কাজিরবাজার ডেস্ক :
একাত্তরের গোটা মার্চ মাসই ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে দীর্ঘ ২৪টি বাঙালি জাতিকে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এগোতে হয়েছে। লক্ষ্য স্থির করে, ধাপে ধাপে আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করে প্রস্তুতি গ্রহণ করেন তিনি। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার উপযোগী পরিস্থিতির শুরুটা হয়েছিল মূলত ৬ দফার মধ্য দিয়েই। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের পর এ দেশ যে স্বাধীনতা আন্দোলনের পথে এগোচ্ছিল তা স্পষ্ট হয়ে যায় ’৭১ এর মার্চেই। ঊনসত্তরের বিশাল গণআন্দোলনে সামরিক শাসক আইয়ুব খানের পতন হলো। ক্ষমতা দেয়া হলো সর্বকালের নৃশংস দানব ইয়াহিয়া খানের কাছে। নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যেই বঙ্গবন্ধু ’৭০-এর নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। বঙ্গবন্ধু সত্তরের নির্বাচনকে নিলেন তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গণভোট হিসেবে। আর ব্যালটে তিনি এমন অভাবিত বিজয় অর্জন করলেন যখন পাকিস্তানীদের বুলেট, ট্যাঙ্ক, কামান সবই তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। এ নির্বাচনে বাঙালিরা বঙ্গবন্ধুর ছয় দফার প্রতি সমর্থন জানিয়ে তাঁকে অভূতপূর্ব একটা বিজয় উপহার দিয়েছিল। ’৭১-এর শহীদ দিবস ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এ দিনটিতে মধ্যরাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে মশালের আগুনে উদ্দীপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এই বাংলার স্বাধিকার-বাংলার ন্যায্য দাবিকে বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে। কিন্তু বাংলার সাত কোটি মানুষ আর বঞ্চিত হতে রাজি নয়। আমরা আমাদের অধিকার আদায়ের জন্য প্রয়োজন হলে আরও রক্ত দেব। বাংলার ঘরে ঘরে আজ দুর্গ গড়ে তুলতে হবে। সামরিক শাসকচক্রের সঙ্গে মিলে ভুট্টো যে ভূমিকায় লিপ্ত তাতে এটা স্পষ্ট যে, পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী কোনভাবেই বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১ এক জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জনসাধারণের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া বানচালের চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জাগ্রত জনতা, কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র ও জনগণকে বিজয় বানচালের ষড়যন্ত্র প্রতিরোধ করার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচালের উদ্দেশে ইচ্ছাকৃতভাবে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করা হচ্ছে।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আকস্মিক এক বেতার ভাষণে ৩ মার্চ ঢাকায় আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। অধিবেশন স্থগিতের খবর ছড়িয়ে পরার পর ঢাকায় বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা বিমানবন্দর এবং পিআইএর মতিঝিল অফিসের কর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে অফিস ছেড়ে চলে যান। ফলে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে প্রদেশের বিভিন্ন রুটে এবং আন্তঃদেশীয় রুটে বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বেতারে ইয়াহিয়ার বিবৃতি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাঙালী জাতি অপেক্ষা করতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাদের কী নির্দেশ দেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার মধ্য দিয়ে ভুট্টো এবং জেনারেলদের মধ্যকার ঐকমত্যের বিষয়টি সামনে এলো। এ রকম একটি ষড়যন্ত্র হতে পারে এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্বেই ধারণা করেছিলেন এবং তার অবস্থান অত্যন্ত পরিষ্কার করে জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন। সেদিন হোটেল পূর্বাণীতে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি বোর্ডের সভায় ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজ চলছিল। পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক শেষে হোটেল পূর্বাণীতে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার কঠোর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেন, বাংলার জনগণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এই সিদ্ধান্তকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তিনি এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সর্বাত্মক আন্দোলনের কর্মসূচী হিসেবে ২ মার্চ ঢাকা শহরে ও ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল পালন এবং ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করেন। ৭ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু সর্বাত্মক আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মপন্থা ঘোষণা করবেন বলে জানান। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণায় বিক্ষুব্ধ মানুষ হোটেল পূর্বাণীর সামনে এসে সমবেত হয়ে স্লোগানে স্লোগানে ঢাকার রাজপথ প্রকম্পিত করে তোলেন। বঙ্গবন্ধু হোটেলের সামনে এসে সবাইকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। আমি মর্মাহত। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছেন। আমি সংগ্রাম করে এ পর্যন্ত এসেছি। সংগ্রামের মাধ্যমে এ দেশের মানুষের মুক্তি আনব। বিকেল ৩টায় ছাত্রলীগের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে প্রতিবাদ সভা জনসমুদ্রে পরিণত হয়। রাতে বঙ্গবন্ধু তাঁর ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবনে পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন।
সন্ধ্যার পর তিনি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে আলোচনার জন্য তাঁর প্রতিনিধি প্রেরণ করেন। পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রধান খান আবদুল কাইয়ূম খান প্রেসিডেন্টের ঘোষণাকে ‘একমাত্র সঠিক সিদ্ধান্ত’ হিসেবে অভিহিত করে স্বাগত জানালে এর প্রতিবাদে মহাসচিব খান এ. সবুর দলের সদস্যপদ ও সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেন। রাতে প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল এ.এম. ইয়াহিয়া খান ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক শাসনকর্তা লে. জেনারেল সাহেবজাদা এম. ইয়াকুব খানকে প্রদেশের বেসামরিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। গভীর রাতে ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক প্রশাসক এক নতুন আদেশ জারি করে সংবাদপত্রে দেশের অখন্ডতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কোন খবর বা ছবি প্রকাশ না করার নির্দেশ দেন। ’৭১-এর এই দিনে ঢাকা বণিক ও শ্রমিক সংঘের সমাবেশে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র কায়েমের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শেখ মুজিব। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার সঙ্গে সঙ্গে ফুঁসে ওঠে চট্টগ্রামবাসী।
কবি আবদুল কাদির, কমরেড মোজাফ্ফর, মাস্টারদা সূর্য সেন, প্রীতিলতার চট্টগ্রাম সেই ব্রিটিশ আমল হতে পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে এসেছে। রেডিওতে খবরটি প্রচারের পর পর চট্টগ্রাম কলেজ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম পলিটেকনিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ, চট্টগ্রাম সিটি কলেজসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন শাখা ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানবিরোধী মিছিল বের করে। সেদিনের একটি মিছিল অন্যসব মিছিল থেকে একটু আলাদা ছিল। সেটি ছিল পূর্ব মাদারবাড়ী রেলগেটের পার্শ¦বর্তী মেথরপট্টি হতে মেথর কালীচরণের নেতৃত্বে বের হওয়া মিছিল। একাত্তরের সংগ্রাম ছিল বাংলার গণমানুষের সংগ্রাম। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালির অধিকার আদায়ের সকল সংগ্রামে চট্টগ্রামবাসীর বীরদীপ্ত অংশগ্রহণ, অতুলনীয়।