হলি আর্টিজান হামলায় ৩৯ লাখ টাকার যোগানদাতা আত্মঘাতী সাইফুল্লাহ আটক ॥ নারীসহ ৬ জনের একটি জঙ্গি দল হিযরতের নামে আত্মগোপনে, তাদের দিয়ে বড় একটি হামলার ছক কষা হয়েছিল

100
আটক আত্মঘাতী সাইফুল্লাহ।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অবশেষে র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হলো দুনিয়া কাঁপানো গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁ জঙ্গি হামলার চার্জশীটভুক্ত এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম হত্যা মামলার মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি জেএমবির শীর্ষ নেতা সাইফুল্লাহ। তাকে ছয় দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। এই শীর্ষ নেতা বাংলাদেশে আইএসের মতাদর্শ প্রচার ও কর্মকাণ্ড এবং আইএসে স্টাইলে জঙ্গিদের সংগঠিত করার চেষ্টা চলেছিল। হলি আর্টিজানে হামলা ও অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যার অন্যতম পরিকল্পনাকারী এই জঙ্গি নেতা। অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যায় সরাসরি অংশ নেয়। আর হলি আর্টিজানে হামলার প্রস্তুতি নিতে জঙ্গিদের যত বৈঠক হয়েছে, সব বৈঠকেই সে উপস্থিত ছিল। হলি আর্টিজানে হামলা সফল করতে ৩৯ লাখ টাকাও দেয় এই জঙ্গি নেতা। সাইফুল্লাহর সঙ্গে বিদেশী জঙ্গি সংগঠনগুলোর শক্তিশালী যোগাযোগ থাকার তথ্য মিলেছে।
একের পর এক জঙ্গি গ্রেফতার হলেও তাদের তৎপরতা থেমে নেই। তারা গোপনে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যেই ছয় জনের একটি জঙ্গি দল বাড়ি থেকে হিযরতের নামে আত্মগোপন করেছে। ওই দলে নারী জঙ্গিও আছে। দলটির একটি বড় হামলার ষড়যন্ত্র আছে। তাদের গ্রেফতারে নতুন করে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত আছে। দলটি আত্মঘাতী জঙ্গি বলে গ্রেফতারকৃত সাইফুল্লাহ জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে র‌্যাবকে জানিয়েছে।
গত ২৫ জানুয়ারি বেলা তিনটার দিকে চাঁপাইয়ের নাচোল থেকে শরিফুল ইসলাম ওরফে খালিদ ওরফে রাহাত ওরফে সাইফুল্লাহ ওরফে নাহিদ ওরফে আবু সোলাইমানকে (২৭) গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় র‌্যাব-১ এর একটি দল। পরে তাকে ঢাকায় আনা হয়।
শনিবার কাওরানবাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে বাহিনীর লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান এই আসামি সম্পর্কে বিস্তারিত জানান। তিনি বলেন, সাইফুল্লাহর বাবার নাম আব্দুল হাকিম। বাড়ি রাজশাহীর বাগমারা থানাধীন শ্রীপুরের খামারপাড়া গ্রামে।
রাজশাহীর বাগমারা থানা এলাকায় ’৯১ সালে সাইফুল্লাহর। বাগমারা পাইলট হাইস্কুল থেকে ২০০৮ সালে এসএসসি এবং রাজশাহী সরকারী সিটি কলেজ থেকে ’১০ সালে এইচএসসি পাস করে। এসএসসি এবং এইচএসসি উভয় ক্ষেত্রে বিজ্ঞান বিভাগে এ প্লাস নম্বর পায়। ২০১০-১১ সেশনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজী বিভাগে অনার্সে ভর্তি হয়।
তৃতীয় বর্ষে পড়াকালীন একটি মেসে থাকার সময় ’১৩ সালের ডিসে¤¦রে আহসান হাবিব ওরফে শোভনের মাধ্যমে জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়ে সে। জঙ্গীবাদে যোগ দেয়ার পর শোভনের মাধ্যমে রাজশাহীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত সমমনাদের নিয়ে গঠিত একটি উগ্রবাদী গ্রুপের হয়ে কাজ করতে থাকে। গ্রুপের সদস্যরা অনলাইনভিত্তিক উগ্রবাদী মতবাদ প্রচার করত। পরে শোভনের মাধ্যমে রাজশাহীতে হলি আর্টিজানে হামলার আরেক শীর্ষ পরিকল্পনাকারী তামীম চৌধুরীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়।
ওই সময় জেএমবির আমির সারোয়ার জাহান ও অন্যতম শীর্ষ জঙ্গি নেতা তামীম চৌধুরীকে একত্রিত করেছিল। ২০১৫ সালে হলি আর্টিজান হামলা মামলার আরেক পলাতক আসামি র‌্যাবের হাতে সদ্য গ্রেফতারকৃত মামুনুর রশীদ ওরফে রিপনের বগুড়ার বাসায় সারোয়ার জাহান, তামিম, সাদ্দাম, মারজান, সাকিব মাস্টার ও সাইফুল্লাহ একত্রে মিটিং করে। মিটিংয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। ওই বৈঠকে সাইফুল্লাহকে জেএমবির মিডিয়া শাখা চালানোর দায়িত্ব দেয়া হয়।
