জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে নরেন্দ্র মোদি ॥ জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য নতুন সূর্য উঠেছে ॥ ভগবান না করুন, কোন দেশই যেন পাকিস্তানের মতো এমন প্রতিবেশী না পায়- রাজনাথ সিং

19

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের জেরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৃহস্পতিবার জাতির উদ্দেশে দেয়া এক ভাষণে বলেছেন, জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখে কোন উন্নয়ন হয়নি। এখন তাদের ভবিষ্যত নিশ্চিত হলো। এমন আইন তৈরি করা হয়েছে যেটি সেখানে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। অন্যদের মতো জম্মু ও কাশ্মীরের নারীদের কোন অধিকার ছিল না। শ্রমিকরা আইনের জন্য কোন সুবিধা পেত না। জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য নতুন সূর্য উঠেছে। ৩৭০ ধারা রদ করার সিদ্ধান্তটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। এটি সরদার প্যাটেলের স্বপ্ন। এর আগে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন ও বাণিজ্য স্থগিত এবং ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পাকিস্তানের প্রতি নয়াদিল্লী আহ্বান জানিয়েছে। কাশ্মীর ইস্যুকে ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় দাবি করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এই অঞ্চলের উন্নয়নের লক্ষ্যে সংবিধানের বিশেষ অনুচ্ছেদ ৩৭০ বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছে তারা।
জম্মু ও কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা রদ করার জেরে পাকিস্তান এবার ভারতের সঙ্গে রেল যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন করেছে। এর আগে পাকিস্তানের আকাশসীমা ভারতের জন্য নিষিদ্ধ করে। বৃহস্পতিবার বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছেন, ভগবান না করুন, কোন দেশই যেন পাকিস্তানের মতো এমন প্রতিবেশী না পায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাত আটটায় (বাংলাদেশ সময় রাত আটটা ৩০ মিনিট) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। জম্মু ও কাশ্মীর উপত্যকায় কার্ফু ও ১৪৪ধারা জারি থাকায় সেখানকার সব ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। দোকানপাট না খোলায় উপত্যকাবাসী অনাহারে রয়েছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া ট্রাম্প প্রশাসন জানিয়েছে, কাশ্মীর বিষয়ে কোন সিদ্ধান্তের কথা ভারত তাদের জানায়নি।
কূটনীতি বাণিজ্যের পর এবার ভারতের সঙ্গে রেল যোগাযোগও বন্ধ করল পাকিস্তান। বৃহস্পতিবার (৮ আগষ্ট) থেকে দু’দেশের মধ্যে চলাচলকারী সমঝোতা এক্সপ্রেসের সব সিডিউল বাতিল করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পাকিস্তানের রেলমন্ত্রী শেখ রশিদ আহমাদ। এর আগে আকাশপথ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ভারতের জন্য। চতুর্থ দিনের মতো অবরুদ্ধ রয়েছে কাশ্মীর উপত্যকা। অল ইন্ডিয়া রেডিও জানিয়েছে, সহিংসতার অভিযোগে সেখানে অন্তত পাঁচ শ’ জনকে আটক করা হয়েছে। কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেয়ার ফলে সেখানকার মানুষ মনে করছেন তারা স্বাধীনতা হারিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, যে চুক্তির মাধ্যমে কাশ্মীরের ভারতভুক্তি হয়েছিল সেটাই তো এখন আর রইল না। খবর সংগ্রহ করতে কাশ্মীরে যেসব সাংবাদিক গেছেন , তাদের প্রায় কেউই সর্বশেষ খবরাখবর জানাতে পারছেন না।
