কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিএনপি জোটে অস্থিরতা কমছেই না, বরং দিন দিন বেড়ে চলেছে। জোট ছেড়ে যাওয়া ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থর দল বিজেপিকে ফিরিয়ে আনাসহ সকল সমস্যার সমাধান করে জোটের পরিধি আরও বৃদ্ধির যে আশ্বাস বিএনপি হাইকমান্ডের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছিল তাও হালে পানি পাচ্ছে না। বরং নতুন করে এলডিপি সভাপতি অলি আহমেদ বিএনপি নেতাদের ব্যর্থতা নিয়ে গলা ফাটিয়ে কথা বলা শুরু করলে নতুন সঙ্কট সৃষ্টি হয়। এর ফলে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে বিএনপি জোটের ভবিষ্যত নিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০ দলীয় জোট ছেড়ে যাওয়া বিজেপিকে ফিরিয়ে আনার জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ দলের বেশ ক’জন সিনিয়র নেতা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থকে বাগে আনতে ব্যর্থ হয়েছেন। সম্প্রতি জোটের বৈঠকে অংশ নেয়ার জন্য তাকে আমন্ত্রণও জানানো হয়েছিল। কিন্তু পার্থ সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন। এ বৈঠকের পরও বিএনপির পক্ষ থেকে তার সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যর্থ হয়েছেন সিনিয়র নেতারা। এখন নতুন করে জোটের অন্যতম শরিক এলডিপি সভাপতি কর্ণেল (অব) অলি আহমেদ বিএনপি হাইকমান্ডসহ দলের নেতাদের নিয়ে বিষোদগার শুরু করেছেন। যে কোন সময় বিএনপির পক্ষ থেকেও তার প্রতি ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আর তা হলে আরও বড় ধরনের সঙ্কটের মুখোমুখি হবে বিএনপি জোট।
সম্প্রতি এলডিপির এক ইফতার পার্টিতে বিএনপি নেতাদের সামনেই এ দলের কঠোর সমালোচনা করেন অলি আহমেদ। কারও নাম উল্লেখ না করেই তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির কিছু নেতার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, বিএনপিতে কিছু ছাগল আছে। এ ছাগলরা খালেদা জিয়ার চেয়েও নিজেদের বড় নেতা মনে করে। বিএনপি কারাবন্দী দলের চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তির জন্য কিছু করতে পারছে না মন্তব্য করে অলি বলেন, তার মুক্তির জন্য এলডিপি দেশব্যাপী জনমত গড়ে তুলবে। এ সময় বিএনপি নেতাদেরও তার সঙ্গে থাকার আহ্বান জানান অলি আহমেদ।
অলি আহমেদ আরও বলেন, এলডিপি মনেপ্রাণে খালেদা জিয়ার মুক্তি চায়। তবে বিএনপির কিছু ব্যক্তি চায় না খালেদা জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পাক। কারণ, খালেদা জিয়া মুক্তি পেলে দলে তাদের গুরুত্ব কমে যাবে। এ প্রসঙ্গে একটি উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, দেয়াল যদি নিচু হয়, ছাগল লাফ দিয়ে অনেক সময় দেয়ালের উপরে উঠে যায়। তখন পাশে হয়ত মালিক দাঁড়িয়ে থাকেন। দেখা যায় অনেক সময় ছাগলের উচ্চতা মালিকের উচ্চতা থেকে অনেক বেশি হয়। ফলে ছাগল মনে করে আমি মালিকের থেকে বেশি উঁচু। বিএনপির রাজনীতিতে এ ধরনের অনেক ছাগল আছে। আর ছাগলগুলো মনে করে, তারা যেন জিয়াউর রহমান ও তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার চেয়েও বড় নেতা। তাই খালেদা জিয়া যদি জেল থেকে বের হয় তাহলে তাদের অসুবিধা হতে পারে।
এর আগে আরেক অনুষ্ঠানে বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে এলডিপি সভাপতি কর্নেল অলি আহমেদ বলেন, বসে থাকলে চলবে না, এগিয়ে যেতে হবে। বিএনপি সংসদে গিয়ে সরকারের বৈধতা দিয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এ ছাড়া জোটের সঙ্গে কথা না বলে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বিএনপি নেতাদের অনুরোধ করবÑ হয় আপনারা নেতৃত্ব দেন, নাহলে আমাদের নেতৃত্ব গ্রহণ করুন। তবে খালেদা জিয়ার পক্ষে জেলে থেকে আমাদের নির্দেশনা দেয়া সম্ভব নয়। আর তারেক রহমানের পক্ষেও লন্ডন থেকে সক্রিয়ভাবে মাঠে থাকা সম্ভব নয়। তাই দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে বিএনপি জোটের নেতৃত্ব দিতে দায়িত্ব নেয়ার জন্য আমি প্রস্তুত আছি। বিএনপি নেতাদের প্রতি অনুরোধ, সবাই এক জায়গায় একত্রিত হোন। আমাদের হাতকে শক্তিশালী করুন। ‘আমি মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিতে পারি নাই, এবার জীবন দিতে প্রস্তুত আছি।’
