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সাথে কাউকে অংশীদার বা শরীক করা। তারপর বড় গুনাহ অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা। সৃষ্টিকর্তা বলেন- ‘এসো, তোমাদের ওপর তোমাদের রব যা হারাম করেছেন, তা তিলাওয়াত করি যে, তোমরা তার সাথে কোন কিছুকে শরীক করবে না এবং মা-বাবার প্রতি ইহসান করবে আর দারিদ্র্যের কারণে তোমাদের সন্তানদেরকে হত্যা করবে না। আমিই তোমাদেরকে রিযিক দেই এবং তাদেরকেও। আর অশ্লীল কাজের নিকটবর্তী হবে না- তা থেকে যা প্রকাশ পায় এবং যা গোপন থাকে। আর বৈধ কারণ ছাড়া তোমরা সেই প্রাণকে হত্যা করো না, আল্লাহ যা হারাম করেছেন। এগুলো আল্লাহ তোমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা বুঝতে পার’ (সূরা:আন‘আম,আয়াত-১৫১)। অন্যত্রে- ‘আর যারা আল্লাহর সাথে অন্য ইলাহকে ডাকে না এবং যারা আল্লাহ যে নাফ্সকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর যারা ব্যভিচার করে না। আর যে তা করবে সে আযাবপ্রাপ্ত হবে। কিয়ামতের দিন তার আযাব বর্ধিত করা হবে এবং সেখানে সে অপমানিত অবস্থায় স্থায়ী হবে’ (সূরা: ফুরকান, আয়াত -৬৮,৬৯)। অন্যায়ভাবে হত্যা করা হলে ইসলাম তার প্রতিকারের কার্যকর ব্যবস্থার নির্দেশ দিচ্ছে। ‘আর তোমরা সেই নাফসকে হত্যা করো না, যা আল্লাহ হারাম করেছেন, সঙ্গত কারণ ছাড়া। যে অন্যায়ভাবে নিহত হয় আমি অবশ্যই তার অভিভাবককে ক্ষমতা দিয়েছি। সুতরাং হত্যার ব্যাপারে সে সীমালঙ্ঘন করবে না; নিশ্চয় সে হবে সাহায্যপ্রাপ্ত’ (সূরা: বনী ইসরাইল, আয়াত-৩৩)। অন্যায় অবিচারের ভরপুর জগতে অনেকে ইসলামের বিধানকে অমানবিক আবার অবিশ্বাসী বর্বর পর্যন্তও বলেছেন। অথচ পৃথিবীতে ইসলমের দ্বারা মানবজাতির মুক্তি ও শান্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। ইসলামকে যারা বর্বর বলে তারা শুধু জ্ঞানপাপীই নয় বরং মূর্খও বটে। ইসলামই পৃথিবীর একমাত্র ধর্ম যেখানে নিরপরাধ মানুষ হত্যাকে মানবতাবিরোধী ও মানবজাতির হত্যার তুল্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত করে। সৃষ্টিকর্তা বলেন- ‘এ কারণেই, আমি বনী ইসরাঈলের ওপর এই হুকুম দিলাম, যে ব্যক্তি কাউকে হত্যা করা কিংবা যমীনে ফাসাদ সৃষ্টি করা ছাড়া যে কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল। আর যে তাকে বাঁচাল, সে যেন সকল মানুষকে বাঁচাল। আর অবশ্যই তাদের কাছে আমার রাসূলগণ সুস্পষ্ট নিদর্শনসমূহ নিয়ে এসেছে। তা সত্ত্বেও এরপর জমিনে তাদের অনেকে অবশ্যই সীমালঙ্ঘনকারী’ (সূরা: মায়েদা, আয়াত ৩২)।
হাদিসের আলোকে: আনাস বিন মালেক (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা:) বলেন- কবীরা গুনাহগুলোর মধ্যে সবচে বড় গুনাহ হলো আল্লাহর সঙ্গে শিরক করা, নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করা, পিতামাতার অবাধ্য হওয়া এবং মিথ্যা কথা বলা (বুখারী ও মুসলিম)। অন্য হাদিসে বর্ণিত- কিয়ামতের দিন মানুষের মধ্যে প্রথম বিচার করা হবে রক্তপাত সম্পর্কে (বুখারী ও মুসলিম)। আবু হুরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত- রাসূল (সা:) বলেন- তোমরা সাতটি ধ্বংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাক। সাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল সেগুলো কী? তিনি বললেন- আল্লাহর সাথে শরীক করা, জাদু করা, অন্যায়ভাবে নিরপরাধ লোককে হত্যা করা, সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করা, রণক্ষেত্র থেকে পলায়ন করা, সুরক্ষিত পবিত্রা নারীকে অপবাদ দেওয়া (বুখারী ও মুসলিম)। ইবন আব্বাস (রা:) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা:) বলেন- কিয়ামতের দিন নিহত ব্যক্তি হন্তারককে নিয়ে আসবে। হন্তারকের চুলের অগ্রভাগ ও মাথা নিহতের হাতের মুষ্ঠিতে থাকবে আর তার কণ্ঠনালী থেকে তখন রক্ত ঝরতে থাকবে। সে বলবে, হে প্রভু, এ ব্যক্তি আমাকে হত্যা করেছে। এমনকি সে তাকে আরশের কাছে নিয়ে যাবে (তিরমিযী ও মুসনাদ আহমদ)। আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা:) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- যেসব পরিত্রাণ অযোগ্য ধ্বংসে মানুষ পতিত হয় তার অন্যতম হলো বৈধ কারণ ছাড়া নিষিদ্ধ রক্ত ঝরানো (বুখারী)।
হত্যা ও খুনোখুনি থেকে পরিত্রাণের উপায় আমাদেরকে নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধের অবক্ষয় ও মানবিক গুণাবলি জাগ্ররত করতে হবে। ‘মানুষের কৃতকর্মের দরুন স্থলে ও সমুদ্রে ফাসাদ প্রকাশ পায়। যার ফলে আল্লাহ তাদের কতিপয় কৃতকর্মের স্বাদ তাদেরকে আস্বাদন করান, যাতে তারা ফিরে আসে’ (সূরা: রূম, আয়াত ৪১)। হত্যাকান্ডের রাহুগ্রাস থেকে পরিত্রাণ পেতে আমাদের আল্লাহর আইনের সুফল অনুধাবন করতে হবে, আইনের শাসন ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, প্রয়োজনে নিজেদের সব ধরনের অন্যায়, অবিচার ও যাবতীয় পাপাচার থেকে দূরে থাকতে হবে। পার্থিব জীবনে ভোগ লালসায় মানুষকে অন্ধ ও বধির বানিয়ে রেখেছে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে খোদাভীতি ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে সব ধরনের অশ্লীলতা ও বেহায়পনা থেকে দূরে রাখতে হবে। আমাদের ব্যক্তিগত আমল ও আচরণের দিকে তাকালেই সেটা পরিষ্কার। সৃষ্টিকর্তা আমাদের অনুধাবন ও সংশোধনের তাওফীক দান করুন। আমীন।
লেখক: শিক্ষার্থী, এম. সি কলেজ- সিলেট।