শাহ মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম
এক.
হিজরী সন মুসলিম উম্মাহ’র আপন সন। হজ্ব যাকাত রোজা শবেকদর শবে বরাত শবে মে’রাজ আশুরা ইতিকাফ তারাবীহ দুই ঈদ সাদকাতুল ফিতর কুরবানী শাওয়ালের ৬ রোজা ইত্যাদি ইবাদত হিজরী সনের সাথে সম্পৃক্ত। মহান আল্লাহ মানুষকে ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছেন। ঈমানের পর ইবাদাত হচ্ছে মানুষের মূল আরাধনা। হিজরী সনের মাস সমূহ এই উপাসনার সাথে জড়িয়ে আছে ওতপ্রোতভাবে। সুতরাং মুসলমানদের জন্য হিজরী সন গণণা আবশ্যক। হিজরী সন হচ্ছে চান্দ্র সন। এ সনের প্রথম মাস হচ্ছে মুহররাম। আগামী ২৯ জিলহজ্ব/১৪৪০ রোজ শনিবার সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে মহররমের চাঁদ দেখা গেলেই বিদায় নিবে ১৪৪০হিজরী। পরদিন শুরু হবে হিজরী নববর্ষ ১ মহররম ১৪৪১ হিজরী।
এবার শুরু ও শেষের দিকে বাংলাদেশি হাজীদের হতাহতের দুটি দুঃখজনক মর্মান্তিক ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হলো হজ্ব। আল্লাহর ঘরের মেহমান হাজী সাহেবানদের আপন ঘরে ফেরার মধ্যেই শুভাগমন হচ্ছে ১৪৪১ হিজরীর। ইবাদত-বন্দেগীর নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার ও মুসলমানদের দুর্গতির অবসানের প্রত্যাশায় আল্লাহর বান্দাদের কাছে নতুন বছরের গুরুত্ব অপরিসীম। মুসলিম হিসেবে হিজরী নববর্ষ উদযাপন কিংবা মুসলমানদের গৌরবের এ দিনটি পালনের ঐতিহ্য আমাদের সংস্কৃতিতে ব্যাপকতা লাভ করেনি। অনেকে আমরা জানিও না যে, হিজরী নববর্ষ কখন আসে আর কখন যায়? আমরা হিজরীবর্ষ গণনার সঠিক ইতিহাস জানার গরজও অনুভব করি না। অথচ মুসলিম হিসেবে এটি আমাদের সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ হওয়া উচিৎ ছিল। একটি ধারাবাহিক আলোচনায় এ প্রসঙ্গেই যৎকিঞ্চিৎ আলোচনার প্রয়াস পাব।
দুই.
কুরআন মাজীদে চন্দ্র-সূর্য এবং সন ও মাস প্রসঙ্গ
মহান আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য বুঝা বড়ই কঠিন। তারপরও মানুষের সসীম শক্তি অসীমের সন্ধানে সর্বাদাই তৎপর রয়েছে। যমীন-আকাশ, চাঁদ সুরুজ, নক্ষত্র-তারা, গ্রহ-উপগ্রহ, নীহারিকা-ছায়াপত, সবুজ বনানী, সাগর-নদী, পাহাড়-পর্বত প্রবৃত্তির সৃষ্টি রহস্য মানুষ জানতে চায়। মানুষের অনুসন্ধিৎসার শেষ নেই। মহান আল্লাহ তৎপ্রতি প্রণোদনা দিয়ে কুরআন মাজীদে ঘোষণা করেছেন-
إِنَّ فِي خَلْقِ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافِ اللَّيْلِ وَالنَّهَارِ وَالْفُلْكِ الَّتِي تَجْرِي فِي الْبَحْرِ بِمَا يَنْفَعُ النَّاسَ وَمَا أَنْزَلَ اللَّهُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ مَاءٍ فَأَحْيَا بِهِ الْأَرْضَ بَعْدَ مَوْتِهَا وَبَثَّ فِيهَا مِنْ كُلِّ دَابَّةٍ وَتَصْرِيفِ الرِّيَاحِ وَالسَّحَابِ الْمُسَخَّرِ بَيْنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
‘নিশ্চয়ই আকাশম-ল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, রাত ও দিনের পরিবর্তনে, যা মানুষের হিত সাধন করে তাসহ সমুদ্রে বিচরণশীল নৌজানসমূহে, আল্লাহ আকাশ হতে যে বারিবর্ষণ দ্বারা, পৃথিবীকে তাঁর মৃত্যুর পর পুনর্জ্জীবিত করেন তাতে এবং তার মধ্যে যাবতীয় জীবজন্তুর বিস্তারণে, বায়রু দিক পরিবর্তনে, আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে নিয়ন্ত্রিত মেঘমালাতে জ্ঞানবান জাতির জন্য নির্দেশ রয়েছে। (সূরা বাকারা-২/১৬৪)
সৃষ্টির শুরু থেকেই মাসের সংখ্যা ছিল বারো, এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেন-
