ওলীউর রহমান
শ্রমিকদের অধিকার সুরক্ষার লক্ষ্যে ১ মে-কে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালন করা হয়। ১৯৮০ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী এ দিবসটি আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পালন করা হয় এ দিনটিকে। এ দিনটির সাথে জড়িয়ে আছে জুলুমবাজ পুঁজিপতিদের অত্যাচার নির্যাতন- নিপীড়নের করালগ্রাস থেকে শ্রমিক- মজদুর শ্রেণির মুক্তিসংগ্রামের এক রক্তঝরা ইতিহাস। মানুষকে চিরদিন প্রভুত্বের শৃংখলে এবং দাসত্বের যাতাকলে আবদ্ধ করে রাখা যায় না এর এক জ্বলন্ত প্রমাণ হলো আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস। শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ১৮৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরের হে-মার্কেটে আন্দোলনরত শ্রমিকদের উপর গুলি চালানো হলে ঘটনাস্থলেই ১১ জন শ্রমিক নিহত হন। এর আগে শ্রমিকরা প্রতিদিন ১২ ঘন্টা পরিশ্রম করতে হতো বিপরীতে মিলত একেবারে নগণ্য মজুরী। এক প্রকার দাসবৃত্তির মতই শ্রমিকরা হাড়খাটুনী শ্রম দিয়ে যেত আর মিল-কারখানার মালিকরা অমানবিক অত্যাচার চালাতো তাদের উপর। যাদের ঘাম এবং শ্রমে গড়ে উঠছিল সভ্যতার রাজ প্রসাদ, তারা প্রতিনিয়ত অসভ্য বণিকও জুলুমবাজ প্্ুজিপতিদের বর্বরতার শিকার হতো। নির্যাতিত শ্রমিকদেরকে এই মানবেতর অবস্থা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে ১৮৬০ সালে শ্রমিকরাই প্রথমে দাবি জানায় ৮ ঘন্টা শ্রম এবং উপযুক্ত মজুরী প্রদানের। কিন্তু কোন শ্রমিক সংগঠন না থাকায় এ দাবি জোরালো হচ্ছিল না। ১৮৭২ সালে কানাডায় এক বিশাল শ্রমিক শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এ থেকে শ্রমিকরা উদ্বুদ্ধ হয় এবং তারা বুঝতে পারে যে, অধিকার আদায়ের জন্য আমাদেরকে সংগঠিত হতে হবে। ১৮৮০-৮১ সালে কানাডায় শ্রমিকরা Federation of Organized Trades and Labor Unions of the United State and Canada নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। এরপর ১৮৮৬ সালে গঠন করা হয় American Federation of Labor
নামক সংগঠন। এভাবে শ্রমিকরা এসব সংগঠনের মাধ্যমে সংগঠিত হতে থাকে।
১৮৭২ সালে কানাডায় অনুষ্ঠিত বিশাল শ্রমিক সমাবেশ থেকে উজ্জীবিত হয়ে মূলত শ্রমিকরা শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য সংগঠিত হতে শুরু করে। ১৮৮৪ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে একদল শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করার জন্য আন্দোলন শুরু করেন এবং তাদের এ দাবি কার্যকর করার জন্য ১৮৮৬ সালে ১লা মে পর্যন্ত সময় বেঁধে দেয়। কিন্তু কারখানার মালিকগণ শ্রমিকদের এ ন্যায্য দাবির প্রতি কর্ণপাত করে নাই বরং তারা এ ধারণাই পোষণ করে যে, ‘একজন শ্রমিক দৈনিক ৮ ঘন্টা কাজ করুক বা ১০ ঘন্টা কাজ করুক সে তো দাসই’। শ্রমিকদের প্রতি মালিকদের এই নিষ্ঠুর অবজ্ঞা প্রদর্শনের অনিবার্য ফলশ্র“তিতে শ্রমিকরা মরণপণ সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ১লা মে কে কেন্দ্র করে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধ এবং শিকাগো শহর হয়ে উঠে আন্দোলন সংগ্রামের কেন্দ্রস্থল। সময় যত এগিয়ে যাচ্ছিল শ্রমিক আন্দোলনের দাবানল ততই জ্বলে উঠছিল সর্বত্র দাউ দাউ করে। অন্য দিকে সরকার ও কঠোর হস্তে আন্দোলন দমন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ১লা মে ১৮৮৬ সাল, সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জোড়ে প্রায় তিন লক্ষ শ্রমিক কাজ ফেলে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। শিকাগোতে শ্রমিক ধর্মঘট আহবান