॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আধ্যাত্মিক সাধনার কতকগুলো স্তর রয়েছে। একজন সাধক একটি স্তর অতিক্রম করে পরবর্তী স্তরে গিয়ে পৌছে। রাসূলে করীম (সা.) এর জীবনী থেকেও আমরা দেখতে পাই যে, তিনি শুরু করেন হেরা পর্বতের নির্জনতা থেকে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। এর পর ওহী লাবের প্রত্যাশায় চরম সংযমের পরিচয় দেন। কেবলমাত্র হিজরতের পরই তিনি শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে জুলুম নির্যাতনের বিরদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এ সময় সর্বক্ষণের জন্য ওহী নাযিল হতে থাকে।
আধ্যাত্মিক সাধনায় কে কোন স্তরের তা বলা দুস্কর। এমনটা হওয়া সম্ভব যে, একজন লোককে পোশাক-পরিচ্ছদে দরবেশ বলে মনে হলেও আসলে তার অবস্থা হল ভেড়ার পালের ছদ্মবেশী সিংহের মতো। আবার এমনও হতে পারে যে, একজন রাজা তার পুঞ্জীভূত সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তিনি এগুলো থেকে কোন সুযোগ সুবিধা গ্রহণ করেন না। কিন্তু দায়দায়িত্ব পালন করে তিনি অদ্ভূত রকমের আত্মসংযমের পরিচয় দেন। সকল প্রকার বিলাস-বৈভব ও আরাম-আয়েশ পরিত্যাগ করে তিনি সহজ-সরল জীবন যাপন করেন। তিনিই আসল দরবেশ। ইলমে তাসাওউফের উচ্চতর স্তরে তার অবস্থান।
অহংকার থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন বিনয় ও নম্রতা। সাধনা বলে একাকে অর্জন করতে হয়। অপরদিকে গর্ব বা অহংকারকে বিবেচনা করা হয় আল্লাহর সঙ্গে গাদ্দারী হিসাবে এবং এটা মস্তবড় পাপ। ইমাম গাজ্জালী (র) এর ভাষায় জাঁকজমক ও বাহ্যাড়ম্বর হল নিজের অহংবোধের দাসত্বের নামান্তর এবং সে কারণে এটাকে বলা যায় এক ধরনের হবুদেববাদ।
মানুষের মেজাজ ও প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য থাকার কারণেই আধ্যাত্মিক সাধনার পন্থা ও প্রক্রিয়ার মধ্যেও বিভিন্নতা রয়েছে। আধ্যাত্মিক সাধনার জন্য অনেকে পীর-মুুর্শিদের প্রয়োজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তাদের ধারণা মতে আধ্যাত্মিক সাধনার বিষয়টি চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়নের মতো। ব্যক্তিগত উদ্যোগে কেই চিকিৎসা শাস্ত অধ্যয়ন করলেও শিক্ষানবিশ হিসাবে একজন দক্ষ ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের অধীনে কিছুকাল অধ্যয়ন করতে হয়। অন্যথায় তাকে চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র দেয়ার সুযোগ দেয়া হয় না। আধ্যাত্মিক সাধনার ব্যাপারটিও তদ্রƒপ। কারণ নিজের দোষ-ত্র“টিগুলো নিজে দেখার এবং তাৎক্ষণিকভাবে তা সংশোধন করে নেয়া সম্ভব হয় না। সে কারণেই আমাদের দোষ-ত্র“টিগুলো ধরিয়ে দেয়ার জন্য প্রথমেই প্রয়োজন একজন পীর-মুর্শিদ বা শিক্ষকের। এ সমস্ত দোষ-ত্র“টিগুলো থেকে উত্তরণের পথও তিনি দেখিয়ে দেন।
