পাড়া-মহল্লায় জুয়ার আসর বন্ধ হয়নি ॥ মাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাতি নেতারা

19

কাজিরবাজার ডেস্ক :
চলমান শুদ্ধি অভিযানে বেশ ক’জন গডফাদার গ্রেফতার হওয়ায় নিজেদের ডেরা ছেড়ে গা-ঢাকা দিয়েছেন মদ-জুয়া-ক্যাসিনোসহ বিভিন্ন অপকর্ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালরা। এ সুযোগে ফাঁকা মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাতি নেতা এবং উঠতি সন্ত্রাসীরা। এদের কেউ কেউ দলবল নিয়ে এলাকায় ছোটোখাটো মহড়া দিয়ে নিজের শক্তি-সামর্থ্যরে জানান দিচ্ছেন। গডফাদারদের অবর্তমানে ইয়াবা বাণিজ্য, কলকারখানা-দোকানপাটের চাঁদা, পরিবহন খাতের মাসোহারা এবং টেন্ডারের কমিশন ছাড়াও অন্যান্য অবৈধ খাতের উপরি অর্থ এখন থেকে তাদের হাতে দিতে হবে, তা বুঝিয়ে দিতে তারা প্রকাশ্যে হুমকি-ধামকিসহ নানা অপতৎপরতা চালাচ্ছেন।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, ক্লাবপাড়ার ক্যাসিনো বাণিজ্য আপাতত বন্ধ হলেও পাড়া-মহলস্নার জুয়ার আসর আগের মতোই চলছে। তবে ধরা পড়ার ভয়ে অনেকে এ ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করছে। ইয়াবার পাশাপাশি অন্যান্য মাদকদ্রব্য আগের মতোই সহজ লভ্য রয়েছে। তবে বেচাকেনায় সতর্কতা কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া ফুটপাতে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি, মেয়াদোত্তীর্ণ অটোরিকশা-লেগুনা পরিচালনা, অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়ে ফুটপাতের দোকানিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়, রেলওয়ে কিংবা গণপূর্তের জায়গা দখল করে দোকান ভাড়া, ঠিকাদারদের জিম্মি করে চড়া দরে বিভিন্ন মালপত্র সরবরাহের কাজ দিতে বাধ্য করা ও এলাকাভিত্তিক দখলবাজি শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর একদিনের জন্যও বন্ধ হয়নি।
এদিকে পাতি নেতারা মাঠে দাপিয়ে বেড়ালেও পর্দার আড়ালে গডফাদাররাই তাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে গোয়েন্দারা অনেকে সন্দেহ পোষণ করছেন। তাদের ভাষ্য, চলমান অভিযানের গতি-পরিধি ও সময়কাল এখনো সবার অজানা। তাই এসব ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে পাতি নেতাদের এত বড় দুঃসাহস দেখানোর প্রশ্নই ওঠে না। এছাড়া কিছু ছোটোখাটো চাঁদার অর্থ আদায়ের দায়িত্ব আগে থেকেই পাতি নেতাদের ওপর দেওয়া ছিল। হয়তো এর সঙ্গে তারা আরও কিছু পরিধি বাড়িয়ে নিতে পারে। তবে বড় অংকের চাঁদাবাজি-দখলবাজিসহ আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ এখনো গডফাদারদের হাতেই রয়েছে বলে মনে করেন তারা।
এদিকে গডফাদারশূন্য শাহজাহানপুর থানা এলাকায় ছাত্রলীগের এক পাতি নেতা দোকানপাটে চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে অবৈধ পরিবহন ব্যবসা, দখলবাজি ও ফুটপাতের হকারদের কাছ থেকে নিয়মিত ‘তোলা’ আদায়সহ সব ধরনের অপকর্ম নিজ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। স্থানীয় থানা পুলিশের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা তাকে এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া মতিঝিল, বাসাবো, সবুজবাগ, মানিকনগর, যাত্রাবাড়ী, ডেমরা ও ধোলাইরপাড় এলাকায়ও নতুন করে পাতি নেতাদের দাপিয়ে বেড়ানোর বিস্তর অভিযোগ রয়েছে।
অন্যদিকে চলমান অভিযান শুরুর পর রাজধানীর তিলপাপাড়া, মেরাদিয়া, গোড়ান ও নন্দীপাড়া এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের দুর্নীতিবাজ গডফাদাররা গা-ঢাকা দেওয়ার পর সেখানকার পাতি নেতারা স্বক্রিয় হয়ে না ওঠায় স্থানীয় থানা পুলিশের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের হাল ধরেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা রাস্তার ভ্রাম্যমান দোকান বসানোর জন্য গত কয়েকদিনে অন্তত একশ’ দোকানির কাছ থেকে ১০ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত সেলামি আদায় করেছেন। এছাড়া তারা ওইসব দোকানির কাছ থেকে দৈনিক দেড়শ’ থেকে দুইশ’ টাকা চাঁদা তুলছেন। গডফাদারশূন্য কমলাপুর, ফকিরাপুল, আরামবাগ, পল্টন ও কাকরাইল এলাকায়ও পাতি নেতাদের তৎপরতা না থাকায় সেখানেও কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য ফুটপাতের চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে গডফাদারদের অনুপস্থিতিতে পাতি নেতাদের সক্রিয় হয়ে ওঠার অভিযোগ থানা পুলিশ স্বীকার না করলেও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এ বিষয়টি স্পষ্ট। এছাড়া পুলিশ হেডকোয়ার্টার এবং ডিএমপি সদর দপ্তরেও ভুক্তভোগীদের বিস্তর অভিযোগ জমা পড়েছে বলে জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, চলমান শুদ্ধি অভিযানের পর গডফাদারদের অন্তর্ধান এবং পরবর্তী সময়ে কোন এলাকায় নতুন করে কারা অপরাধ নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে তার তালিকা তাদের হস্তগত হয়েছে। এদের মধ্যে বেশির ভাগই পাতি নেতা হলেও কয়েকজন মাঝারি মাপের নেতাও রয়েছেন। শুদ্ধি অভিযানের কাক্সিক্ষত সফলতা অর্জনে সরকার এ চক্রের বিরুদ্ধেও সাঁড়াশি অভিযান চালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে ছোটো নেতাদের কাউকে ফাঁসিয়ে দিতে বড় কোনো নেতা কিংবা অন্য কেউ কৌশলে নতুন নিয়ন্ত্রণকারীদের তালিকায় কারও নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে কি না তা আগে খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।