প্রার্থী তালিকা নিয়ে বিএনপিতে হ-য-ব-র-ল অবস্থা ॥ দলের দায়িত্বশীলরাও বলতে পারছেন না কত জনকে চিঠি দেওয়া হয়েছে

61

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিএনপির প্রার্থী তালিকা নিয়ে হ-য-ব-র-ল অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলের কতজন প্রার্থীকে মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছেন না। প্রতি আসনে কমপক্ষে ২ জন করে প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। অনেক আসনে ৩ থেকে ৪ জনকেও দলীয় মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে অধিকাংশ সংসদীয় আসনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের মধ্যে চলছে চরম অস্থিরতা।
মঙ্গলবার বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ২৪০ আসনে বিএনপি এককভাবে নির্বাচন করবে এবং ৬০ আসন জোটের শরিকদের ছেড়ে দেয়া হবে। ২৪০ আসনে প্রায় ৮০০ প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে। তার এ বক্তব্যের পর শরিকদের ছেড়ে দেয়া হবে এমন আরও ২০টি আসনেও দলীয় প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়ন চিঠি বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া আগে যেসব আসনে বিএনপির মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে শেষদিন রাতেও নতুন করে আরও অনেককে মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে। সে হিসেবে বিএনপি থেকে এবার দলীয় মনোনয়নের চিঠি পেয়েছেন ৮ শতাধিক প্রার্থী। জানা যায়, বুধবার মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনেও কোন কোন আসনে নতুন প্রার্থী মনোনয়নের চিঠি নিয়েছেন। যেমন বগুড়া-৬ আসনে নতুন করে মনোনয়নের চিঠি নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার পাশাপাশি দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন।
এ নিয়ে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয় ও নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দলের কত জনকে এবার মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে সে প্রশ্নের সদুত্তর পাওয়া যায়নি। তবে প্রতি আসনে একাধিক প্রার্থী থাকায় এবার ৮ শতাধিক প্রার্থীর মধ্যে মনোনয়নের চিঠি বিতরণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ঠিক কত জনকে চিঠি দেয়া হয়েছে সুনির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিভিন্ন আসনে সকালে একজনকে মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে তো বিকেলে আরেক জনকে দেয়া হয়েছে। আবার দেখা গেছে মধ্য রাতে আরেকজনকে ডেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। কে কখন কাকে ডেকে মনোনয়নের চিঠি দিয়েছেন তার হিসেবও সঠিকভাবে রাখা হয়নি। কখনও মাইকে ডেকে ডেকে মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে আবার কখনও বা গোপনে কাউকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এছাড়া দলীয় মনোনয়নপত্র জমা না দিয়ে এবং সাক্ষাতকারে অংশ না নিয়েও কেউ কেউ মনোনয়নের চিঠি পেয়ে গেছেন। আবার দলীয় মনোনয়নপত্র জমা ও সাক্ষাতকার দিয়েও মনোনয়নের চিঠি পাননি। তাই দলীয় মনোনয়নের পুরো বিষয়টি নিয়েই হ য ব র ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
অবশ্য বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাগারে ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান লন্ডনে থাকায় এবার দলীয় মনোনয়নের বিষয়টি এককভাবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখার কেউ ছিলেন না। ২০০১ সালের নির্বাচনে এ বিষয়টি এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। আর তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করতেন তারেক রহমান। ২০০৮ সালের নির্বাচনেও খালেদা জিয়া এককভাবেই এ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতেন। কিন্তু এবার প্রেক্ষাপট ভিন্ন। খালেদা জিয়া কারাবন্দী থাকায় এ বিষয়ে কোনভাবেই সহযোগিতা করতে পারেননি। আর তারেক রহমান লন্ডনে বসে প্রার্থী তালিকা ঠিক করলেও অনেক নেতার নামে মামলা ও কেউ কেউ ঋণখেলাপী হওয়ায় এবং মনোনয়ন না পেলে নেতারা দল ছেড়ে চলে যেতে পারেন এমন আশঙ্কা থেকে কৌশল গ্রহণ করে বিএনপি। আর এ কৌশলের অংশ হিসেবেই একই আসনে একাধিক প্রার্থীকে দলীয় মনোনয়নের চিঠি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
এদিকে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিনেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর সঙ্গে আসন বণ্টনের বিষয়টি ফয়সালা করতে পারেনি বিএনপি। যে কারণে শেষদিকে গিয়ে বিএনপির কোন প্রার্থীকে নির্বাচনের মাঠ ত্যাগ করে শরিক দলকে আসন ছেড়ে দিতে হয় এ নিয়েও আশঙ্কা রয়েছে। বিশেষ করে যে যে আসন ছেড়ে দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে সেখানকার দলীয় প্রার্থীরা পুরোদমে ভোটের মাঠে নামতে পারছেন না। কেউ কেউ মনে করছেন টাকা-পয়সা খরচ করে শেষ পর্যন্ত অন্যকে আসন ছেড়ে দিতে হলে সেটা কেমন হবে। এছাড়া অনেক আসনে দলের কর্মী সমর্থকদের মধ্যেও প্রার্থী নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। তাই এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত চরম অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে বিএনপি এবার দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিষয়ে আসলে কি কৌশল নিয়েছে দেশের মানুষের কাছে তা পরিষ্কার নয়। তাই প্রতি সংসদীয় এলাকায় বিএনপির একাধিক প্রার্থী দেয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার শেষ নেই।
বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে একই আসনে আপাতত একাধিক প্রার্থী থাকলেও শেষ পর্যন্ত প্রতি আসনে একজন করেই প্রার্থী থাকবেন। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, বিএনপির প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করতে ৯ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। ৯ ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রতি আসনে বিএনপির একজন প্রার্থী রেখে বাকিদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা হবে। একই ভাবে শরিক দলগুলোকে যেসব আসন ছাড়া হবে সেখানে শরিক দলের একজন প্রার্থী ছাড়া বিএনপিসহ জোটের আর কোন প্রার্থী রাখা হবে না। বিভিন্ন কারণে এ কৌশল নেয়া হয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।
সূত্র মতে, সরকারী দল আওয়ামী লীগকে কৌশলে মোকাবেলা করতে বিএনপি নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে আপাতত একই আসনে একাধিক প্রার্থী রেখে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ রেখে এগিয়ে যেতে চায় দলটি। ৯ ডিসেম্বরের পর চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঠিক করে যাদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করা হবে তাদের নানাভাবে ম্যানেজ করার চেষ্টা করবে। এতে করে দলের কোন নেতা অন্য দলে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না বলে বিএনপির সিনিয়র নেতারা মনে করছেন। তবে শেষ পর্যন্ত এ কৌশল নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দ্বন্দ্বসংঘাত আরও বেড়ে যায় কি না অভিজ্ঞ মহল এমন আশঙ্কাও করেছেন।