إِنَّ عِدَّةَ الشُّهُورِ عِنْدَ اللَّهِ اثْنَا عَشَرَ شَهْرًا فِي كِتَابِ اللَّهِ يَوْمَ خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ مِنْهَا أَرْبَعَةٌ حُرُمٌ ذَلِكَ الدِّينُ الْقَيِّمُ فَلَا تَظْلِمُوا فِيهِنَّ أَنْفُسَكُمْ
‘নিশ্চয়ই আকাশম-লী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর বিধানে আল্লাহর নিকট মাস গণনায় মাস বারোটি, এর মধ্যে চারটি নিষিদ্ধ মাস, এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এ সম্মানিত মাসসমূহে তোমরা নিজেদের উপর যুলুম করো না।’ (সূরা তাওবা : ৯/৩৬)
মহান আল্লাহ আরো বলেন-
هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُورًا وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ مَا خَلَقَ اللَّهُ ذَلِكَ إِلَّا بِالْحَقِّ يُفَصِّلُ الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ
তিনিই সূর্যকে তেজস্কর ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং তাদের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছেন-যাতে তোমরা বছর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পার। আল্লাহ এসব নিরর্থক সৃষ্টি করেন নি। যাতে জ্ঞানী লোকেরা তাঁর নিদর্শন পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে।’ (সূরা ইউনুস ১০/৫)
মানুষের দৃষ্টি যতদূর যায়, দূরবীক্ষণে রকেটে দূর হতে দূরান্তরে ফাঁকা জায়গা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। এই অসীম ফাঁকা স্থানের মাঝে আছে অগণিত লক্ষ কোটি তারার রাজ্যÑআছে সূর্য, চন্দ্র গ্রহ, উপগ্রহ, পৃথিবী। এসব মিলে এ রাজ্যের নাম আসমান-নীল আকাশ। মহান আল্লাহ আরো বলেন,
اللَّهُ الَّذِي رَفَعَ السَّمَاوَاتِ بِغَيْرِ عَمَدٍ تَرَوْنَهَا ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ مُسَمًّى يُدَبِّرُ الْأَمْرَ يُفَصِّلُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ بِلِقَاءِ رَبِّكُمْ تُوقِنُونَ
‘আল্লাই ঊর্ধ্বদেশে আকাশম-লী কোনরূপ স্তম্ভ ছাড়াই স্থাপন করেছেন, তোমরা তো দেখতে পাও, অতপর তিনি আরশে সমাসীন হলেন, এবং সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়মাধীন করলেন। প্রত্যেকে নির্দিষ্ট কাল পর্যন্ত আবর্তন করে। তিনি সকল বিষয় নিয়ন্ত্রন করেন এবং নিদর্শনসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করেন, যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাত সম্বন্ধে নিশ্চিত বিশ্বাস করতে পার।’ (সূরা রা‘দ ১৩/২) মহান আল্লাহ আরো বলেন,
وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ
তিনিই তোমাদের কল্যাণে নিয়োজিত করেছেন রাত, দিন, সূর্য ও চন্দ্রকে; আর তারকারাজিও অধীন রয়েছে তাঁরই নির্দেশে। অবশ্যই এতে বোধশক্তি সম্পন্ন সম্প্রদায়ের জন্য রয়েছে নিশ্চিত নিদর্শন। (সূরা নাহাল-১৬/১২)
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ
লোকেরা তোমাকে নতুন চাঁদ সম্বন্ধে প্রশ্ন করে। বল,‘উহা মানুষ ও হজ্বের জন্য সময় নির্দেশক।’ (সূরা বাকারা ২/১৮৯)
সুতরাং চাঁদ ইসলামের প্রায় সকল ইবাদতের সাথে জড়িয়ে আছে। আমরা চাঁদ দেখে রোযা রাখি, চাঁদ দেখে ঈদ করি, চাঁদের দর্শনে হজ্ব ও কুরবানী বারে বারে আসে, শবেকদর, শবেবরাত, শবেমে‘রাজ বিশ্ব মুসলিম সমাজে এক আনন্দের হিল্লোল বয়ে নিয়ে আসে। তাই চাঁদ মুসলমানদের র্ধর্মীয় জীবন সাথী। বৈশ্বিক আসমানী ক্যালেন্ডার।
লেখক : আলেম গবেষক ও বহু গ্রন্থপ্রণেতা।