করা হয়। প্রায় চল্লিশ হাজার শ্রমিক শহরের কেন্দ্রস্থলে সমবেত হয়। অগ্নিঝরা বক্তৃতা আর মিছিলে মিছিলে উত্তাল হয়ে উঠে শিকাগো। শ্রমিকদের মধ্যে পথিকৃত হয়ে উঠেন শ্রমিক নেতা পার্সন্স, জোয়ান মোস্ট, আগষ্ট স্পীজ, লুইলিং প্রমুখ। ধীরে ধীরে শ্রমিকদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শ্রমিকদের সংখ্যা দাড়ায় এক লক্ষ। আন্দোলন চলতে থাকে। ৩ অথবা ৪ মে শিকাগো শহরের হে-মার্কেট বাণিজ্যিক এলাকায় মিছিলের উদ্দেশ্যে শ্রমিকরা জড়ো হতে থাকে। এ সময় সমবেত শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছিলেন আগস্ট স্পীজ। হঠাৎ দূরে দাঁড়ানো একদল পুলিশের কাছে একটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। এতে একজন পুলিশ মারা যায়। পরে আরো ৬ জন মারা যায়। সাথে সাথে শুরু হয় ধর্মঘট আহবানকারী শ্রমিকদের উপর পুলিশী এ্যাকশন। শুরু হয় রায়ট। রায়টে ১১ জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে। এ ঘটনায় আগষ্ট স্পীজ সহ আট জনকে অভিযুক্ত করা হয় এবং এক প্রহসনমূলক বিচারের মাধ্যমে ১৮৮৭ সালের ১১ নভেম্বর এক উন্মুক্ত স্থানে আগষ্ট স্পীজ সহ ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ফাঁসির মঞ্চে আরোহন করার আগে আগষ্ট স্পীজ বলেছিলেন, ‘আজ আমাদের এই নি:শব্দতা তোমাদের আওয়াজ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী হবে।’
সময় তার গতিতেই চলতে থাকে সামনের দিকে। দুনিয়ার মুক্তিকামী জনতা আর বেশি দূর অপেক্ষা করতে হয় নাই। ইতিহাস সকল জুলুম নিপীড়নকে পিছনে ফেলে আগস্ট স্পীজের কথাকে বাস্তবে রূপ দিতে শুরু করে, সত্যের জয় হয়, অসত্য হার মানে। এক সময় যারা অন্যায়ভাবে ফাঁসি দিয়েছিল আগষ্ট স্পীজদের তারা ইতিহাসের আদালতে অভিযুক্ত হয়ে নিক্ষিপ্ত হয় আস্থাকুড়ে আর আগষ্ট স্পীজরা অভিষিক্ত হয় বীরত্বের আসনে। ১৮৯৩ সালে ইলিয়নের গভর্ণর অভিযুক্ত আট জনকেই নিরপরাধ ঘোষণা করেন এবং রায়টের হুকুমদাতা পুলিশ কমান্ডারকে অভিযুক্ত করা হয়। অবশেষে শ্রমিকদের দৈনিক আট ঘন্টা কাজ করার দাবি অফিসিয়াল স্বীকৃতি পায় এবং ১লা মে শ্রমিকদের দাবি আদায়ের দিন হিসাবে স্বীকৃত হয়।
বিশ্বের প্রায় আশিটি দেশে ১ মে শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের দিন হিসাবে তাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে সরকারীভাবে ছুটি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশেও ১ মে সরকারীভাবে ছুটির প্রদান করা হয়। কিন্তু এখনো আমাদের দেশে শ্রমিকদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা শতভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অনেক বেসরকারী প্রতিষ্ঠান- মিল কারখানা, রেষ্টুরেন্ট ইত্যাদিতে গড়ে ১০ ঘন্টা কাজ করেও উপযুক্ত মজুরী পায় না শ্রমিকরা, উল্টো তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করা হয়। গার্মেন্টস এবং চা শ্রমিকরা একেবারে নগণ্য বেতনে চাকরি করে মানবেতর জীবন যাপন করছে। এর মাঝে নেই তাদের জীবনের নিরাপত্তা। আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে হলে শ্রমিক সমাজের অবস্থার অবশ্যই উন্নতি ঘটাতে হবে। সর্বত্র শ্রমআইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপযুক্ত মজুরী এবং কাজের অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন দেশে আমাদের শ্রমিকেরা অমানবিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্যও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শ্রমিক শ্রেণির জীবনের মান উন্নয়নের মাধ্যম একটি আধুনিক ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরকে।