আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো

91

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বায়ান্নর রক্তঝরা দিনগুলো। মায়ের ভাষা কেড়ে নেয়ার এই সংগ্রামে সেদিন ছাত্র জনতা এক সঙ্গে রাজপথে নেমে পড়েন। ভাষার প্রশ্নে সেদিন বাংলার মানুষ বীর সেনানী হিসেবে পৃথিবীর ইতিহাসে স্থান করে নেন। মাতৃভাষা বাংলাকে যে কোন মূল্যে রক্ষা করার জন্য রাজপথে পাকিদের বন্দুকের নলের মুখে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছিলেন বীর বাঙালি। সেদিন অনেক শহীদের রক্তে ভিজে লাল হয়েছিল ঢাকার কালো রাজপথ।
বদরুদ্দীন উমরের লেখা ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-১ খন্ডে বলেছেন, ভাষা নিয়ে প্রথম রাজনৈতিক সংগ্রাম ‘গণপরিষদে ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব উত্থাপনের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনে বিরোধী দল দুটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রথম প্রস্তাবটিতে বৎসরে অন্তত একবার ঢাকায় পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের দাবি জানানো হয়। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি ছিল ভাষা বিষয়ক। এটিতে উর্দু এবং ইংরেজীর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে ব্যবহার করার দাবি উত্থাপন করা হয়। প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন পূর্ব বাঙলার প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। প্রস্তাবটি ধীরেননাথ দত্ত ব্যক্তিগতভাবেই করেছিলেন। পরে ধীরেননাথ দত্ত বদরুদ্দীন উমরকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেন, ‘বাংলাভাষা’ আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা হোক ইহাই ছিল আমার প্রস্তাব। ইহা আমার পার্টি প্রস্তাব ছিল বলিয়া মনে হচ্ছে না। পরে ধীরেননাথ দত্তের এই প্রস্তাব কংগ্রেস দলের সমস্ত সদস্যই সমর্থন করেন এবং কয়েকজন সপক্ষে বক্তৃতা দেন। প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবটি ২৪ ফেব্রুয়ারি আলোচিত হয় এবং তমিজুদ্দীন খান সেটির বিরোধিতা করার পর পরিষদ কর্তৃক তা বাতিল হয়ে যায়। ভাষা বিষয়ক দ্বিতীয় প্রস্তাবটি আলোচিত হয় অধিবেশনের তৃতীয় দিন। এই অধিবেশনে ভাষা নিয়ে আলোচনাকালে গণপরিষদে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি হয়। ধীরেননাথ দত্ত কর্তৃক উত্থাপিত এই প্রস্তাবটির বিরোধিতা করে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। লিয়াকত আলী বলেন, এখানে এ প্রশ্নটা তোলাই ভুল হয়েছে। এটা আমাদের জন্য একটি জীবনমরণ সমস্য। আমি অত্যন্ত তীব্রভাবে এই সংশোধনী প্রস্তাবের বিরোধিতা করবেন এবং আশা করি যে এ ধরনের একটি সংশোধনী প্রস্তাব গণপরিষদ অগ্রাহ্য করবেন।
রাজনৈতিকভাবে এখান থেকেই শুরু হয় বাংলা ভাষার ওপর প্রথম আঘাত। গণপরিষদে কংগ্রেস দলের সেক্রেটারি রাজকুমার চক্রবর্তী সংশোধনী প্রস্তাবটির সমর্থনে বলেন, উর্দু পাকিস্তানের কোন প্রদেশেরই কথ্য ভাষা নয়। তা হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের উপরতলার কিছুসংখ্যক মানুষের ভাষা। পূর্ব বাংলা এমনিতেই কেন্দ্রীয় রাজধানী করাচী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত, তার ওপর এখন তাদের ঘাড়ে একটা ভাষাও আবার আবার চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে। একে গণতন্ত্র বলে না। আসলে এ হলো অন্যদের ওপর উচ্চশ্রেণীর আধিপত্য বিস্তারের প্রচেষ্টা। বাংলাকে আমরা দুই অংশের সাধারণ ভাষা করার জন্য কোন চাপ দিচ্ছি না। আমরা শুধু চাই পরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলার স্বীকৃতি। ইংরেজীকে যদি সে মর্যাদা দেয়া হয় তাহলে বাংলা ভাষাও সে মর্যাদার অধিকারী। পাকিস্তানিরা ভাষাকে নিয়ে যেমন রাজনৈতিক খেলা খেলতে শুরু করে গণপরিষদে সেখানে পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিরা তেমনি রাজনৈতিকভাবে প্রতিবাদে সোচ্চারও ছিলেন।
মাতৃভাষা আন্দোলনের শুরুটা ১৯৪৭ সালের পর থেকেই শুরু হয়। পাকিস্তান জন্মের পর থেকেই পূর্ব বাংলা মানুষ বঞ্চিত ও শোষিত হয়ে আসছিল। পাকিস্তান কৌশলে বাঙালী জনগোষ্ঠী নিজের ভাষার ওপর প্রথম আঘাত হানে। মায়ের ভাষায় কথার বলাও তারা বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র শুরু করে। কিন্তু বাংলার মানুষ সেই ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করতে একবিন্দু পিছু হঠেনি। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিদিন রাজপথে চলতে থাকে মিছিল সমাবেশ। শুরু হয় বাংলাভাষা রক্ষার আন্দোলন। মায়ের মুখের ভাষাকে কেড়ে নিয়ে তারা রাষ্ট্রভাষা উর্দু করতে চেয়েছিল। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অনেক চড়াই-উতরাই পার করে চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তবে তার আগের দিনগুলো ছিল পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠীর অত্যাচার নির্যাতনের। ১৯৫২ সালের আগুন ঝড়া দিনগুলো বিশ্বের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে লেখা বিভিন্ন গবেষকের গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, পূর্ব পাকিস্তানে বহু আগেই ভাষা চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল। কিন্তু দ্বিজাতিতত্ত্বের আবিষ্কারকরা ঘন আবেগ বুঝতে পারেননি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প দিনের ব্যবধানে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলার মানুষ পাকিস্তানবিরোধী হয়ে উঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে নামেন। ভাষার দাবি চিরতরে স্তব্ধ করতে পাকিস্তান সরকারের বর্বর পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালাতেও দ্বিধা করেনি। সেদিন আবুল বরকত, আবদুল জব্বার ও আবদুস সালাম, শফিক, রফিকসহ নাম না জানা অনেক ছাত্র-যুবা শহীদ হন। এর প্রতিবাদে ঢাকাবাসী ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলে ছাত্ররা সমবেত হন। ছাত্রদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ ফেটে পড়েন। পরের দিন ২২ ফেব্রুয়ারি আবারও রাজপথে নেমে আসেন ছাত্র জনতা। তারা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের জন্য অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় অংশ নেন। স্বজন হারানোর স্মৃতি অমর করে রাখতে ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে স্মৃতিস্তম্ভ। ২৬ ফেব্রুয়ারি এটি গুঁড়িয়ে দেয় পুলিশ বাহিনী। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও বেগবান হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল আসন নিয়ে জয়লাভ করে। ৯ মে অনুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়।
এদিকে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বাংলা ভাষা বর্তমানে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা হিসেবে স্বকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের কাছে কানাডা প্রবাসী দুই বাঙালী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন। ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে পালিত হচ্ছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়। এখন তাই শুধু বাংলাদেশের নয়, বরং বিশ্ববাসী বাংলা ভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে আসছে।