জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং গণমাধ্যমের তদন্ত ও অনুসন্ধানে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে পরিচালিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বেশ কিছু দেশ গণহত্যার জন্য দায়ী সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞাও জারি করেছে। জাতিসংঘের স্বাধীন সত্যানুসন্ধানী দলের প্রতিবেদন এবং পরে মানবাধিকার পরিষদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ বিচারের প্রয়োজনে সেসব অপরাধের তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণের জন্য আন্তর্জাতিক নিরপেক্ষ ও স্বাধীন কাঠামো (ট্রিপল আইএম) সৃষ্টি করেছে। সেই কাঠামো শিগগিরই কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। অথচ মিয়ানমার গত সপ্তাহেও জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক দপ্তরে পেশ করা প্রতিবেদনে গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো গুরুতর সব অপরাধের কথা বেমালুম অস্বীকার করেছে। কিন্তু মিয়ানমারের এভাবে গায়ের জোরে সব কিছুকে অস্বীকার করার অপচেষ্টা কেন? আর মিয়ানমার অস্বীকার করলেই কি সব সত্য মিথ্যা হয়ে যাবে?
গণমাধ্যমে ছবি, ভিডিওসহ মিয়ানমারে সংঘটিত গণহত্যার বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মামলার প্রস্তুতি চলছে। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানসহ অনেক বিশ্বনেতাই মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নিধন অভিযানকে গণহত্যা বলে উল্লেখ করেছেন। মিয়ানমার যে জোটের শরিক সেই আসিয়ানভুক্ত অনেক দেশও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেছে। এর পরও মিয়ানমারের এমন অস্বীকৃতির মধ্য দিয়ে তাদের একগুঁয়েমি মনোভাবই প্রকাশ পায়। স্পষ্ট হয় যে মিয়ানমারের গণহত্যাকারী মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। সে ক্ষেত্রে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে মিয়ানমার মুখে যেসব কথা বলছে, তা তাদের মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আর সে কারণেই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরির কোনো চেষ্টাই করছে না। এখন জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১৩ লাখ রোহিঙ্গার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। মিয়ানমারের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের জবাবে করণীয় নিয়েও ভাবতে হবে।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রতি অমানবিক আচরণ করে আসছে। তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সীমিত করে ফেলা হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সব মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এর পরও নানা অজুহাতে রোহিঙ্গাদের ওপর বারবার হামলা ও নির্যাতন চালানো হয়েছে। সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায় বেশির ভাগ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছে। ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশ কত দিন তাদের আশ্রয় ও ভরণ-পোষণ চালিয়ে যেতে পারবে? বাংলাদেশে তাদের স্থায়ীভাবে বসবাস করতে দেওয়ার কোনো সুযোগই নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এ বিষয়টিও ভাবতে হবে। তাই মানবতার স্বার্থে বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে গণহত্যায় নেতৃত্বদানকারীদের বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।