প্রাথমিক শিক্ষা- বিস্তৃতি ঘটলেও মান বাড়েনি

108

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশজুড়ে চলছে জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পালন করা হচ্ছে নানা অনুষ্ঠান। কিন্তু দেশের প্রাথমিক শিক্ষার সার্বিক অবস্থা কেমন- সে প্রশ্নটি এখন সামনে এসেছে। পরিসংখ্যান বলছে, সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সফলতা সর্বোচ্চ। বেড়েছে শিক্ষার বিস্তৃতি। বিদ্যালয়ে ভর্তির হার, নারী পুরুষ সমতা, নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, ঝরে পড়ার হার হ্রাসসহ বহু ক্ষেত্রেই এসেছে সাফল্য। তবে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ‘মেধার বিস্ফোরণ’ ঘটলেও প্রশ্নের মুখেই পড়ে আছে শিক্ষার মান। বিদ্যালয়ের অবস্থা সঙ্কটাপন্ন, নেই অবকাঠামো, যাও আছে তাও জরাজীর্ণ। আছে শিক্ষা প্রশাসনের ব্যাপক গাফিলতি, নেই মনিটরিং। সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় টানতে পারছে না মধ্যবিত্ত ও বিত্তশালী এমনকি শিক্ষক, কর্মকর্তাদের সন্তানকে।
দেশী-বিদেশী গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থাসহ শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রাথমিক শিক্ষায় বিস্তৃতি বেড়েছে অনেক। কিন্তু মান প্রশ্নের মুখে। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সফলতা এসেছে। কিন্তু নানা সঙ্কটে প্রাথমিক শিক্ষাকে কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উন্নীত করা কঠিন হয়ে উঠেছে। কেবল পরীক্ষানির্ভর প্রাথমিক শিক্ষা উদ্বেগের একটা কারণ। প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের অনিয়ম, গাফিলতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে শিক্ষাবিদরা বলেছেন, নেই কোন কার্যকর মনিটরিং। দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব মারাত্মক। এরই মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন মনিটরিংয়ের নামে দুর্নীতি ও শিক্ষক হয়রানিতে ব্যস্ত থাকে। শিক্ষা প্রশাসনকে সঠিক পথে নিয়ে আসতে না পারলে প্রাথমিক শিক্ষার মান ভাল হবে না বলেও মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রগতির দিক তাকালে দেখা যায়, দেশের প্রাথমিক শিক্ষা বিস্তৃতিতে গত ১০ বছরে অগ্রগতি হয়েছে ব্যাপক। যার শুরুটা হয়েছিল জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরেই। ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫ প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা করেছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ’১৩ সালে ২৬ হাজার বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের গৃহীত আরও পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে চার দফার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচী। এ কর্মসূচীতে শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিনেই রঙিন বই তুলে দেয়া, উপবৃত্তি কার্যক্রম, অনগ্রসর এলাকায় স্কুল ফিডিং চালু, সরকারী বিদ্যালয়ে দপ্তরি-কাম-প্রহরী নিয়োগের মতো বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ও খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করতে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতারও আয়োজন করা হচ্ছে। শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টিসহ লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়োগ, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণী চালু, পুল শিক্ষক নিয়োগের উদ্যোগও প্রশংসা পাচ্ছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিদ্যালয়ে ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রমও শুরু হয়েছে।
স্বাধীনতার ৪৭ বছরে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে রীতিমতো বিপ্লব ঘটে গেছে, যা বিশ্বের বহু দেশের কাছে অনুকরণীয়। সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, বিদ্যালয়ে ভর্তির হার শতভাগ, ছাত্রছাত্রীর সমতা, নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, ঝরে পড়ার হার দ্রুত কমে যাওয়াসহ শিক্ষার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রোল মডেল এখন বাংলাদেশ। স্বাধীনতার পর থেকে ধারাবাহিকভাবে এগিয়ে গেলেও শিক্ষার অগ্রগতিতে গত এক দশকই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
