কাজিরবাজার ডেস্ক :
মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে সুখবর মিলতে যাচ্ছে। আগষ্টে দেশটিতে কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে চুক্তি চূড়ান্ত হবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ। মালয়েশিয়ায় সফররত প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রায়াত্ত বার্তা সংস্থা বারনামাকে এই তথ্য জানিয়েছেন।
সংবাদ মাধ্যমটি এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার খুলতে দুই দেশ সচেষ্ট। যত দ্রুত সম্ভব বিষয়টির মীমাংসা করতে একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে ঢাকা ও পুত্রজায়া।
মালয়েশিয়ায় আয়োজিত বাংলাদেশি একটি বাণিজ্য প্রদর্শনী ও সম্মেলনে অংশ নিতে প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ এখন দেশটিতে অবস্থান করছেন।
বৃহস্পতিবার বারনামা নিউজ চ্যানেলকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন ‘আমি মালয়েশিয়ার মানবসম্পদ মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেছি। নতুন একটি পদ্ধতি চূড়ান্ত করা এখন সময়ের ব্যাপার।’
বারনামাকে প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, ‘পুরনো পদ্ধতি ঠিকঠাক কাজ করছিল না বলেই নতুন পদ্ধতি করা হচ্ছে। আমরা সবাইকে নিয়েই এটা করছি। আমার মনে হয়, অগাস্টেই একটা সমাধানে আমরা পৌঁছে যেতে পারব।’
তিনি আশ্বস্ত করেন, মালয়েশিয়ায় কর্মী নিয়োগের যে পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া এবার চালু হবে, তাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত হবে।
মালয়েশিয়া সরকার তাদের পাঁচটি খাতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বয়ে ‘জিটুজি প্লাস’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হওয়ার পর ২০১৬ সালে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পাঁচ বছর মেয়াদী এই চুক্তির আওতায় লোক পাঠানোর অনুমতি দেওয়া হয় দশটি জনশক্তি রপ্তানিকারক এজেন্সিকে।
কিন্তু প্রবাসী এক বাংলাদেশি ব্যবসায়ীর নেতৃত্বে মালয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগসাজশে একটি চক্র ওই দশ এজেন্সিকে নিয়ে সিন্ডিকেট করে শ্রমিকদের কাছ থেকে দুই বছরে অন্তত ২০০ কোটি রিঙ্গিত হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ ওঠার পর গতবছর ওই ব্যবস্থা স্থগিত করে দেশটির সরকার।
এরপর অগাস্টে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ জানান, বিদেশ থেকে জনশক্তি নিতে নতুন একটি পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে তার সরকার, যে নিয়ম সব দেশের জন্যই প্রযোজ্য হবে এবং সব লাইসেন্সধারী এজেন্টই শ্রমিক নেওয়ার সুযোগ পাবে।
সংশ্লিষ্ট কাজের জন্য দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি যেন বাছাই হয়, লোক পাঠানোর খরচ যেন সাশ্রয়ী হয়, কোথাও কোনো আইন যেন লঙ্ঘন করা না হয়- তা নিশ্চিত করা হবে বলে আশ্বাস দেন প্রতিমন্ত্রী।
এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘কর্মীদের যাওয়ার খরচ যাতে না বাড়ে আমাদের সরকার তা নিশ্চিত করবে। মালয়েশিয়ার সরকার যেসব কারণে আগের ব্যবস্থা বাতিল করেছে, তার মধ্যে এটাও একটা কারণ। ওই পদ্ধতিতে মালয়েশিয়া যেতে যে খরচ হচ্ছিল তা আর কর্মীদের সামর্থ্যের মধ্যে থাকছিল না।’
পুরনো পদ্ধতি স্থগিত করার সময় মালয়েশিয়ার সংবাদমাধ্যমের খবরে বলা হয়, ১০ এজেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে মালয়েশিয়ায় লোক পাঠাতে মাথাপিছু সর্বোচ্চ দুই হাজার রিংগিত খরচ হওয়ার কথা। সেখানে এজেন্টরা বাংলাদেশি শ্রমিকদের কাছ থেকে ২০ হাজার রিংগিত আদায় করছিল।
