জিলহজ্ব মাসের ফজিলত ও ইবাদত

58

হাফিজ মাছুম আহমদ দুধরচকী

জিলহজ্ব, আরবি বার মাসের শেষ মাস এবং মসলমানদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ফজিলতের মাস। বছরের বার মাসের মধ্যে নিষিদ্ধ মাস মহররম, রজব, জিলক্বদ ও জিলহজ্ব (অর্থাৎ এ মাসগুলোতে কোন প্রকার যুদ্ধ বিগ্রহ করা যাবে না)। রাসূল (সা.) এর জন্মের পূর্বে অর্থাৎ জাহেলিয়াতের সময়ও এ চার মাসকে নিষিদ্ধ মাস মানা হতো। তবে কিছু সময় সুবিধা অনুযায়ী এ মাসগুলোতে পরিবর্তন আনা হতো। এটা ছিল একান্তই গোষ্ঠী প্রধানদের ইচ্ছার বাস্তবায়নকে প্রাধান্য দেয়ার নামে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত রাসূল (সা.) এর নবুওত প্রাপ্তির পরবর্তী সময় এ মাসগুলোকে আলাদা গুরুত্ব ও মর্যাদা দিয়ে এ নামকরণকে মহিমান্বিত করা হয়। তাছাড়াও এ জিলহজ্ব মাসটি স্বচ্ছল মুসলিম উম্মাহর ফরজ ইবাদত হজ্ব এর মাস। এ মাসেই বিশ্বের সামর্থবান মুসলিম সম্প্রদায় এক হয়ে হজ্বব্রত পালনের উদ্দেশ্যে পবিত্র মক্কা ও মদিনায় যান আল্লাহ ও তার রাসূলের নৈকট্য লাভের আশায়।
এটা হজ্বের মাস, তাই পুরো মাসই গুরুত্বপূর্ণ তবে এ মাসের প্রথম দশ দিনকে আরো অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। আট তারিখে ইবরাহিম (আ.) প্রথম স্বপ্ন দেখেছিলেন তার পুত্র সন্তানকে কোরবানি দিতে বলা হচ্ছে এবং তিনি সন্দেহে পরেছিলেন এটা কি সত্যি-ই আল্লাহর পক্ষ থেকে না শয়তানের পক্ষ থেকে ? তাই এ মাসের আট তারিখকে “ইউমে তারবিয়া” বলা হয়। নয় তারিখে তিনি আবার একই স্বপ্ন দেখে ছিলেন এবং বুঝতে পেরেছিলেন এটা সত্যি-ই আল্লাহর পক্ষ থেকে তাই এদিনটিকে “ইউমে আরাফা” বলা হয়। এদিনটি হাজিদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন আরাফায় “উকুফ” (অবস্থান) করা এটা হজ্বের একটি ফরজ বিধান।
হজ্বের ফরজ হচ্ছে তিনটি বাকি দুটি হচ্ছে ইহরাম পরিধান করা ও “তোয়াফে ঝিয়াদা” করা (কোরবানি করার পর যে তোয়াফ করা হয় তাকেই তোয়াফে ঝিয়াদা বলে) সুতরাং কেউ যদি “উকুফ” না করে তাহলে তার হজ্ব হবে না এবং তার উপর যদি হজ্ব ফরজ হয়ে থাকে তাহলে পরের বছর তাকে অবশ্যই আবার হজ্ব আদায় করতে হবে।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম বলেন: আল্লাহ পাক এদিনে যত গুনাহগারকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিয়ে থাকেন তত জনকে আর কোন দিনই মুক্তি দেন না এবং এদিনেই আল্লাহ পাক পবিত্র কালামে ইসলামের পূর্ণাঙ্গতা ঘোষণা দিয়েছেন-
অর্থ: আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পরিপূর্ণ করে দিয়েছি, আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি সম্পূর্ণ করেছি এবং তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে গ্রহণ করে নিয়েছি কাজেই তোমাদের ওপর হালাল ও হারামের যে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে তা মেনে চলো।
দশ তারিখে হযরত ইবরাহিম (আ.) তার পুত্রকে কোরবানি কারার জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন এবং আল্লাহর সামনে পেশ করেছিনে তাই এদিনকে “ইউমে নাহার”বা কোরবানির দিন বলা হয় এদিনে আল্লাহর কাছে সবচে প্রিয় আমল হচ্ছে কোরবানি করা।
