কাজিরবাজার ডেস্ক :
জামিনে ছাড়া পেয়েই লাপাত্তা হয়ে যাচ্ছে জঙ্গিরা। এমন জঙ্গির সংখ্যা আট শ’ ছাড়িয়েছে। তারা আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। জামিনের পর আত্মগোপনে চলে যাওয়া জঙ্গিদের মধ্যে অনেকেই পালিয়ে বিদেশ চলে গেছেন। এরমধ্যে বিশ্বের অন্যতম একটি ক্ষমতাধর দেশেই রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছে অন্তত দুই শ’ জঙ্গি। আত্মগোপনে থেকে জঙ্গিরা দেশী ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মাঝে মধ্যেই হামলার ঘটনা ঘটিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সম্প্রতি গুলিস্তানে ও মালিবাগে স্বল্প সময়ের ব্যবধানে হামলার পর আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের দায় স্বীকারের পর নতুন করে দেশে জঙ্গিবাদের বিষয়টি আলোচনার জন্ম দিয়েছে। র্যাবের পরিসংখ্যান মোতাবেক তাদের হাতে যে পাঁচ শতাধিক জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছিল, তার মধ্যেই অন্তত তিন শ’ জনই জামিন নিয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। এজন্য জঙ্গিদের পক্ষে আইনী লড়াই না করতে আইনজীবীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ।
রবিবার রাজধানীর কাওরান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে ঈদ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, স্বল্প সময়ের ব্যবধানে গুলিস্তানে ও মালিবাগে পুলিশের গাড়িতে বোমা হামলার ঘটনা ঘটে। দুইটি ঘটনার সঙ্গে আইএস জড়িত থাকার দায় স্বীকার করেছে বলে গণমাধ্যমের খবরেও বেরিয়েছে। দুটি পৃথক হামলায় পাঁচ পুলিশসহ ছয়জন আহত হন। এজন্য স্বাভাবিক কারণেই মানুষের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করতে পারে। তবে ভয়ের কোন কারণ নেই। র্যাব সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে। সারাদেশে নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযানে অনেক জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছিল। তাদের অনেকেই জামিনে বেরিয়ে গেছে। তাদের অধিকাংশই পলাতক, হদিস মিলছে না।
বেনজীর আহমেদ আইনজীবীদের উদ্দেশে বলেন, অন্যান্য অপরাধের মতো জঙ্গিবাদকে বিবেচনা করা উচিত নয়। তাদের আইনী সহায়তা দিলে বিষয়টি আত্মঘাতী হবে। জঙ্গিবাদকে ভিন্নভাবে দেখতে আইনজীবীদের জঙ্গিদের পক্ষে আইনী লড়াই না করার অনুরোধ করেন তিনি। র্যাব প্রধান বলেন, হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পর থেকে এখন হালনাগাদ চালানো অভিযানে শুধু র্যাবের হাতেই ৫১২ জঙ্গি গ্রেফতার হয়। এর মধ্যে অন্তত তিন শ’ জঙ্গি জামিন পেয়ে গেছে, যাদের অধিকাংশই পলাতক।
আইনজীবীদের উদ্দেশে র্যাব মহাপরিচালক আরও বলেন, টাকা দিলেই জঙ্গিদের পক্ষে আদালতে দাাঁড়ানো উচিত নয়। চুরি-ডাকাতি, ছিনতাইয়ের মতো অন্য আট দশটি অপরাধের মতো জঙ্গিবাদকে দেখা যাবে না। তাহলে বিষয়টি হবে আত্মঘাতী। জঙ্গিরা আদালতেও হামলা করেছে। কেউ তাদের আওতার বাইরে নয়।
আইনজীবীরা যারা জঙ্গিদের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করে জামিনের ব্যবস্থা করেছেন, ওসব জঙ্গিদের আবার আদালতে হাজির করেন। কোন সমস্যা নেই। দেখবেন যাদের জামিন করিয়ে দিয়েছেন, ওই জঙ্গিদের অধিকাংশই পলাতক। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় তিন পর্যায়েই জঙ্গি হামলার ঝুঁকি আছে। এজন্য গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করে তৎপরতা চালানো হচ্ছে। যে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করা হবে।
তিনি দেশবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, জামিনে পলাতক জঙ্গিরা আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। তবে তারা বেশি দিন তৎপরতা চালাতে পারবে না।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, সরকারী নথিপত্র অনুযায়ী ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকেই শিবির নেতাকর্মী পরিচয়ে দুর্র্ধষ ১২৭ এবং নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের ১৬ জঙ্গি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। জামিন পেয়েই তারা লাপাত্তা। আর কারাগারটিতে বন্দী হিযবুত তাহরীরের ৩২ ও শিবিরের ১৯ জঙ্গি জামিনে ছাড়া পেতে নানা পর্যায়ে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।
ছাত্রশিবির পরিচয়ে ছাড়া পাওয়া ১২৭ জনের মধ্যে অধিকাংশই বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য। তাদের সম্পর্কে আর কিছুই জানা যায়নি। অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। অনেকেই আবার ছাত্রশিবির, বিভিন্ন ইসলামী দল ও সরকারী দলের লেবাসে প্রকাশ্যেই তৎপর চালাচ্ছে। আত্মগোপনে যাওয়া জামিনপ্রাপ্তরা আদালতে হাজির হয় না। তাদের হয়ে কতিপয় আইনজীবী আদালতে আইনী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। জামিনপ্রাপ্তদের অধিকাংশই একাধিক মামলার আসামি।
পুুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীরের চার ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রথম সারির পাঁচ নেতা বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে। দেশের পাশাপাশি মালয়েশিয়া থেকেও তারা আনসার আল ইসলামের নামে প্রচার প্রোপাগান্ডা ও কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইতোমধ্যেই নিষিদ্ধ আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের হয়ে বিদেশ থেকে দেশে ফিরে অপতৎপরতা চালানোর সময় কয়েকজন গ্রেফতার হয়েছে। তারা জঙ্গি সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতা মুফতি জসীমুদ্দিন রাহমানিকে কারামুক্ত করতে দেশে অর্থ পাঠাতেন বলে স্বীকার করেছে।
জামিনে ছাড়া পেয়ে লাপাত্তা হয়ে যাওয়ার বিষয়টি সম্পর্কে জামায়াতের এক শীর্ষস্থানীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, শুধু ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার নয়, দেশের বিভিন্ন কারাগার থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন শিবিরসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। তাদের জামিনে ছাড়িয়ে নেয়া হয়েছে। সরকার পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রকাশ্যে না আসতেও দলীয় নির্দেশ রয়েছে। জামিনপ্রাপ্তরা আদালতে হাজিরা দেন না। এটি আত্মগোপন নয়। দলীয় নির্দেশনা মোতাবেক এটি তাদের কৌশলগত অবস্থান।
গত কয়েক বছরে জঙ্গিদের হাতে নৃশংস হত্যাকান্ডের ঘটনার তদন্তকারী সংস্থাগুলো সূত্রে জানা গেছে, জামিন পেয়ে আত্মগোপনে থাকা অনেকেই বিদেশ পাড়ি জমিয়েছে। দেশে আত্মগোপনে থাকা অনেকের নামই শিক্ষক, ব্লগার, লেখক, প্রকাশক ও মুক্তমনা মানুষ হত্যার ঘটনায় নানাভাবে ঘুরে ফিরে আসছে। সিআইডি সূত্র বলছে, চট্টগ্রাম থেকে একটি অত্যাধুনিক স্নাইপার রাইফেল উদ্ধার হয়। যেটি বিশ্বের একটি সুপার পাওয়ার দেশের রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তায় নিয়োজিত বিশেষ বাহিনীর সদস্যরাই শুধু ব্যবহার করে থাকেন। এছাড়া পৃথিবীর কোন দেশেই ওই রাইফেলের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়নি। রাইফেল উদ্ধারের ঘটনায় গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে দু’জন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিল। তারা ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এমন একটি বাহিনীর অস্ত্র কিভাবে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, সে বিষয়ে বিস্তর অনুসন্ধান অব্যাহত আছে।
জঙ্গিদের মামলা মনিটরিং সেল ও মামলার তদন্ত সংস্থাগুলো সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারের পর জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাম পরিচয়, পেশা ও প্রকৃত ঠিকানা পরিকল্পিতভাবে ভুল দেয়। বিপুলসংখ্যক আসামির সঠিক নাম ঠিকানা অধিকাংশ সময়ই যাচাই বাছাই করা সম্ভব হয় না। এছাড়া গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সঠিকভাবে তদন্ত না করেই মামলার চার্জশীট দেয়া হচ্ছে।
আর আইনজীবীরা জামিন আবেদনে বলছেন, পুলিশ চাহিদা মোতাবেক টাকা না পেয়ে আটকদের জামায়াত-শিবির ও জঙ্গি সদস্য বলে উল্লেখ করে আদালতে সোর্পদ করেছে। তারা নিষিদ্ধ কোন সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নয়। আসামিদের পক্ষে ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় উপযুক্ত প্রমাণাদি মামলার নথিপত্রের সঙ্গে না থাকায় গ্রেফতারকৃতদের জামিন পাওয়ার পথ সহজ হচ্ছে। জামিনপ্রাপ্তরা আবার চলে যাচ্ছে আত্মগোপনে। জড়িয়ে পড়ছে জঙ্গি হামলাসহ নানা নাশকতামূলক কর্মকান্ডে। এজন্যই জঙ্গিদের প্রযুক্তিনির্ভর ডেটাবেজ করার কাজ চলছে। হালনাগাদ প্রায় দুুই হাজার জঙ্গির নাম তালিকাভুক্ত হয়েছে ওই ডেটাবেজে। ডেটাবেজে স্থান পেয়েছে ভারতের বর্ধমান বিস্ফোরণের ঘটনায় সেদেশের জাতীয় তদন্ত সংস্থার দেয়া জঙ্গিদের নাম। এছাড়া ’১৬ সালে সিঙ্গাপুর থেকে ফেরত পাঠানো ৩১ জনের মধ্যে কারাবন্দী ১৯ জনকে ডেটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। মুক্ত থাকা ১২ জনকে গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। বিদেশে অবস্থানকারী জঙ্গিদেরও নাম রাখা হয়েছে ডেটাবেজে। ডেটাবেজে বাংলাদেশের প্রায় ৪০ ইসলামী সংগঠনের নামও স্থান পেয়েছে। এসব সংগঠনগুলো র্ধর্মীয় উগ্র মতবাদ ও দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের পক্ষে রয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে।
এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেছেন, জঙ্গি, জঙ্গি ও উগ্র মৌলবাদী সংগঠন, সংগঠনের নেতা, সংগঠনের কার্যক্রমসহ শুরু করে সবকিছুরই তথ্য সংরক্ষণ করা হয়। এমনকি নিয়মিত মনিটরিং অব্যাহত আছে।
বিষয়টি সম্পর্কে পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেছেন, সরকার জঙ্গিদের ক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স নীতি ঘোষণা করেছে। জঙ্গিদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংবলিত ডাটাবেজ তৈরির কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। অনেক জঙ্গি সংগঠন সম্পর্কেই তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।