বস্তুতপক্ষে প্রতিনিয়ত ব্যক্তির বিকাশ ঘটছে এবং বিবর্তনের মধ্য দিয়ে সে গ্রহণ করছে একটি স্থায়ী পথ পরিক্রমা। এই বিবর্তন প্রক্রিয়ার পীর-মুর্শিদ অপ্রয়োজনীয় কতকগুলো প্রচেষ্টাকে পরিহার করতে সাহায্য করেন। কেউ যদি অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিতে না চায় এবং প্রত্যেক নবজাতকই যদি সমস্ত কার্যক্রমগুলো গ্রহণ করতে চায়, নির্ভর করতে চায় সম্পূর্ণরূপ নিজের উপর, তাহলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে পারে না। কারন সভ্যতা ও সংস্কৃতি হল আমাদের পূর্ব-পুরুষগণের জ্ঞান ও কর্মের ফসল।
শিক্ষকের বিচার-বিবেছনার প্রতি একজন ছাত্রের অগাধ শ্রদ্ধা ও আস্থা থাকে। কিন্তু তার সহকর্মী ও সমপর্যায়ের লোকদের উপর তা থাকে না। যে কোন বিষয় তাত্ত্বিক জ্ঞান লাভের পর প্রয়োগিক বিষয়ে জানার জন্য ছাত্রকে কিছুকাল শিক্ষানবীশ হিসাবে থাকতে হয়। জড় বিজ্ঞানের জন্য এ কথাটি যেমন সত্য, তেমনি সত্য আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষেত্রে। ধরা বুকে এমন অনেক বিষয় আছে যা কেবলমাত্র অধ্যয়ন বা শ্রবণ করে শেখা যায় না। এজন্য প্রয়োজন একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে থেকে ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ। এ ধরনের প্রশিক্ষণ অবধারিত বলে বিবেচিত না হলেও অবশ্যই জরুরী এবং সব সময়ের জন্য একথা সত্য। উপরুন্তু কেবলমাত্র জ্ঞান অর্জন করাটাই পর্যাপ্ত নয়। এটাকে আত্মস্থ করতে হয়, নিয়ে আসতে হয় নিজের উপলব্ধিতে। তাহলেই এটা পরিণত হয় মানুষের স্বভাবে।
সূফীয়ায়ে কিরাম আচার-আচরণের চারটি মৌলিক নীতির উপর গুরুত্ব আরোপ করে থাকেন। এর মধ্যে রয়েছে স্বল্প নিদ্রা, অল্প আহার, কম কথা এবং মানুষের সঙ্গে কম মেলামেশা। এখানে স্বল্প বা কম বলতে উপরোক্ত বিষয়গুলোকে সম্পূর্ণরূপে পরিহার করা বুঝায়নি। কারণ এগুলো সম্পূর্ণরূপে পরিহার করাটা কেবলমাত্র অনাকাক্সিক্ষতই নয়, ক্ষেত্র বিশেষে মানুষের সাধ্যেরও বাইলে। যেমন আহার ও নিদ্রাকে কখনো পুরোপুরি পরিহার করা যায় না। আসলে আহার, নিদ্রা, কথাবার্তা ও মেলা মেশায় সব সময় মধ্যপন্থা অবলম্বন করতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে যে, মানুষকে খেতে হবে বাচার জন্য, কিন্তু খাওয়ার জন্য বেচে থাকবে না। আল্লাহর ইচ্ছা ও নির্দেশকে প্রতিপালনের জন্য প্রয়োজন শক্তির। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সে যদি খাবার গ্রহণ করে তখন সেটা বিবেচিত হবে ইবাদ হিসাবে। অপরদিকে খাদ্য পরিহার করার কারণে যদি সে দুর্বল হয়ে পড়ে ও অপুষ্টিতে ভোগে এবং সে কারণে তার আধ্যাত্মিক সাধনার ক্ষমতা হ্রাস পায় তাহলে সেটা দোষের হবে। সুন্দর স্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজন নিদ্রার এবং সে কারণেই ঘুমকে মানুষের দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু অলসতা করলে অবস্থা দাঁড়াবে ঠিক এর উল্টো। আলস্যে মানুষ যেন তেন ভাবে শুয়ে বসে সময় কাটায়। এটা আধ্যাত্মিক সাধনাকে বাধাগ্রস্ত করে। স্বল্প নিদ্রার অর্থ এই নয় যে ঘুমকে পরিহার করে জাগতিক কাজকর্মের মধ্যে ডুবে থাকবে। বরং নিদ্রার পরিমাণ হ্রাস পেলে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগী এবং সৎকাজ করার জন্য বেশি সময় পাওয়া যাবে।
