॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
এটাকে উপেক্ষা করতে পারে। আবার কারো জীবন ধারণ উপযোগী অত্যাবশ্যকীয় বিষয়গুলো না থাকলে তাকে সাহায্য করার লক্ষ্যে বিলাসিতাকে পরিহার করা যায়। কখনো আবার আরাম-আয়েশ পরিহার করাটা প্রায়শ্চিত্ত করার মাধ্যমে হতে পারে। কিন্তু আরাম-আয়েশটা জৌলুসের পর্যায়ে পৌছে গেলে অথবা সীমা ছাড়িয়ে গেলে ইসলাম সেটাকে অনুমোদন দেয় না।
একজন মানুষ সৎ ভাবে জীবন যাপন করার লক্ষ্যে অবিরত সংযমের পরিচয় দিল। অন্যজনে হয়ত অস্তোপাচারের মাধ্যমে তার ইচ্ছাকে নষ্ট করে দিয়ে সৎ থাকার চেষ্টা করল। এক্ষেত্রে দ্বিতীয়জন অপেক্ষা প্রথমজন অবশ্যই উচ্চ মর্যাদার অধিকারী। আর এটা তো জানা কথা যে, যে ব্যক্তির অন্যায় করার সুযোগ থাকার পরও আল্লাহ পাকের ভয়ে সেগুলো থেকে বিরত থাকে, সে অবশ্যই যে ব্যক্তির কোন খারাপ কাজ করার সামর্থ্য নেই, সে অপেক্ষা উত্তম।
আত্মসংযম, মদ্যপান পরিহার এবং অন্যান্য ধর্মীয় আচরণ বিশেষ কতকগুলো কর্ম ক্ষমতার বিকাশকে যত বিস্ময়করই হোক না কেন এগুলো কখনো একজন মু’মিন মুসলমানের লক্ষ্য হতে পারে না। তিনি কেবলমাত্র আরাধ্য কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার প্রতি মনোনিবেশ করেন। এবং বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর উদ্ভব ঘটে তার সযতœ সাধনার উপজাত হিসাবে। এমন কি স্বীয় সাধনা বলে একজন নাস্তিক ও সাধকের কতকগুলো কর্মদক্ষতা হয়তো অর্জন করতে পারে। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, পরকালেও সে নাযাত পাবে, সূফী লাগাতার তাঁর লক্ষ্যস্থলের দিকে পরিচালিত হন। এই দীর্ঘ সফরে তিনি কি পেলেন, কতটুকু অর্জিত হল তা ভেবে দেখেন না।
একজন সূফী বা দরবেশের আধ্যাত্মিক জীবন শুরু হয় অনুশোচনার (তওবা) মধ্য দিয়ে। তিনি অনুশোচনার করে থাকেন অতীতের পাপ কর্ম, অন্যদের প্রতি তার ক্ষতিকর আচরণ বা অন্যায় অপকর্মের জন্য। স্মরণ রাখতে হবে যে, আল্লাহর প্রতি বান্দার যে দায়িত্ব তা পালন করলেও আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। কিন্তু অন্যান্য সৃষ্টি জীবের অধিকার হরণ করলে আল্লাহ তা ক্ষমা করেন না। এ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সৃষ্টি জীবই পারে তাকে ক্ষমা করতে। বস্তুতপক্ষে এ ধরনের অনুশোচনার মধ্য দিয়ে একজন মানুষ এমন একটি পথ পরিক্রমা দিয়ে অগ্রসর হয় যা তাকে পৌছে দিতে পারে আল্লাহর সান্নিধ্যে। এখান কোন বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কোনরকম একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। বরং যে কোন মানুষের জন্যই ইবাদতের এ ধারাটি উন্মুক্ত এবং প্রতিটি মানুষের এ পথে অগ্রসর হওয়া কর্তব্য। এ ধরনের আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে দ্বিবিধ ব্যবস্থা রয়েছে একটি আল্লাহর প্রতি নিরঙ্কুশ আনুগত্য, দ্বিতীয়টি সর্বাবস্থয় আল্লাহর যিকর করা। একজন মানুষকে কি করতে হবে এবং আল্লাহ কোনটা পসন্দ করেন তা সে ভালভাবেই জানে এবং সে কারণেই আনুগত্য করাটা তুলনামূলকভাবে সহজ। অপরদিকে আল্লাহ তা’আলা তাঁর ইরাদা এবং নির্দেশগুলোকে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন। তাঁর মনোনীত নবী-রাসূলই এগুলো পৌছে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের কাছে। তাই কোন মানুষের জন্য আধ্যাত্মিক সাধনায় লিপ্ত হওয়া কঠিন কোন কাজ নয়।