সরকারী ভাষ্য, আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা, দেশী-বিদেশী গবেষণা প্রতিষ্ঠান আজ সাক্ষ্য দিচ্ছে যে, শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। একাত্তরে সাক্ষরতার হার যেখানে ছিল ১৬ দশমিক ৮ শতাংশ। সেখানে এই হার এখন ৭০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯০ সালে বাংলাদেশের নারী শিক্ষার হার ছিল বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে কম। ৮০ শতাংশ নারীই ছিল অশিক্ষিত। আজ শিক্ষিত ৫০ শতাংশেরও বেশি নারী।
বাংলাদেশের শিক্ষা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের এক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক স্কুলে মোট ভর্তির হারে শতভাগসহ অন্য শিক্ষায় ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীতে ৬২ শতাংশ, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীতে ৪৪ এবং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ শতাংশে। সংস্থাটি বলেছে, শিক্ষা খাতে ব্যাপক অগ্রগতি অর্জন করেছে বাংলাদেশ। শিক্ষার প্রায় সব ক্ষেত্রেই অভিগম্যতা ও সমতা অর্জনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে উপবৃত্তি।
সংস্থাটির মতে, উপবৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে অধিক সংখ্যায় নিম্ন আয়ের পরিবারের শিশু ও মেয়ের ভর্তির ব্যবস্থা করে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় প্রায় সর্বজনীন অভিগম্যতা অর্জন করে ফেলেছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় বাংলাদেশ নারী-পুরুষ সমতাও অর্জন করেছে। গত ৩০ বছরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করা মানুষের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। শিক্ষার্থীরা গড়ে যে কয়টি শ্রেণী অতিক্রম করতে পারে তার সংখ্যা বেড়েছে। এমনকি দরিদ্রদের ৫৭ শতাংশ ও সাধারণ পরিবারের শিশুদের ৮৩ শতাংশ প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে। প্রতি ১০ প্রাথমিক শিক্ষার্থীর মধ্যে মোটামুটি সাত থেকে আটজন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত যেতে পারে। এর মধ্যে মাত্র তিন থেকে চারজন কোন শ্রেণীতে পুনরাবৃত্তি না করে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীর গন্ডি পেরিয়ে যেতে পারে।
কেবল বিশ্বব্যাংক নয়, সকল হিসাবেই দেখা যায় গত কয়েক বছরে শিক্ষার অগ্রগতির চিত্র। তবে এক্ষেত্রে প্রাথমিকের অগ্রগতি সবচেয়ে বেশি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী একাত্তরে সাক্ষরতার হার ছিল ১৬ দশমিক ৮ ভাগ। ’৭৪ সালে ছিল ২৫ ভাগ। ’৯১ সালে ৩৫ ভাগ, ২০০১ সালে ৪৭ দশমিক ৯ ভাগ, ২০০৩ সালে ৬৫ ভাগ, ২০০৮ সালে ৪৮ ভাগ, ২০০৯ সালে ৫৩ ভাগ এবং ২০১১ সালে ৬২ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আর এখন এই হার প্রায় ৭১ শতাংশ।
১৯৯০ সালের পর থেকে সবার জন্য শিক্ষা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন ও সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে বাংলাদেশের অঙ্গীকারের কারণে সরকারকে এ সেক্টরে বিশেষ নজর দিতে হয়েছে। দেশকে নিরক্ষরতামুক্ত করতে, বিশেষত দরিদ্র পরিবারের ঝরে পড়া ছেলেমেয়ের পুনরায় শিক্ষার ব্যবস্থা করতে এনজিওরাও এ সময় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। তাছাড়া এ সময়কালে বিদেশী সহায়তার সিংহভাগই প্রাথমিক শিক্ষায় ব্যয় হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় বাংলাদেশের সফলতা ঈর্ষণীয় স্থানে পৌঁছেছে। অগ্রগতির চিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, ১৯৯১ সালে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির হার ছিল ৬১ শতাংশ। গত ৫ থেকে সাত বছর উপবৃত্তি আর স্কুল ফিডিং কর্মসূচীতে বিশেষ নজর দেয়ায় এখন বিদ্যালয়ে যাচ্ছে প্রায় শতভাগ শিশু।