এর অর্ধেক টাকা যাচ্ছিল সেই সিন্ডিকেটের হাতে, যার বিনিময়ে তারা ওয়ার্ক পারমিট ও উড়োজাহাজের টিকেটের ব্যবস্থা করে দিচ্ছিল।
জনশক্তি আমদানির নতুন একটি পদ্ধতি ঠিক করতে গতবছর একজন বিচারপতির নেতৃত্বে স্বাধীন একটি কমিটি করে দিয়েছিল মালয়েশিয়া সরকার।
এর আগে গত ৩০ মে মালয়েশিয়ায় জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক সেলিম রেজা, প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ফজলুল করিম, উপসচিব আবুল হোসেনসহ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দুইজন প্রতিনিধি এবং মালয়েশিয়ায় নিয়োজিত বাংলাদেশের হাইকমিশনার মো. শহিদুল ইসলাম।
এর আগে মালয়েশিয়ার বন্ধ শ্রমবাজারের দুয়ার খুলতে গত ১৪ মে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মালয়েশিয়ার মানবসম্পদমন্ত্রী কুলাসেগারনের সঙ্গে তার কার্যালয়ে বৈঠক করেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী ইমরান আহমদ। পরে তিনি দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হাজী মুহিউদ্দিন বিন হাজি মোহা ইয়াসিনের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, ‘মালয়েশিয়ার বাজারটি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় দেশের জনশক্তি রপ্তানি অনেকটাই গতি হারিয়েছে। আমরা চাইবো শিগগির মালয়েশিয়ার বাজারটি আমাদের জন্য খুলে যাক। দুই দেশের মধ্যে যে বৈঠক চলছে, এটি ফলপ্রসু হোক, এটা আমাদের চাওয়া।’
এর আগে দুই দেশের মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে জানানো হয়, নতুন কর্মী নেওয়ার প্রক্রিয়া ঠিক করতে দেশটির তৈরি করা খসড়া তাদের মন্ত্রিসভায় অনুমোদন নেওয়া হবে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে কর্মী নেওয়া শুরু করতে আরও কমপক্ষে দুই মাস লাগতে পারে। মালয়েশিয়া সরকারের গঠিত কমিটির তৈরি খসড়ায় একটি অনলাইন জব পোর্টাল খোলারও সুপারিশ রাখা হয়েছে। মালয়েশিয়ান রিক্রুটিং এজেন্সি (এমআরএ) নামে ওই পোর্টালে নিয়োগকর্তা ও কর্মীর মধ্যে যোগাযোগের সুযোগ থাকবে। এ প্রক্রিয়া চালু হলে মধ্যস্বত্বভোগী নিয়ে সৃষ্ট সংকটের সমাধান হবে।
গত সেপ্টেম্বরে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ হওয়ার আগে বি টু বি প্লাস চুক্তির আওতায় কর্মী পাঠানো হতো। দেশের ১০টি রিক্রুটিং এজেন্সি এই প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করত। তাদের বাইরে অন্য কোনো এজেন্সি সরাসরি লোক পাঠাতে পারতো না। এই প্রক্রিয়ায় দেশে এবং মালয়েশিয়ায় নানামুখী অনিয়মের অভিযোগে মালয়েশিয়া সরকার নিয়োগ বন্ধ করে দেয়। পরে কর্মী নিয়োগের নতুন কোনো পদ্ধতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়নি দেশটি।
অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে কয়েক বছর বন্ধ থাকার পর ২০১২ সালের নভেম্বর দুই দেশের মধ্যে জিটুজি চুক্তি সই হয়। এতেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় বেসরকারি জনশক্তি রপ্তানিকারকদের যুক্ত করে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে জিটুজি প্লাস চুক্তি হয়।
দেশের জনশক্তি রপ্তানির ৮০ শতাংশ যায় মধ্যপ্রাচ্যে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়া বাংলাদেশের জন্য অন্যতম বড় শ্রমবাজার। কিন্তু সৌদিতে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি, আরব আমিরাতে সীমাবদ্ধতা, মালয়েশিয়ায় জনশক্তি রপ্তানিতে অনিয়মসহ নানা কারণে জনশক্তি রপ্তানি কমে এসেছে।