ধরাবুকে আল্লাহ তা’আলা অসংখ্য নবী-রাসূল পাঠিয়েছেন। তাঁদের শিক্ষার বিষয়বস্তুর মধ্যেও কিছু পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু সেটা এ করণে নয় যে আল্লাহ তাঁর মত পালটে ফেলেছেন। বরং সেটা এ জন্য যে, মানুষের অধঃপতন বা ক্রমবিকাশের কারণে তাদের আচরণ বিধি ও শিক্ষার মধ্যে এ ধরনের পরিবর্তন জরুরী ছিল। বস্তুতপক্ষে নবী-রাসূলগণের শিক্ষার মধ্যে, যে বিষয়গুলো স্রষ্টার সঙ্গে সৃষ্টিজীবের সম্পর্ক সংক্রান্ত সেগুলোর ব্যাপারে কোন পার্থক্য নেই। তবু একথা সত্য যে, আল্লাহর তরফ থেকে সর্বশেষ যে বিধান নাযিল হয়েছে, মানুষকে তা মেনে চলতে হয়। এটাও আল্লাহর আদেশ-নিষেদের প্রতি সৃষ্টিজীবের আনুগত্য প্রকাশের একটি অংশ। এবং কুরআন মজীদে এ ব্যাপারে যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে।
উদারহণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে, হযরত ইবরাহীম (আ.) এর মাধ্যমে আল্লাহ তা’আলা মানুষকে যে বিষয়ে শিক্ষা দিলেন, মুসা (আ.) এর আমলের লোকেরা সে শিক্ষাকে পরিত্যাগ করল এবং মুসা (আ.) এর উপর নাযিলকৃত শিক্ষাকে গ্রহণ করল। এ স্থলে ইবরাহীম (আ.) এর শিক্ষাকে পরিত্যাগ করার জন্য মুসা (আ.)-এর শিক্ষাকে পরিত্যাগ করার জন্য মুসা (আ.)-এর অনুসারীদের অবাধ্য বলা যাবে না। বরং মুসা (আ.) এর উপর অবতীর্ণ হয়েছে যে, নির্দেশাবলী তা অবহেলা করা এবং ইবরাহীম (আ.) এর শিক্ষার উপর অবিচল থাকাটা হবে অমার্জনীয় অপরাধ ও অবাধ্যতা। কারণ একই বিধানদাতা আল্লাহ তা’আলার সর্বশেষ ইচ্ছাগুলো মুসা (আ.) এর নিকট অবতীর্ণ হয়েছে। তাই বিভিন্ন যুগে নবী বা রাসূলগণ আল্লাহর যে বাণী নিয়ে এসেছেন সমসাময়িক কালের লোকদের তা মেনে চলতে হবে পরিপূর্ণভাবে। আর নবী-রাসূলগণের মধ্যে হযরত মুহাম্মদ (সা.) হলেন সর্বশেষ নবী। একজন মুসলমানকে পূর্ববর্তী সকল নবী-রাসূলের উপর অটল বিশ্বাস রাখতে হবে। কিন্তু সর্বশেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর মাধ্যমে যে বাণী আল্লাহ তা’আলা মানুষের নিকট পৌছে দিয়েছেন, তা মেনে চলতে হবে পুরোপুরি ভাবে। অর্থাৎ একজন মুসলমান তৌরাত, যবুর ও ইঞ্জিলে আল্লাহর কালাম হিসাবে পরিপূর্ণ ঈমান রাখে। একই সময়ে সে আল্লাহর সর্বশেষ কালাম আর কুরআনকে মেনে চলে আন্তরিক নিষ্ঠার সঙ্গে। কেউ যদি আল কুরআনকে বাদ দিয়ে পূর্বের কোন বিধি-বিধান অনুসরণ করে, তাহলে সে কখনো আল্লাহর অনুগত বাধ্য বলে বিবেচিত হতে পারে না।