তবে প্রাথমিক শিক্ষার প্রসার নিয়ে সকলে সন্তুষ্ট হলেও উদ্বেগ এর মান ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে। আছে নানা প্রশাসনিক সঙ্কট। গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, মানসম্মত শিক্ষা ও শিক্ষক নেই অধিকাংশ কেজিসহ অন্যান্য প্রাইভেট প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তবু কাছাকছি অবস্থান আর কিছুটা চকচকে পরিবেশ পাওয়ায় শিক্ষার্থী বাড়ছে সরকার নিয়ন্ত্রণহীন এসব স্কুলেই। আর এই সুযোগে অলি-গলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে কেজি স্কুল। যার মালিকরা ব্যবসার ক্ষতির ভয়ে সরকারের নিয়ন্ত্রণেও আসতে রাজি নয়। প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও বছরের পর বছর ধরে কেবল নীতিমালা জারি করেই কাজ শেষ করে আছে। নীতিমালা অনুসারে নিবন্ধনেও উদ্যোগ নেই।
শুধু গবেষণা সংস্থারই নয়, সাধারণ মানুষের মনেও মান নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। যেমন- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস না হওয়া, স্কুলগুলোয় মানসম্মত পর্যাপ্ত শিক্ষক না থাকা, শিক্ষা উপকরণের অভাব, সরকারের দেয়া বিনামূল্যের পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তে নোট-গাইডের ওপর শিক্ষার্থীদের নিভরশীলতা বেড়ে যাওয়া, স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টারের প্রতি বেশি আকর্ষণ অনুভব করাসহ নানা বিষয়ে প্রশ্ন এখন সবার।
আবার প্রাথমিক শিক্ষা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেও পঞ্চম শ্রেণীতে সমাপনী পরীক্ষা নিয়েও আছে লাখ লাখ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকের ক্ষোভ। এই পরীক্ষার ভবিষ্যত কি তাও কেউ জানেন না। মন্ত্রণালয়ের স্পষ্ট কোন ঘোষণা না থাকায় জটিলতা আরও বেড়েছে।
এত কিছুর পরও দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর পাবলিক পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ছে। এমনকি আগে যেসব স্কুল ও মাদ্রাসা থেকে একজন শিক্ষার্থীও পাস করত না, এখন সেসব প্রতিষ্ঠানে জিপিএ-৫ পাওয়ার ছড়াছড়ি। পরীক্ষায় পাসের হার বেড়ে যাওয়ায় আশান্বিত মানুষ। কারণ, পরীক্ষায় ভাল ফল করে সবাই পাস করবে, এটা সব অভিভাবকই চান। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষায় কত জিপিএ-৫ পেয়েছে, তা দিয়ে যেমন পরীক্ষার ফলের পরিমাণগত দিক বোঝায় তেমনি যেসব শিক্ষার্থী পরীক্ষায় পাস করছে তারা শিক্ষাক্রমে বর্ণিত শিখন অভিজ্ঞতা কতটুকু অর্জন করতে পেরেছে কিংবা আদৌ অর্জন করতে পারছে কিনা, সেটাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখার স্বার্থেই। পরীক্ষায় পাসের হার বাড়লেই যে গুণগত মান বাড়বে, এ কথাকেই কেবল সব সত্য বলে ধরে নেয়া যায় না।
ঢাকার বাইরে অবস্থিত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় নিয়ে গণমাধ্যমে প্রায়ই প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। মাঝে মাঝেই দেখা যায় ভবন নেই, ‘শিশুরা ক্লাস করছে খোলা আকাশের নিচে’। আবার দেখা যায় ‘শিক্ষক একজন শিক্ষার্থী কয়েক শ’। কয়েক কিলোমিটার নৌকায় পাড়ি দিয়েও স্কুলে শিশুদের যাওয়ার খবর পাওয়া যায়। এখানেই শেষ নয়। এই মুহূর্তেও দেশের দুই হাজার গ্রামে নেই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। যদিও সরকার ইতোমধ্যেই সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়বিহীন দুই হাজার গ্রামের জন্য দেড় হাজার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ শেষ করেছে। এসব এলাকায় ইতোমধ্যেই বিকল্প হিসেবে বাড়ছে কেজি স্কুলসহ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান। তবে প্রাথমিক শিক্ষার এ সঙ্কটের চিত্র দেখাতে গ্রামে যাওয়ার প্রয়োজন নেই কারও।