অবশ্য সম্প্রতি বিএনপির এক অনুষ্ঠানে কর্ণেল (অব.) অলি আহমেদের বক্তব্যের বিপরীতমুখী বক্তব্য দিয়েছেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেছেন, বিএনপিতে কোন সঙ্কট নেই। বরং সরকারের লোকেরা নিজেদের সঙ্কটের কথা না বলে বিএনপির সঙ্কটের কথা বলছে। তিনি বলেন, কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার ইশারায় এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সরাসরি নির্দেশে স্থায়ী কমিটির সদস্যরা দল পরিচালনা করছে। বিএনপির আগে যে জনসমর্থন ছিল, সরকারের অত্যাচার- নির্যাতনের কারণে এই জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। যদিও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ড. খন্দকার মোশারফ দলের আরও ক’জন সিনিয়র নেতার সঙ্গে সুর মিলিয়ে দলীয় নেতৃত্বের ব্যর্থতার কথা বলে অবিলম্বে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলকে ঢেলে সাজানোর দাবি জানিয়েছিলেন। তবে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এ দাবি প্রত্যাখ্যান করেন। এর ফলে বিগত জাতীয় কাউন্সিলের পর নির্ধারিত ৩ বছর অতিক্রান্ত হয়ে যাওয়ার পরও দলের জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না।
এদিকে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডাঃ জাফরউল্লাহ চৌধুরী বিএনপি জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াতের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে দেশবিরোধী ভূমিকা পালনের জন্য জামায়াতকে জনসম্মুখে ক্ষমা চাইতে হবে। তিনি আরও বলেন, ২০ দলের অন্যতম শরিক দল হচ্ছে জামায়াত। তাই তারা যদি সত্যিকার অর্থে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার মুক্তি চায় তাহলে তাদেরকে জনসম্মুখে ক্ষমা চাইতে হবে। আজ তাদের পিতারা যে ভুল করেছেন তার জন্য বর্তমানে যারা আছেন তাদের ক্ষমা চাওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে। তাহলেই তারা রাজনীতি করার অধিকার চাইতে পারে। অপরদিকে লেবার পার্টিসহ ২০ দলীয় জোটের ক’টি শরিক দল বিএনপিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ছেড়ে দেয়ার কথা বলে চাপ সৃষ্টি করছে। তবে এটি জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও বিএনপিকে চাপে রাখতে জামায়াতের কৌশল বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছে।
দীর্ঘদিন ধরে ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে জোটের শরিক দলগুলোকে গুরুত্ব না দেয়ায় সম্প্রতি বিজেপি জোট ছেড়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ার পর অন্যান্য শরিক দলেও সৃষ্টি হয় ক্ষোভ-বিক্ষোভ। এ পরিস্থিতিতে ২০ দলীয় জোটের বৈঠক ডেকে স্কাইপিতে কথা বলেন লন্ডন প্রবাসী বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। পরে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের জানান, জোটে এখন কোন সঙ্কট নেই। আর ভুল বোঝাবুঝির কারণে, বিজেপি জোট ছাড়ার ঘোষণা দিলেও শীঘ্রই তারা আবার ফিরে আসবে। এ ছাড়া জোটের পরিধি আরও বাড়ানো হবে। কিন্তু বাস্তবে এখন পর্যন্ত বিজেপিও ফিরে আসেনি এবং জোটে শরিক দলের সংখ্যাও বাড়ানো সম্ভব হয়নি।
সূত্র জানায়, বিএনপির ভুল সিদ্ধান্ত ছাড়াও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর ২০ দলকে গুরুত্ব না দেয়া একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মূলত, ২০ দলীয় জোটকে অন্ধকারে রেখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের পর থেকেই বিএনপির সঙ্গে ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর বিরোধ সৃষ্টি হয়। পরে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংলাপকালে ২০ দলীয় জোটের নেতাদের বাদ দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ৪ টি দলের নেতাদের সঙ্গে নেয়া এবং সারাদেশের ৩০০ নির্বাচনী এলাকায় শরিকদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির সময় এ বিরোধ আরও বাড়ে। কারণ, ২০ দলীয় জোটের অধিকাংশ শরিক দলকেই আশানুরূপ আসন দেয়া হয়নি। সর্বশেষ জোটের কাউকে কিছু না বলে বিএনপি দলীয় ৫ সাংসদের জাতীয় সংসদে যোগদানকে কেন্দ্র করে বিএনপির প্রতি ২০ দলীয় জোটের শরিক দলের বিরোধ ও অস্থিরতা তুঙ্গে ওঠে।
২০ দলীয় জোটের বিভিন্ন শরিক দলের নেতারা এখন প্রকাশ্যেই বলছে ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে বিএনপি তাদের ব্যবহার করলেও কখনই আশানুরূপ মূল্যায়ন করেনি। তারপরও জোটের ঐক্য অটুট রেখে চলেছে তারা। বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপির বর্তমান নেতৃত্ব দুর্দিনের জোট সঙ্গদের অবমূল্যায়ন শুরু করে। আর এ কারণেই ভাঙ্গনের কবলে পড়ে বিএনপি জোট।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজনীতিতে উত্থান-পতন একটি স্বাভাবিক ঘটনা। আর যখন একটি সঙ্কট তৈরি হয় তখন আরও নতুন নতুন সঙ্কট দেখা দিতে পারে।
তাই বিএনপি জোটে এখন মাঝে মধ্যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তবে সময়ের বিবর্তনে হয়ত এ সমস্যা থাকবে না। তবে গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে সাময়িক সঙ্কটের দিকে তাকিয়ে হতাশ হয়ে বসে থাকলে চলে না। সঙ্কট মোকাবেলা করেই এগিয়ে যেতে হয়।