উপসংহার ঃ মানুষ গড়ে উঠেছে আত্মা ও শরীরের সমন্বয়ে। প্রথমটির অস্তিত্ব অভ্যন্তরীণ, দ্বিতীয়টি বাহ্যিক। খাঁটি মুসলমান হওয়ার জন্য প্রয়োজন এ দুটি বিষয়ের সুষম অগ্রগতি এবং পরিপূর্ণ বিকাশ। সে কারণেই প্রতিটি মানুষকে শারীরিক ও আত্মিক উভয়বিধ বিষয়ের উপর সমান গুরুত্ব আরোপ করতে হয়। ইসলামে আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্যে রয়েছে দুটি দিক-একদিকে সে আত্ম চিন্তাকে নিয়ে আসবে সর্বনিম্নস্তরে। অর্থাৎ সে অহংবোধকে সংযম করবে। অপরদিকে সে আল্লাহর সান্নিধ্য বা উপস্থিতির অনুভূতিকে অবিরত জোরদার করবে। আল্লাহর ইচ্ছা ও বিধানের কাছে আত্মসমর্পণ করার অর্থ এই নয় যে, সে স্থবিরতায় আক্রান্ত হবে অথবা তার মধ্যে বিরাজ করবে পূর্ণ অচলাবস্থা। বরং সে নিষ্ক্রিয় থাকবে। কুরআনুল করীমের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তা’আলা মানুষকে কর্মে প্রবৃত্ত হওয়ার জন্য উপর্যুপরি তাকীদ দিয়েছেন। এমনকি ‘আমালুস সালেহ’ এর মধ্য দিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য পরস্পরের মধ্যে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। নিজের চিন্তা-ভাবনা, ইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলোকে পরিহার করে কেবলমাত্র আল্লাহর ইচ্ছার উপর নিজেকে সপে (তাওয়াক্কুল) দিতে হবে। বলা বাহুল্য আল্লাহর ইচ্ছার উপর সপে দেয়ার অর্থ এই নয় যে কর্মবিমুখ হয়ে বসে থাকবে।
আল্লাহ তা’আলা যা ইচ্ছা করেন, মানুষের জীবনে তাই ঘটে। কিন্তু মানুষ কখনো তাকদীর বা আল্লাহ কী নির্ধারণ করে রেখেছেন, তা জানতে পারে না। এটা থাকে তার জ্ঞানের বাইরে। একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে পৌছার প্রচেষ্টায় বার বার সে ব্যর্থতায় পর্যবশিত হয়। তবু তাকে বিরামহীনভাবে চেষ্টা করতে হয়। কারণ সে ভালভাবেই জানে যে, এতে দোষের কিছু নেই এবং এটা আল্লাহ বিধানে সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বস্তুতপক্ষে তকদীর একটি রহস্যময় ব্যাপার। এটা মানুষকে কর্মে প্রবৃত্ত করে। আবার একই সময়ে আল্লাহর ইচ্ছার উপর নিজেকে সপে দিতে বলে। তকদীরের এ তাৎপর্যটি কুরআনুল করীমে বর্ণি হয়েছে। ইরশাদ হচ্ছে ঃ পৃথিবীতে অথবা ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের উপর যে বিপর্যয় আসে আমি তা সংঘটিত করার পূর্বে লিপিবদ্ধ থাকে। আল্লাহর পক্ষে এটা খুবই সহজ। এটা এ জন্য যে তোমরা যা হারিয়েছ তাতে যেন তোমরা বিমর্ষ না হও এবং যা তিনি তোমাদের দিয়েছেন সে জন্য উৎফুল্ল হও। আল্লাহ পছন্দ করেন না উদ্ধাত ও অহংকারীদেরকে (৫৭ঃ ২২-২৩)।
মানুষকে সব সময় আল্লাহর কুদরত ও মর্যাদা সম্পর্কে ভাবতে হবে। তাকে ভাবতে হবে মানুষের বিনয়-নম্র স্বভাব সম্পর্কে। তাকে আরো জানতে হবে যে, পুনরুত্থান দিবসে আল্লাহ তা’আলা মানুষের কাছে তার কৃতকর্মের হিসাব চাইবেন। আল্লাহ তা’আলা ইরশাদ করেন ঃ যারা আমার উদ্দেশ্যে সংগ্রাম করে আমি তাদেরকে আমার পথে পরিচারিত করবো। আল্লাহ অবশ্যই মুহসিনদের সঙ্গে থাকেন (২৯ঃ৬৯)। (সমাপ্ত)