খোদ রাজধানীর প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর অবস্থাই করুণ। সরকারী পর্যায়ে বহু অনুদান ও প্রণোদনা দেয়া সত্ত্বেও বিদ্যালয়গুলোর অবস্থার কোন পরিবর্তন নেই। বিদ্যালয়ে শিক্ষক সঙ্কট যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে অবকাঠামোগত সমস্যা। এমনকি রয়েছে পানি, বিদ্যুতসহ টয়লেট সমস্যা। গত কয়েকদিনে ঢাকার অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে জানা গেছে, এক দশকেও এ বিদ্যালয়গুলোতে উন্নয়নের কোন ছোঁয়া লাগেনি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খোদ ঢাকায় সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাদান পদ্ধতিই নিম্নমানের, রয়েছে চরম শিক্ষক সঙ্কট। শিক্ষকদের মান নিয়ে প্রশ্ন তো আছেই। তার ওপর সারাদেশের মতো এখানকার শিক্ষকদেরও শিক্ষার বাইরে বিভিন্ন সরকারী কর্মসূচীতে নিযুক্ত করা হয়। জন্মনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচী, শিশু জরিপ কর্মসূচী এবং নির্বাচনী ভোটার তালিকা তৈরিসহ নানা সরকারী কাজে ব্যস্ত রাখা হয় শিক্ষকদের। বিদ্যালয়গুলোর বাহ্যিক অবস্থা নাজুক। রয়েছে ভবন সঙ্কট ও শিক্ষা উপকরণ স্বল্পতা।
সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষিত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের ভর্তি করাতে পারছেন না শিক্ষকরা। এ চিত্র রাজধানী থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা শহর পর্যন্ত প্রায় একই। রাজধানীতে এ চিত্র রীতিমতো ভয়াবহ। মাধ্যমিক বিদ্যালয় সংযুক্ত সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো বাদ দিয়ে রাজধানীর বাকি প্রায় তিন শ’ সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় টানতে পারছে না শিক্ষিক, মধ্যবিত্ত ও বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের। ফলে বস্তিবাসী আর দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরাই পড়াশোনা করছেন সরকারী স্কুলগুলোতে। সরকারী স্কুলের শিক্ষকরাও তাদের সন্তানদের কেজি ও প্রাইভেট স্কুলে পড়াশোনা করাচ্ছেন।
দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো নিয়ন্ত্রণহীন শিক্ষা বাণিজ্য বন্ধে ‘বেসরকারী প্রাথমিক (বাংলা ও ইংরেজী মাধ্যম) বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা’ করা হলেও তা মানছে না কেউ। নিয়মনীতিকে থোড়াই কেয়ার করে চলছে সারাদেশের হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন, নার্সারি, প্রিপারেটরি ও ইংরেজী মাধ্যম প্রাথমিক বিদ্যালয়। নিবন্ধন তো দূরের কথা বিধিমালার আওতায় আসা নার্সারি, কিন্ডারগার্টেন, প্রিপারেটরি ও ইংরেজী মাধ্যম প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধনের আবেদনই করেনি। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় নানা রকম প্রতিশ্রুতির কথা বললেও কার্যত এই শিক্ষার মানে প্রভাব পড়ছে না। রয়েছে প্রশাসনিক অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনাও।
এছাড়াও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে একেক সময় একেক নির্দেশনা ও পরিপত্র জারি হওয়ায় বিভ্রান্তিতে পড়ছেন শিক্ষক ও প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা। প্রশাসনের ঔদাসীনে ২০ থেকে ২৫ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে প্রধান শিক্ষক ছাড়া। তারা গত প্রায় ছয় বছরেও জাতীয়করণ হওয়া সকল বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করতে পারেনি।
জাতীয়করণের পর এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষকের পদ সৃষ্টি করতে পেরেছে গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এছাড়াও প্রায় এক হাজার প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য রয়েছে। শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে ২০১৪ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের পদটি দ্বিতীয় শ্রেণীতে উন্নীত করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। দ্বিতীয় শ্রেণীর হওয়ার কারণে এসব পদে সরকারী কর্মকমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এর আগে মন্ত্রণালয় সরাসরি ওইসব পদে শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারত।
সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে গত বছর সহকারী প্রধান শিক্ষক ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষকের মধ্য থেকে একজনকে প্রধান শিক্ষকের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়। এই উদ্যোগও খুব একটা কার্যকর হচ্ছে না। কারণ, ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে ওই শিক্ষককে অন্য স্কুলে বদলি করা হচ্ছে। আবার প্রভাবশালীদের তদবিরের কারণে জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের বাদ দিয়ে কনিষ্ঠ শিক্ষকদেরও প্রধান শিক্ষকের ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ কারণেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শূন্য পদের সংখ্যা বাড়ছে।
পাঠদান পদ্ধতি পরিবর্তনের নির্দেশনা দিয়ে গত ১৫ অক্টোবর দেশের সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নয়টি নির্দেশ জারি করেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আকরাম আল হাসান। এসব নির্দেশনার মধ্যে রয়েছে, ভাষাজ্ঞান বাড়াতে নিয়মিত পাঠাভ্যাস অত্যন্ত জরুরী। তাই প্রতিদিন বাংলা ও ইংরেজী বই থেকে একটি পৃষ্ঠা পঠনের জন্য বাড়ির কাজ দিতে হবে। এক পৃষ্ঠা হাতের লেখা বাড়ি থেকে লিখে আনতে বাড়ির কাজ দিতে হবে। ক্লাসে প্রথমেই সংশ্লিষ্ট শ্রেণী শিক্ষক সব শিক্ষার্থীকে আবশ্যিকভাবে পঠন করাবেন। শিক্ষকরা নিজেরা শিশুদের সঙ্গে উচ্চারণ করে পাঠ করবেন, এতে শিক্ষার্থীদের উচ্চারণ জড়তা দূর হবে এবং প্রমিত উচ্চারণশৈলী সৃষ্টি হবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে উচ্চারণ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে মনোবল বৃদ্ধির প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। বুক কর্নার ও এসআরএমের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের ন্যূনতম একটি বাংলা ও একটি ইংরেজী শব্দ পড়া, বলা ও লেখা শেখাতে হবে, এর ফলে শিক্ষার্থীদের ভাষার ভা-ার বাড়বে এবং এতে শিশুর বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় কথা বলতে ও লিখতে পারবে।
বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে বহুবার উদ্বেগ প্রকাশ করে প্রতিবেদন দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সম্প্রতি প্রকাশ করা সর্বশেষ প্রতিবেদনেও সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশ তার সব শিশুকে প্রাথমিক স্কুলে নিয়ে আসতে সক্ষম হলেও শিক্ষার গুণগত মান এখনও গভীর উদ্বেগের পর্যায়ে রয়েছে। অন্যান্য নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের মতো বাংলাদেশেরও অসংখ্য শিক্ষার্থী যথাযথ পড়ালেখা ও অঙ্কের ওপর দক্ষতা না থাকায় ভাল চাকরি খুঁজে পাওয়া তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই অবস্থায় শিক্ষার সঙ্কট দূরীকরণে বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে ভাল শিক্ষার জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর আহ্বান জানানো হয়েছে।
‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮ : লার্নিং টু রিয়ালাইজ এডুকেশন্স প্রমিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষা জীবনের ১১ বছরের মধ্যে সাড়ে চার বছর পিছিয়ে থাকছে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা। গুণগত শিক্ষাব্যবস্থা ও মানসম্মত স্কুলের অভাবেই মূলত তারা পিছিয়ে রয়েছে। অথচ দেশে প্রাথমিকে যে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে তা সাড়ে ছয় বছরেই অর্জন করা সম্ভব।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের যা শেখানো হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয় এবং গুণগত মান ভাল নয়। মানসম্মত স্কুলের অভাবে তা হচ্ছে। দেশের প্রাথমিক শিক্ষাস্তরের তৃতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের মধ্যে মাত্র ৩৫ শতাংশ শিক্ষার্থী বাংলা পড়তে পারে। তাও এদের পড়ার মান খুব খারাপ। পঞ্চম শ্রেণীর শিক্ষার্থীর মধ্যে মাত্র ২৫ ভাগ কোনরকম অঙ্কে পাস করতে পারে। বাকি ৭৫ শতাংশ শিক্ষার্থীই পাঠ্যবইয়ের গণিত বোঝে না। এর পেছনে চারটি কারণ খুঁজে পেয়েছে বিশ্বব্যাংক। এগুলো প্রাক-শৈশব অবস্থার অনুন্নয়ন, নিম্নমানের শিক্ষা কৌশল, দুর্বল স্কুল ব্যবস্থাপনা এবং সরকারী শিক্ষায় অপর্যাপ্ত অর্থ ব্যয়। প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বিশ^ব্যাংক বলেছে, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় শিশুর সুস্থ বিকাশবিষয়ক কারিকুলামের অভাব রয়েছে।
