কাজিরবাজার ডেস্ক :
নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে শুক্রবার জুম্মার নামাজের সময় দুইটি মসজিদে বন্দুকধারীদের হামলায় তিন বাংলাদেশীসহ ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। মসজিদ দুটি হচ্ছে আল নূর মসজিদ ও লিনউডের মসজিদ। এদিকে সন্ত্রাসী হামলায় নিহতের ঘটনায় শোক ও নিন্দা জানিয়েছেন বিশ্ব নেতারা। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টেরেসা মে ও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান, ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেনো মারসুদি, ফিজির প্রধানমন্ত্রী ফ্রাঙ্ক বাইনিমারামাসহ অনেক বিশ্ব নেতারা রয়েছেন। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডেন মসজিদে হামলার এ ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন’ এবং ‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘নিশ্চিতভাবেই পরিকল্পনা করে এ হামলা চালানো হয়েছে।’ হামলার পর শোক প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী আরডেন বলেন, ‘এটা নিউজিল্যান্ডের অন্ধকারতম দিনগুলোর একটি। এখানে যে ঘটনা ঘটেছে সেটা পরিষ্কারভাবেই অস্বাভাবিক এবং অপ্রত্যাশিত নৃশংসতা।’ অপরদিকে, দুই মসজিদে হামলায় জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। তাদের মধ্যে তিনজন পুরুষ এবং একজন নারী।
গ্রেফতারকৃত ২৮ বছরের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে জানিয়ে পুলিশ কমিশনার বুশ বলেন, শনিবার তাকে আদালতে উপস্থাপন করা হবে। হামলায় জড়িত সন্দেহে আটক এক ব্যক্তি অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক বলে নিশ্চিত করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন। তিনি বলেন, সন্দেহভাজন হামলাকারী ‘একজন চরম ডানপন্থী নৃশংস সন্ত্রাসী’। দুই মসজিদে হামলার পর ক্রাইস্টচার্চ কর্তৃপক্ষ নগরীর সব মসজিদ পরবর্তী নোটিস না দেয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। নগরীর সব স্কুলও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এদিকে অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশী দূতাবাস থেকে পাঠানো এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে তিন বাংলাদেশী নিহতদের খবর নিশ্চিত করা হয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত (নিউজিল্যান্ডেরও দায়িত্বপ্রাপ্ত) বাংলাদেশী হাইকমিশনার মোঃ সুফিউর রহমান জানিয়েছেন, এ ঘটনায় আরও দুইজন আহত হয়েছেন এবং তিন বাংলাদেশী নাগরিক নিখোঁজ রয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায় : প্রত্যক্ষদর্শীরা স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, আল নূর মসজিদে গুলি শুরু হলে তারা প্রাণ বাঁচাতে সেখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যান। মসজিদের বাইরে রক্তাক্ত অবস্থায় লোকজনকে পড়ে থাকতে দেখার কথাও জানান তারা। আল নূর মসজিদ এলাকায় ইব্রাহিম নামে এক প্রত্যক্ষদর্শী নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডকে বলেন, ‘শুরুতে আমি ভেবেছিলাম, বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে এমনটা হচ্ছে। পরে দেখি সবাই দৌড়াতে শুরু করেছে।’ অন্য এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন, ‘হামলাকারী সামরিক বাহিনীর মতো পোশাক পরেছিল। হাতে থাকা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে সে ক্রমাগত গুলি ছুড়তে থাকে।’