জম্মু আর লাদাখ অঞ্চল থেকে জানা যাচ্ছে যে, সেখানকার বহু মানুষ সরকারের এই সিদ্ধান্তের পরে বিজয়োল্লাস করছেন। ভারতের জাতীয় পতাকা নিয়ে আনন্দোৎসব, মিষ্টি বিলি, নাচ এসব হচ্ছে। অন্যদিকে কাশ্মীরের বেশিরভাগ মানুষ এখনও খুব ভাল করে জানেনই না যে, সংবিধানের যে ধারা দুটির মাধ্যমে তাদের রাজ্যটিকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছিল, তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। তাদের কানে যেটুকু এসেছে, তাতেই তাদের মনে হয়েছে যে স্বাধীনতা তারা ভোগ করতেন, সেটা হারালেন তারা। বারামুলার এক বয়স্ক লোক বলেন, ওই ধারা দুটি আমাদের কাছে স্বাধীনতার মতো ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে যে আমি যেন স্বাধীনতা হারালাম। আমি এখন আর স্বাধীন নই।
ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বৃহস্পতিবার সেনাবাহিনীর এক অনুষ্ঠানে বলেন, কোন দেশেরই প্রতিবেশী দেশকে পরিবর্তন করার কোন অধিকার নেই। দেশের পাশাপাশি ভারত প্রতিবেশী দেশের প্রতিও সবসময় একইরকম সহানুভূতিশীল। আমরা সবসময়ই প্রতিবেশী দেশের জন্য চিন্তাশীল ও উদ্বিগ্ন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আপনি আপনার বন্ধুদের মধ্যে পরিবর্তন আনতে পারেন তবে আম্পানে প্রতিবেশীদের মধ্যে নয়। তবে আমি প্রার্থনা করি আমাদের যেমন প্রতিবেশী আছে এরকম যেন কেউ না পায়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ১৪ আগষ্ট কাশ্মীরের সাহসীদের কষ্টের কথা তুলে ধরা হবে ও ১৫ আগষ্ট কালা দিবস পালন করা হবে।
কাশ্মীরে অচলাবস্থা চলাকালে বন্ধ হয়ে গেছে স্বাভাবিক খাবার সরবরাহ। নেই বাইরের সঙ্গে যোগাযোগ। ব্যাংক ও এটিএমগুলোতেও কোন অর্থ নেই। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে দোকানগুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে কাশ্মীরবাসী। ৭২ ঘণ্টা পার না হতেই তাই দোকানগুলোতেও শেষ হয়ে গেছে খাবার। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে বহুগুণ। তিনদিন ধরে চলা এই অচলাবস্থায় না খেয়ে দিন কাটাতে হচ্ছে নিম্নবিত্ত অনেক কাশ্মীরীকে। কাশ্মীরজুড়ে মোতায়েন করা হয়েছে অতিরিক্ত সেনা। গ্রেফতার করা হয়েছে সেখানকার শতাধিক স্থানীয় নেতাকে। ইন্টারনেট-মোবাইল পরিষেবা বন্ধ রাখা হয়েছে। বিরাজ করছে থমথমে পরিস্থিতি। এই অচলাবস্থায় সেখানে খাদ্যস্বল্পতা দেখা দিয়েছে। কার্ফু থাকায় চলাচলেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। খাবারের স্বল্পতা ও এটিএম কাজ না করায় নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম অনেক বেড়ে গেছে। ফলে বিপাকে পড়েছেন নিম্নবিত্তরা। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, তারা এখন না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের উপসম্পাদক মুজামিল জলিল টেলিগ্রাফকে বলেন, তারা শ্রীনগরের সব এটিএমেই খোঁজ নিয়ে দেখেছেন অর্থ নেই। অনেকেই এখন হাতে হাতে রুপী নিয়ে ঘুরছে। আর দরিদ্র লোকজনের কোন জমানো রুপী নেই। তবে ভারতের এক শীর্ষ কর্মকর্তা এই খাদ্যাভাবের ঘটনাকে অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, কাশ্মীর উপত্যকায় তিন মাসেরও বেশি খাবার মজুদ রয়েছে।