আল্লাহ তা’য়ালা পবিত্র কোরআনের সূরা ফজর এর শুরুতে কসম করে বলেছেন ১. وَالْفَجْرِ ২. وَلَيَالٍ عَشْرٍ অর্থ (১.) ফজরের কসম, ২.) দশটি রাতের,) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন وَالْفَجْرِ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ফজরের নামাজ আর عَشْرٍ وَلَيَالٍ এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ রাত্রি তবে অধিকাংশ মুফাচ্ছিরিনে কেরাম বলেছেন وَالْفَجْرِ ও عَشْرٍ وَلَيَالٍ এ দুটি দ্বারাই উদ্দশ্যে হচ্ছে জিলহজ্ব মাসরে প্রথম দশ রাত্রি এবং তারা এর স্বপক্ষে হযরত জাবের (রা.) একটি রেওয়ায়েতও পেশ করেছেন। তবে এ বিষয়ে মুফাচ্ছিরগণ একমত যে আল্লাহ তায়ালা জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ রাত্রের গুরুত্ব বুঝাতে চেয়েছেন তাই তিনি এর কসম খেয়েছেন।
হযরত আব্দল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশ তারিখের আরো কিছু ফজিলত বর্ণনা করেছেন ১। হযরত আদম (আ.) কে ক্ষমা করেছিলেন জিলহজ্ব মাসের নয় তারিখে এবং তিনি তখন অরাফায় ছিলেন ২। আল্লাহ হযরত ইবরাহিম (আ.)কে তার খলিল রূপে মনোনীত করেছেন এ মাসের দশ তারিখে, তার পুত্র ইসমাইলকে কোরবানি রূপে পেশ করার জন্য ৩। এবং এ মাসের প্রথম দশকেই হযরত ইবরাহিম (আ.) কাবা শরীফের ভিত্তি স্থাপন করেছেন ৪। এ দশকেই হযরত মূসা (আ.) আল্লাহর সঙ্গে কালাম করেছেন ৫। ও বায়াতে রিযওয়ানও এমাসের প্রথম দশকেই হয়েছে।
এ দশকের বিশেষ আমল
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের প্রত্যেক রাত্র ইবাদতে কাটালো সে যেন সারা বছর হজ্ব ও উমরাহ করে কাটালো এবং যে ব্যক্তি এ দশকে রোজা রাখলো সে যেন সারা বছরই রোজা রাখলো (মুকাশিফাতুল কুলুব)
হযরত আবু হোরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত অপর একটি হাদিসে তিনি বলেন : রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াছল্লাম বলেছেন : জিলহজ্ব মাসের প্রথম দশকের ইবাদতই আল্লআহর কাছে সবচে বেশি পছন্দ এমন পছন্দের আর কোন আমল নেই আর এ দশকের প্রত্যেক দিনের রোজা এক এক বছর এর সমপরিমাপ ছওয়াব ও এক এক রাত্রের ইবাদত শবে কদরের সমপরিমান (মেশকাতদ)
অন্য একটি হাদিসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন ইরশাদ করেছেন-
যে ব্যক্তি জিলহজ্ব মাসের নবম তারিখে রোজা রাখবে আল্লাহ তায়ালা বিগত এক বছরের ও আগত বছরের সমপরিমান গুনাহ মাপ করে দিবেন (মুসলিম)
তবে একটি বিষয় বিশেষ ভাবে লক্ষণীয় অন্য একটি হাদিসে হজ্ব পালনকারিদের নবম তারিখের রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন কেন না তারা রোজা রাখলে ইবাদতে বিঘœ ঘটবে-(রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরাফার রোযা আরাফায় অবস্থানকারিদের রাখতে নিষেধ করেছেন) আবু দাউদ।
আর দশ তারিখের ইবাদত হচ্ছে কোরবানি করা এবং দশ তারিখে এটাই সর্বউত্তম ইবাদত-
কোরবানির দিন কোরবানি করাই আল্লাহর কাছে সবচে বেশি পছন্দের আমল আর কোরবানির পশু কিয়ামতের দিন কোরবানিকৃত পশু তার শিং, পা ও লোম নিয়ে উপস্থিত হবে আর কোরবানির পশুর রক্ত মাটিতে পরার আগেই আল্লাহর দরবারে পৌছে যায় সুতরাং তোমরা বিশুদ্ধ নিয়তে কোরবানি কর।
অন্য একটি হাদিসে এসেছে যাদের কোরবানি করার সামর্থ্য আছে অথচ কোরবানি করছে না তারা যেন ঈদগাহে না আসে (যার সামর্থ্য আছে অথচ কোরবানি করছে না সে যেন ঈদগাহে না আসে)
সুতরাং আল্লাহ আমাদের যাকে যতটুক তৌফিক দিয়েছেন সে অনুযায়ী আমরা যেন এইমাস সম্পর্কে জেনে, বুঝে আমল করতে পারি।
মহান আল্লাহ পাক আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দান করুন আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখক: প্রিন্সিপাল, শাহজালাল (রহ.) ৩৬০ আউলিয়া লতিফিয়া হাফিজিয়া মাদ্রাসা উপশহর সিলেট।