কথা কম বলার অর্থ হল অপ্রয়োজনীয় এবং নিরর্থক আলাপচারিতা থেকে বিরত থাকা। সম্ভব হলে সকল প্রকার খারাপ কথাবার্তা পরিহার করা। প্রায়ই দেখা যায় যে, আমরা অপরকে খুব ভাল ভাল পরামর্শ দেই, অথচ আমরাই আবার এগুলো প্রতিপালনের কথা ভুলে যাই। বস্তুতপক্ষে এটা আমাদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। মানুষের সঙ্গে কম মেলামেশার অর্থ হল অনাবশ্যক যোগাযোগ বা অহেতুক হাসি-তামাশার থেকে বিরত থাকা। যে মেলামেশার মাধ্যমে অপরের উপকার করা যায়, ব্যস্ত থাকা যায় এমন কোন কাজের মধ্যে যার দ্বারা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব, তেমন মেলামেশাই মানুষের জন্য কাক্সিক্ষত।
আমাদের এ কথা ভুলে যাওয়া উচিত নয় যে, ব্যক্তির বিকাশের স্তর অনুসারে তার চাহিদা সঙ্গে অন্যের চাহিদার তারতম্য ঘটে। সে কারণেই একজন অভিজ্ঞ শিক্ষকের জন্য যে উপদেশ প্রযোজ্য, একজন শিক্ষানবিশের বেলায় তা খাটে না। স্মরণ রাখতে হবে যে, জাগতিক মেলামেশা অনেক সময় আমাদের মধ্যে প্রলোভনের উদ্রেক করে, মূল্যবান সময়ের অপচয় ঘটায়, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব ও কর্তব্যগুলোকে ঠেলে দেয় বিস্মৃতির অন্তরালে।
উপরে উল্লিখিত চার ধরনের আচরণবিধির সঙ্গে আরেকটি বিষয় সংযোগ করা যেতে পারে। সেটি হল স্বল্প ব্যয়। এর অর্থ হল কোন জৌলুশ বা তুচ্ছ কারণে অথবা আত্মতৃপ্তির জন্য অর্থ ব্যয় থেকে বিরত থাকা। তা এমন কোন কাজে ব্যয় করা উচিত যা সকলের জন্য পসন্দীয় এবং কল্যাণকর হয়।
উল্লিখিত এ পাঁচটি আচরণবিধিকে গ্রহণ করা যেতে পারে ইসলামের আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক জীবনের ৫টি মৌল নীতি হিসাবে।
প্রতিটি মুসলমানকে সর্বক্ষণের জন্য আল্লাহকে স্মরণ করতে হবে। এ স্মরণ হতে হবে অন্তর থেকে। কিন্তু দীর্ঘ সময় একাগ্রচিত্তে আল্লাহকে স্মরণ করার কাজটা বেশ কঠিন। এজন্য আধ্যাত্মিক সচেতনতাকে জোরদার করতে হবে। চিন্তাকে নিবদ্ধ করতে হয় আল্লাহর প্রতি। এ কাজ দুটি করার জন্য তাকে কতকগুলো শারীরিক নিয়ম-নীতি অনুসরণ করতে হয়। কুরআন মজীদে উল্লেখ আছে যে,হে মু’মিনগণ। তোমরা অধিক পরিমানে আল্লাহর যিকর কর, এবং সকাল-সন্ধ্যায় তাঁর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষনা কর। (৩৩ ঃ৪১-৪২)।
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে : যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং বলে, হে আমাদের রব তুমি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করোনি, তুমি পবিত্র। তুমি আমাদিগকে অগ্নি-শাস্তি হতে রক্ষা কর (৩ ঃ ১৯১)।