অধিকারকর্মীদের আশঙ্কা, মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রেখে আন্দোলনকারী ও বিরোধী পক্ষের নেতাদেরকে গ্রেফতার করছে কেন্দ্রীয় সরকার। স্থানীয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বলেন, এখন পর্যন্ত শতাধিক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। যাদের মধ্যে সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আব্দুল্লাহও রয়েছেন। বিরোধী দলের অভিযোগ, সরকার ভারতের জনতাত্ত্বিক নক্সাই পরিবর্তন করে দিতে চাইছে। বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছে সবাই। এখন পর্যন্ত বেশ কয়েকটি হতাহতের খবর পাওয়া গেলেও তা নিশ্চিত করতে পারেনি কোন সংবাদমাধ্যম। কাশ্মীরের সাবেক দুই মুখ্যমন্ত্রীর গ্রেফতারের বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্টে মামলা করেছেন দেশটির অধিকারকর্মী তেহসিন পুনাওয়ালা। কাশ্মীর উপত্যকায় চলমান অচলাবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ করেছেন তিনি। সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি ও ওমর আব্দুল্লাহর মুক্তি চেয়েও আবেদন করেন তিনি। এই পরিস্থিতির বিরুদ্ধেই এবার সুপ্রীমকোর্টের শরণাপন্ন হন সমাজকর্মী তেহসিন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের জম্মু ও কাশ্মীরের বিষয়ে বড় ধরনের ঘোষণা দেয়ার কয়েক ঘণ্টা আগেই সোমবার থেকে গৃহবন্দী করে রাখা হয় ওই দুই নেতাকে। বৃহস্পতিবার তাদের গ্রেফতারের কথা জানায় কেন্দ্রীয় সরকার। কবে তাদের মুক্তি দেয়া হবে সে ব্যাপারে কোন ঘোষণা দেয়নি।
পুরো কাশ্মীর উপত্যকাজুড়ে অবস্থান নিয়েছে ভারতীয় বাহিনী। বন্ধ করে দেয়া হয়েছে হাট-বাজার, দোকানপাট, স্কুল-কলেজ। মোবাইল সংযোগ এমনকি ডাকঘরও বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ধরপাকড়ের শিকার হয়েছেন শত শত মানুষ। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের দাবি, সেখানে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে। পাথর নিক্ষেপের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে মাত্র। তবে জুমার নামাজ কিংবা ঈদে পরিস্থিতি শিথিল করা হবে কিনা তা নিয়ে কিছু জানায়নি তারা। ভূস্বর্গ কাশ্মীর যেন এর বাসিন্দাদের কাছে পরিণত হয়েছে জীবন্ত নরকে। স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে রাজ্যটিকে দুই টুকরো করে দিয়েছে ভারত। স্থানীয়রা বলছেন, ভারত কাশ্মীর দখল করতে চায়; এখানকার লোকজনকে চায় না। এমন পরিস্থিতিতে বুধবার সরেজমিনে অঞ্চলটি পরিদর্শন করেন ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল। এ সময় প্রায় অবরুদ্ধ কাশ্মীরের রাস্তায় দাঁড়িয়ে কয়েকজনের কাছে তিনি জানতে চান, সব কেমন চলছে? আপনারা কি ভাবছেন? রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্লেট হাতে খাবার খাচ্ছিলেন আর স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। তিনি বলেন, সবার শান্তিতে থাকা উচিত। ঈশ্বর যা করেন, ভাল করেন। আপনাদের নিরাপত্তা এবং ভাল রাখাই আমাদের চিন্তা। আমরা আপনাদের উন্নতি ও কল্যাণের জন্য চিন্তা করছি। তবে তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন সেখানকার দোকানপাট বন্ধ ছিল। উপত্যকায় কোন রকম জমায়েত নিষিদ্ধ করেছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় এক বাসিন্দা সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, সরকার ক্ষমতায় এতটাই নিমজ্জিত যে তারা আমাদের মানুষ মনে করছে না। তাদেরকে এই সিদ্ধান্তের ফল ভোগ করতে হবে না, আমাদেরকেই তা ভোগ করতে হবে। ভারতের অন্যান্য অংশের কাশ্মীরীদের বরাত দিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বলছে, ভারতের অন্যান্য অংশে থাকা কাশ্মীরীরা নিজেদের পরিবারের কাছে যেতে পারছে না। একই সঙ্গে অঞ্চলটির রাজনৈতিক নেতাদেরও আটক করা হয়েছে এবং আরও হচ্ছে।