শিক্ষকদের পাঠদানের পদ্ধতিও নিম্নমানের। অদক্ষ স্কুল ব্যবস্থাপনা ও তাতে দারিদ্র্যের ছাপও শিক্ষাব্যবস্থার অন্যতম চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া অনভিজ্ঞ প্রশিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ ও স্কুল ম্যানেজমেন্টই প্রাথমিক শিক্ষায় বর্তমানে প্রধান বাধা। প্রতিবেদনে বলা হয়, স্কুলে শিক্ষকদের উপস্থিতি সম্পর্কে সরকারকে নজর দিতে হবে। শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দেশের শ্রমশক্তিকে আরও উন্নত করতে হবে। শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক নিয়োগ দিতে এবং উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতে হবে।
বাংলাদেশের বিশ্বব্যাংকের এ্যাক্টিং কান্ট্রি ডিরেক্টর রবার্ট জে সাম বলছিলেন, বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে সরকারী বিনিয়োগ দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম এবং মালয়েশিয়ার অর্ধেক। এটি সামগ্রিক খরচ না হলেও ওই অর্থ কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তা ভাবতে হবে। শিক্ষা খাতের বাজেটের পুরো অর্থ কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হবে।
শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মমতাজ উদ্দিন পাটওয়ারী বলছিলেন, আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে ব্যাপক। বিদ্যালয়ে ভর্তির হার, নারী-পুরুষ সমতা, নারী শিক্ষায় অগ্রগতি, ঝরে পড়ার হার কমে যাওয়াসহ বহু ক্ষেত্রেই এসেছে সফলতা। তবে শিক্ষার মানে কোন উন্নতি নেই। অ আ ক খ শেখানোর মধ্যেই পরে আছে এ শিক্ষাটি। শিক্ষা প্রশাসনের ব্যাপক গাফিলতি, মনিটরিংয়ের অভাবকে সঙ্কট অভিহিত করে তিনি বলেন, প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। এই বিষয়টিতে সরকারকে নজর দিতে হবে। অন্যথায় মানের পরিবর্তন হবে না।
জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক ড. শেখ ইকরামুল কবির বলছিলেন, এ শিক্ষার প্রসার হয়েছে সংখ্যায়, মনে নয়। দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের অভাব, নামকাওয়াস্তে মনিটরিং, শিক্ষক সঙ্কটসহ বহুমুখী সঙ্কট এখানে। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে একের পর এক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা বাদ দেয়ার পক্ষে এ শিক্ষাবিদ। বলেন, এ শিক্ষাকে পরীক্ষানির্ভর করে ফেলা হয়েছে। শিক্ষানীতি অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত উন্নীত করার বিষয়টিতে কোন অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) এ মহাপরিচালক।
প্রাথমিক শিক্ষকদের অনেক সমস্যা আছে উল্লেখ করে গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, সমস্যা উদঘাটন করে সমাধান করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষার মান ভাল না বলে শিক্ষার্থীরা কেজি স্কুলে যাচ্ছে। সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের কীভাবে ফিরিয়ে আনা যায় তা আপনাদের ভাল ভূমিকার ওপর নির্ভর করবে। তিনি বলেন, আমি লক্ষ্য করেছি, আপনাদের বদলি নিয়ে টিও অফিসে ঝামেলা হয়। অনেক দালাল আপনাদের পেছনে লাগানো আছে। আমি এগুলো টলারেট করব না। কোন শিক্ষা কর্মকর্তা যদি শিক্ষকদের হয়রানি করেন, আমি তাদের মার্সি করব না। কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। আপনাদের মাথা তারা যেন নষ্ট করতে না পারে। আমি দেখছি এক শিক্ষককে এখানে বদলি করে, ওখানে বদলি করে। এর ভেতর দিয়ে টাকাপয়সাও নেয়া হয়। আবার শিক্ষকদের ভেতরে কিছু শ্রেণী আছে তারা আবার টিওর বগলে সুন্দরভাবে বসে আরেক শিক্ষকের ক্ষতি করার ষড়যন্ত্র করে।