॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
এমন সব উর্বর ও উৎপাদনশীল ভূমি আছে যেগুলো চাষাবাদ না করার কারণে অনাবাদী অবস্থায় পড়ে থাকে। এরূপ ভূমি যদি কেউ ব্যক্তিগত উদ্যোগে চাষাবাদ করে তবে সে ঐ ভূমির মালিক হয়ে যাবে। অবশ্য এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় অনুমতির প্রয়োজন আছে। এরূপ ভূমির চাষাবাদকারী ব্যক্তিকে সরকার ভূমিস্বত্ব প্রদান করতে পারে। এ স্বত্ব তারা বংশ পরস্পরায় ভোগ করার অধিকার রাখে। এ প্রকারের ভূমির মাধ্যমে ‘আরদে মাওয়াত’ নামীয় মালিকানাবিহীন ভূমিও রয়েছে। উৎপাদনের স্বার্থে এসব ভূমি সরকার রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে চাষাবাদের জন্য ভূমিহীনদের মধ্যে বণ্টন করতে পারে। সরকারি মালিকানাধীন পশু বিচরণের জন্য সংরক্ষিত ভূমি সরকারি ভূমি হিসাবেই বিবেচিত হবে।
প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা বনভূমি মানুষের কাছে মহান আল্লাহর দান স্বরূপ। এখান থেকে মানুষ বহুমুখী উপকার লাভ করে। এ ধরনের বনাঞ্চল অবশ্যই সরকারি মালিকানাধীন থাকবে। তবে বনাঞ্চল সংরক্ষণ, পরিচর্যা সর্বোপরি সম্পদ সংগ্রহের বিধি-বিধান তৈরি করে কিছু শর্ত সাপেক্ষে এ ধরনের ভূমি কোন ব্যক্তি বিশেষ বা সংগঠনকে ইজারা দেয়া যেতে পারে। খনিজ সম্পদ সমৃদ্ধ ভূমি কোনভাবেই ব্যক্তি মালিকানায় থাকতে পারে না। কারণ এর সাথে দেশের জনস্বার্থ সংযুক্ত। এ প্রকারের ভূমি কোন এক ব্যক্তিকে জায়গীর হিসাবে প্রদান করেও মহানবী স. সর্বসাধারণের উপকারের কথা চিন্তা করে আবার তা রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বে ফিরিয়ে নিয়ে নজীর সৃষ্টি করেছেন। মরু ও পাহাড়ী ভূমির উৎপাদনের ক্ষমতা নেই বলে ব্যক্তিবিশেষের কাছে এর তেমন ব্যবহারিক উপযোগিতা থাকে না। এ জাতীয় ভূমিতে ব্যক্তিগত স্বত্ব প্রতিষ্ঠিত হয় না। তবে রাষ্ট্রের অনুমতি নিয়ে কোন ব্যক্তি এ প্রকারের ভূমির মালিকানা লাভ করতে পারে।
অমুসলিমদের অধিকারভুক্ত ভূমির অবস্থা : মুসলমানদের নিকট যুদ্ধে অমুসলিম বাসিন্দারা পরাজিত হলে অথবা চুক্তি ভঙ্গ করার পর মুসলমানগণ বলপ্রয়োগ করে তাদেরকে পরাভূত করলে, তারা ‘যিম্মী’ হিসেবে গণ্য হবে। তাদের ধন-সম্পদ এবং জায়গা জমি গনীমতের মালরূপে পরিগণিত হবে এবং এর বিলি ব্যবস্থা, চাষাবাদ ও বন্দোবস্তের জন্য ইসলামী রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে তা যোদ্ধাদের মধ্যে বণ্টন করে দেবে। ইচ্ছে করলে শর্তসাপেক্ষে চাষাবাদের জন্য পূর্বের চাষীদের মধ্যেও বণ্টন করে দিতে পারবে। এ ক্ষেত্রে তারা আর মালিকানা ফেরত পাবে না। বস্তুত মহানবী (স.) খায়বরের ইয়াহুদীদের সাথে এই নীতিই প্রয়োগ করেছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ ইবন উমর (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদীসে আছে, মহানবী (স.) উৎপাদিত ফল কিংবা ফসলের অর্ধেক ভাগের শর্তে খায়বরের জমি (ইহুদীদেরকে) বন্দোবস্ত দিয়েছিলেন।’
স্বেচ্ছায় যে সব অমুসলিম জাতি ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সন্ধি করবে, ইসলামী রাষ্ট্র চুক্তি অনুসারে তাদের সকল অধিকার রক্ষা করবে। তারাই তাদের জায়গা-জমি ভোগ-দখল করবে। চুক্তি অনুসারে তারা ইসলামী রাষ্ট্রের দেয় কর আদায় করতে থাকবে। খায়বর বিজয়ের পর ফাদাক নামক স্থানের অধিবাসীগণ মহানবী (স.) এর সাথে সন্ধি করার জন্য নিজেদের পক্ষ থেকে উদ্যোগী হয়েছিল এবং তাদের জমি থেকে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ইসলামী রাষ্ট্রকে দেয়ার প্রতিশ্র“তিও দিয়েছিল। মহানবী (স.) তাদের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাদের সাথে সন্ধি করেছিলেন। ফাদাকের জমি বণ্টিত না হয়ে এর অধিবাসীদের হাতেই রেখে দেয়া হয়েছিল।
যে সব অমুসলিম ভূমি মালিক মুসলমানদের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হয় কিংবা ইসলামী রাষ্ট্র হতে পালিয়ে অন্যত্র চলে যায় এবং শেষ পর্যন্ত এর মালিক বা উত্তরাধিকারী কেউই অবশিষ্ট থাকে না। এসব জায়গা জমি বিজয়ী মুসলিম রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তিরূপে পরিগণিত হবে এবং ইসলামী রাষ্ট্র তা জনগণের মধ্যে পুনর্বণ্টন করবে। হযরত উমর রা. এই নীতি অবলম্বন করেছিলেন। এ সম্পর্কে ইমাম আবু ইউসুফ (র.) বলেন, ‘যে সমস্ত জমি পারস্যের সম্রাটগণ তাদের বংশধর কিংবা যুদ্ধে নিহত অথবা পালিয়ে দেশ ত্যাগকারী লোকদের মালিকানাভুক্ত করে দিয়েছিল, হযরত উমর (রা.) এর সবই রাষ্ট্রীয় মালিকানাভূক্ত করে নিয়েছিলেন।’
মালিকানা লাভের ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শ কল্যাণকর ও সর্বজনীন। এতে জুলুম বা শোষণের কোন অবকাশ নেই। সর্বোপরি ইসলামী অর্থনীতিতে মালিকানা নীতি একটি সুষম ও আদর্শিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এ ব্যবস্থায় যেমন সৃষ্টিকর্তা ও পালনকর্তা হিসাবে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব স্বীকার করা হয়, তেমনি ধনতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক নীতির মত যথাক্রমে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রকে সম্পদের নিরংকুশ মালিকানা প্রদান করে সম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহারের অধিকার দেয়া হয় না। মোটকথা ইসলামী আইনে ভূমিসহ যাবতীয় সম্পদের মৌলিক মালিকানা আল্লাহর এবং তার নির্দেশিত পন্থায় ভোগ ও ব্যবহারের শর্তে ব্যক্তি মালিকানাও স্বীকৃত। (সমাপ্ত)