গুলির দৃশ্য ‘লাইভ’ : আল নূর মসজিদে হামলাকারী তার হেলমেটে বসানো ক্যামেরায় গুলি চালানোর পুরো দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করেছে। প্রায় ১৭ মিনিটের ওই লাইভে অটোমেটিক রাইফেলধারী ওই ব্যক্তি নিজের নাম বলেছেন ‘ব্রেন্টন ট্যারেন্ট’। ২৮ বছর বয়সের শ্বেতাঙ্গ ওই হামলাকারীর জন্ম অস্ট্রেলিয়ায়। বন্দুকধারী ক্রাইস্টচার্চের ডিন্স এ্যাভিনিউতে আল নূর মসজিদের দিকে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় ‘লাইভ’ শুরু হয়। একটি ড্রাইভওয়ের কাছে তিনি গাড়ি পার্ক করেন। গাড়িতে চালকের পাশের আসনে বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র এবং প্রচুর গুলি দেখা যায়। সেখানে পেট্রোল ভর্তি কয়েকটি ক্যানও ছিল।
ওই ব্যক্তি গাড়ি থেকে নেমে দুইটি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে মসজিদের দিকে হাঁটতে শুরু করে বলে জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার্স। মসজিদে ঢোকার পথেই সে একজনকে গুলি করে। ভেতরে ঢুকে এলোপাতাড়ি গুলি করতে শুরু করে। সে বেশ কয়েকবার তার সেমি-অটোমেটিক রাইফেলটিতে গুলি ভরে এবং এলোপাতাড়ি গুলি করে। এভাবে প্রায় তিন মিনিট ধরে গুলি করার পর সে মসজিদের সামনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। রাস্তার দিকে যাওয়ার সময় সে আশপাশের গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া হামলার ভিডিও সরিয়ে নিতে কাজ করছে ক্যানটারবারি পুলিশ। পুলিশের পক্ষ থেকে কঠোরভাবে ওই ভিডিও শেয়ার না করার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়, ‘ক্রাইস্টচার্চে হামলার ঘটনার চরম বিপর্যয়কর ভিডিওগুলো অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া নিয়ে পুলিশ সচেতন এবং সেগুলো সরিয়ে নিতে কাজ করছে।’
বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিরাপদ : আল নূর মসজিদে বন্দুক হামলার সময় নিউজিল্যান্ড সফরে থাকা বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের কয়েকজন খেলোয়াড় জুম্মার নামাজ আদায় করতে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তারা সবাই নিরাপদ আছেন বলে নিশ্চিত করেছেন দলের কোচ। নিউজিল্যান্ড হেরাল্ডের খবরে বলা হয়েছে, গোলাগুলি শুরুর পরপরই আল নূর মসজিদে পৌঁছেছিলেন বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটাররা। তারা দ্রুত সেখান থেকে সরে যান। শনিবার ক্রাইস্টচার্চে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে তৃতীয় টেস্ট খেলতে মাঠে নামার কথা ছিল বাংলাদেশ দলের। হামলার পর ওই ম্যাচটি বাতিল ঘোষণা করা হয়।
যে তিন বাংলাদেশী নিহত : বন্দুকধারীর হামলায় অন্তত তিন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন বলে সেখানে বাংলাদেশী দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। দূতাবাসের অনারারি কনসাল শফিকুর রহমান ভূইয়া জানিয়েছেন, তিনজন বাংলাদেশীর পরিচয় সম্পর্কেই তারা নিশ্চিত হয়েছেন। এছাড়া মসজিদে হামলার ঘটনায় অন্তত পাঁচজন বাংলাদেশী আহত হয়েছেন। এদের মধ্যে দু’জনের অবস্থা গুরুতর। এছাড়া, হামলার পর দু’জন বাংলাদেশী নিখোঁজ ছিলেন, তবে এদের মধ্যে একজন মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
ক্রাইস্টচার্চ শহর জুড়ে সতর্কতা : সন্ত্রাসী হামলাকে ‘গুরুতর ঘটনা’ উল্লেখ করে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে পুলিশ। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে শহরের হাসপাতাল ও সব স্কুলে যে যেভাবে আছে, সেভাবেই ভেতরে থাকতে নির্দেশে দেয়া হয়েছে। বাসিন্দাদের বাসা থেকে বের না হতে নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ। এ ছাড়া ঘটনাস্থল থেকে লোকজনকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। এদিকে দেশটির অকল্যান্ড সিটি সেন্টারে একটি জায়গা ঘিরে রেখেছে পুলিশ। নিউজসাইট স্টাফ ডট এনজেড জানিয়েছে, ক্যানটারবারি ডিস্ট্রিক্ট হেলথ বোর্ডের মুখপাত্র জানিয়েছেন, হতাহত ব্যক্তিদের জন্য তারা জরুরী ভিত্তিতে পরিকল্পনা করেছেন। জরুরীভাবে কক্ষ খালি করা হয়েছে।