এমন কিছু ইবাদ পদ্ধতি রয়েছে যেখানে কতকগুলো সবক বার বার পুনরাবৃত্তি করতে হয়। আবার এমন কিছু ইবাদত-বন্দেগী আছে যেগুলো একজন মানুষ অভ্যাসগতভাবেই নিয়মিত আদায় করে থাকে। কখনো এগুলো সে আদায় করে উচ্চস্বরে, কখনো আবার নিম্নস্বরে। তবে ইবাদত-বন্দেগীর ধরন যাই হোক না কেন, এগুলো অবশ্যই এক আল্লাহ জাল্লাশানুহুর পবিত্র গুণরাজির স্মরণে হতে হবে। কখনো এর ব্যতিক্রম হতে পারবে না। অথবা কখনো তা কোন সৃষ্টির প্রতি নিবেদন করা যাবে না। এমনকি ভক্তি ও শ্রদ্ধার কারণে হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কথা আমাদের স্মরণে আসলেও মহান আল্লাহ সম্পর্কে চিন্তা থাকবে মুখ্য। আমাদের যা কিছু চাওয়ার তা একমাত্র আল্লাহর নিকট হতে হবে। রাসূলুল্লাহ (সা.) এর উসীলা করে আল্লাহর নিকট মুনাজাত করা যেতে পারে। সে কারণেই আমরা এভাবে মুনাজাত করে থাকি যে-হে আল্লাহ তুমি রাসূলে করীম (সা.) এর প্রতি সদয় হও এবং তাঁকে হিফাজত কর।” অথবা “হে আল্লাহ। মুহাম্মদ (সা.) কে দান কর সর্ব্বোচ সম্মানিত স্থান ও সুমহান মর্যাদা যার প্রতিশ্র“তি তুমি তাঁকে দিয়েছ, এবং আমাদের পক্ষে তাঁর উসীলাকে তুমি কবুল কর।”
চিন্তায় স্থিরতা আনার জন সূফীয়ায়ে কিরাম বিশেষ কতকগুলো পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। যেমন-তারা কখনো কখনো নির্জনে নিভৃতে চলে যান। কখনো আবার চোখ বুজে ক্ষণিকের জন্য শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ রাখেন। এবং আল্লাহর যিক্র-এ মগ্ন থেকে হৃদয়ের স্পন্দনের প্রতি দৃঢ়ভাবে মনোনিবেশ করেন। তাঁরা আরো বলে থাকেন যে, আল্লাহকে স্মরণ করার তিনটি স্তর রয়েছে (ক) কেবলমাত্র তাঁর নামের যিকর করা। (খ) বিভিন্ন নামে বা সীফাতের মাধ্যমে তাঁর অস্তিত্বের যিকর করা। (গ) কোন সীফাত বা নামের উল্লেখ না করে একান্তভাবে তাঁর অস্তিত্বকে স্মরণ করা। রাসূলে করীম (সা.) নিজেও ইবাদ-বন্দেগীর এ সমস্ত ব্যবস্থাদির ব্যাপারে অনুমোদন দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হযরত আবূ হুরায়রা (রা.) এর সূতার তৈরি একটি তসবীহ ছিল। এতে ছিল ২০০০ গিট। প্রতিটি গিট ব্যবহৃত হত এক একটি পুতি হিসাবে। প্রতিনিদ রাতে তিনি একটি বিশেষ ভঙ্গিমায় বারবার এই তসবীহ পাঠ করতেন। অন্যান্য আচারসমূহের মধ্যে কেউ হয়তো বলবেন কৃচ্ছতা সাধনের কথা, নিজের কামনা-বাসনা দমনের কথা, বিশেষ করে মৃত্যু ও শেষ বিচার সম্বন্ধে চিন্তায় মনোনিবেশ করতে হবে। ইসলামে এগুলোই লক্ষ্য নয়, এগুলো হচ্ছে খুদীকে নিয়ন্ত্রণে রাখার উপায়মাত্র।
মানুষের ইহজাগতিক চাহিদাগুলো দু’ধরনের। কতকগুলো অত্যাবশ্যকী, আর কতকগুলো আরাম-আয়েশ সম্পর্কিত। আবশ্যকীয় বিষয়গুলো কেউ উপেক্ষা করতে পারে না। সেটা আত্মহত্যার শামিল। আর আত্মহত্যাকে ইসলামে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কারণ আমরা আমাদের জন্য বেঁচে নেই, বরং আমরা বেচে আছি আল্লাহর জন্য আর কোনকিছু পূর্ণতা প্রাপ্তির পূর্বেই তা নষ্ট করার অর্থ হল আল্লাহ পাকের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করা।
আরাম আয়েশ সংক্রান্ত বিষয়ে কথা এই যে, যদি এ বিষয়গুলোকে দুনিয়ায় বেঁচে থাকার লক্ষ্য হিসাবে বিবেচনা করা না হয় তাহলে সেটা বৈধ। তবে নিজের খুদী বা পশু স্বভাবকে পরিহার করার লক্ষ্যে একজনে (অসমাপ্ত)