সাইফুল্লাহ হলি আর্টিজানে হামলায় প্রত্যক্ষ অর্থ সংগ্রহ, হামলাকারী জঙ্গী নির্বাচন, হামলায় অংশ নেয়া জঙ্গিদের প্রশিক্ষণের কাজ করে। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা থানাধীন একটি আস্তানায় সারোয়ার জাহান, তামীম ও সাইফুল্লাহসহ কয়েকজন বৈঠক করে।
হলি আর্টিজানে হামলার আগে দলের নির্দেশে নিজের দক্ষতা প্রদর্শনের জন্য সাইফুল্লাহ ২০১৬ সালের ২৩ এপ্রিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম হত্যায় অংশ নেয়। সাইফুল্লাহ ও শিক্ষক একই এলাকায় বসবাস করত। এজন্য সাইফুল্লাহ ওই শিক্ষককে প্রায় এক মাস আগ থেকে ফলো করছিল। আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ছাত্র রিপন আলী ওরফে রকি রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের শিক্ষকদের ক্লাসের রুটিন মোবাইলের ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলে সাইফুল্লাহর কাছে পাঠায়। ওসমান মিলু ও মাসকাওয়াত ওরফে আব্দুল্লাহ শিক্ষক হত্যায় ব্যবহৃত মোটরসাইকেলটি সংগ্রহ করেছিল।
সাইফুল্লাহর সার্বিক নির্দেশনায় এবং উপস্থিতিতে শিক্ষক রেজাউল করিমকে হত্যা করে জঙ্গিরা। হত্যাকান্ড শেষে হাসান ওরফে ‘বাইক হাসান’ মোটরসাইকেলযোগে শরিফুল ও খাইরুল ইসলাম ওরফে পায়েলকে নিয়ে যায়। পরে তাদের খরখড়ি বাইপাসের কাছে নামিয়ে দেয়। খাইরুল চাপাতি, রক্তমাখা কাপড়-চোপড়ের ব্যাগ নিয়ে যায়। বাইক হাসান ও সাইফুল্লাহ তাহেরপুর হয়ে নাটোরে বাইক হাসানের ভাড়া বাসায় ওঠে। পরদিন তারা ঢাকায় আসে। ঢাকায় দুই দিন থাকার পর অজ্ঞাত জায়গায় আত্মগোপন করে।
আত্মপোগনে থেকে সাইফুল্লাহ ও মামুনুর রশিদ ওরফে রিপন মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশের জঙ্গি ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর কাছ থেকে ৩৯ লাখ টাকা সংগ্রহ করে। সব টাকা তারা হলি আর্টিজানে হামলার জন্য পরিকল্পনাকারীদের কাছে পাঠিয়ে দেয়। ওই টাকা হলি আর্টিজান হামলায় ব্যবহৃত হয়েছে।
সাইফুল্লাহ ’১৭ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে আত্মগোপন থেকে বের হয়। আবার সে জঙ্গিদের সংগঠিত করতে থাকে। সম্প্রতি র‌্যাবের হাতে হলি আর্টিজান মামলার চার্জশীটভুক্ত আসামি জঙ্গি মামুনুর রশীদ গ্রেফতারের পর সাইফুল্লাহ সম্পর্কে তথ্য দেয়। সেই তথ্য মোতাবেক তাকে শেষ পর্যন্ত চাঁপাই থেকে গ্রেফতার করা হয়।
র‌্যাবের এই কর্মকর্তা বলছেন, একের পর এক জঙ্গিরা গ্রেফতার হচ্ছে। তারপরেও তাদের তৎপরতা থেমে নেই। তারা গোপনে তৎপরতা চালাচ্ছে। আটক হলি আর্টিজানের দুই পলাতক জঙ্গী চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক ইতোমধ্যেই ছয় সদস্যের একটি জঙ্গি দল হিযরত করার উদ্দেশ্যে আত্মগোপনে চলে গেছে। তারা আত্মগোপনে থেকে বড় ধরনের নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা করছে। তারা চক্রান্ত বাস্তবায়নে নানাভাবে তৎপরতা চালাচ্ছে। ওই জঙ্গি দলে নারীও আছে। দেশে একের পর জঙ্গী হামলার পর সারাদেশে র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে। অভিযানের মুখে অনেক জঙ্গি পার্শ্ববর্তী দেশে আত্মগোপনে চলে গেছে। আত্মগোপনে থাকা অনেক জঙ্গী আবার দেশে ফেরা শুরু করেছে। তারা দেশে ফিরেই জঙ্গিদের সংগঠিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তাদের গ্রেফতারে সারাদেশে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে। নেতৃত্বশূন্যতায় থাকায় নিচের লেভেলের জঙ্গিরা নেতৃত্বে আসার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এছাড়া পলাতক মেজর জিয়াও এক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মেজর জিয়াকে গ্রেফতারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক সারওয়ার-বিন-কাশেম, র‌্যাবের মিডিয়া উইংয়ের উপপরিচালক মেজর রইসুল ইসলামসহ উর্ধতন র‌্যাব কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
আমাদের কোর্ট রিপোর্টার জানান, শনিবার বিকেলে সাইফুল্লাহকে মুগদা থানায় দায়েরকৃত সন্ত্রাস বিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করে ঢাকার সিএমএম আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ। বিচারক সাদবীর ইয়াসির চৌধুরী শুনানি শেষে ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।