হেদায়াত পেতে কেন তাকওয়া প্রয়োজন

95

ডাঃ হাফেজ মাওলানা মোঃ সাইফুল্লাহ মানসুর

কুরআন থেকে হেদায়াত পেতে হলে মানুষের সর্বপ্রথম যে গুণটি অর্জন করতে হবে তা হচ্ছে তাকওয়া। তাকওয়ার গুণ ছাড়া কোনভাবেই কোরআন থেকে হেদায়াত পাওয়া সম্ভব না। আল্লাহ তা’য়ালা কুরআনের প্রথমেই স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন- هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ অর্থাৎঃ এটি মুত্তাক্বিদের জন্য হেদায়াত গ্রন্থ। যদিও কুরআনের সূরা বাকারার ১৮৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে- أُنزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِّلنَّاسِ অর্থাৎ কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানব জাতির হেদায়াতের জন্য। এর মাধ্যমে এটাই প্রমাণ হয় যে, কুরআন হেদায়াতের পথ দেখাতে চায় গোটা মানবজাতিকে কিন্তু মানব জাতির মধ্যে যারা মুত্তাকী হয়েছে, তাকওয়ার নীতি অবলম্বন করেছে শুধুমাত্র তারাই কুরআন থেকে হেদায়াত লাভ করেছে, অন্যরা না। তাই কুরআন থেকে হেদায়াত পেতে হলে অবশ্যই খোদাভীতি বা তাকওয়ার গুণ অর্জন করতে হবে এবং এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে।
তাকওয়ার বিশ্লেষণ : তাকওয়ার আভিধানিক অর্থ হলো বেঁচে থাকা, রক্ষণাবেক্ষণ করা, ভয় করা, বিরত থাকা ইত্যাদি, পারিভাষিক অর্থে তাকওয়া বলতে, আল্লাহর ভয় ও তার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে যাবতীয় অপরাধ, অন্যায় ও আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ, কথা ও চিন্তা থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার নাম ত্বাকওয়া।
আল্লামা জালাল উদ্দিন সূয়ুতী (রঃ) বলেন- তাকওয়া হলো এমন সব বস্তু থেকে বেচে থাকা বুঝায় যা আখিরাতের দৃষ্টিতে ক্ষতিকর, হোক সেটা আকাইদ ও আখলাক সংক্রান্ত কিংবা কথা ও কাজ সংক্রান্ত। একবার হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.)-কে ওমর (রা.) তাকওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তিনি বললেন, হে আমীরুল মু’মিনিন আপনি কি কখনো পাহাড়ের দুই ধারে কাঁটাযুক্ত মাঝখানের সরু পথ দিয়ে হেঁটেছেন? তিনি বললেন হ্যাঁ; আবার জিজ্ঞেস করলেন হে আমীরুল মু’মিনিন, তখন আপনি কিভাবে হেঁটেছেন ? তখন ওমর (রা.) বলেন- এমতাবস্থায় আমার গায়ে যেন কাটা না লাগে সে জন্য জামা গুটিয়ে খুব সাবধানে সতর্কতার সাথে পথ অতিক্রম করেছি। তখন হযরত উবাই ইবনে কাব (রা.) বললেন, হে আমীরুল মু’মিনিন এটাই হলো তাকওয়া। এর থেকে বুঝা যায় দুনিয়ার সমস্ত খারাপি থেকে খুব সতর্কতার সাথে নিজেকে মুক্ত রেখে আল্লাহ ভয়ে জীবন-যাপন করার নামই হেলা তাকওয়া এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, (মুত্তাকী) তারা যারা আল্লাহ পাকের কোনো আদেশ অমান্য করে না আর আল্লাহ পাক তাদের যে আদেশ করেন তা যথাযথভাবে পালন করে। -সূরা তাহরীম ৬৬ : ৬। তাকওয়া মূলত এক অদৃশ্য জিনিস যা একান্ত আল্লাহর সাথে সম্পর্ক। যেমন নবী করীম (স.) বলেছেনঃ “আল্লাহ তা’আলা তোমাদের চেহারা, আকৃতি ও সম্পদ দেখেন না, বরং তিনি তোমাদের অন্তর ও কাজ-কর্ম দেখেন। ” ( মুসলিম, ও ইবনে মাজাহ)
তাকওয়া দুই ভাবে আমল করা যায় যথা : খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে-
বান্দা যখন দুনিয়ার এ কন্টকময় চলার পথে শয়তানের কোন ধোকা বা দুনিয়ার কোন লোভ-লালসার খপ্পরে পড়ে খারাপ কাজে লিপ্ত হতে যায় ঠিক সেই মুহূর্তে যদি শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে নিজেকে সেই পাপ কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে সেটায় হলো তাকওয়া। যখন দুনিয়ার কেউ থাকে না এমতাবস্থায় কোন অন্যায় বা খারাপ কাজ করলে বাধা দেবার মত কিংবা দেখার মত কেউ থাকে না, ঠিক সেই মুহূর্তে শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে সকল খারাপ কাজ থেকে বিরত থাকাই হলো তাকওয়া।
যেমন আল্লাহ তা’য়ালা বলেন- তারা আল্লাহ পাকের কোনো আদেশ অমান্য করে না। আর আল্লাহ পাক তাদের যে আদেশ করেন তা পালন করেন। -সূরা তাহরীম ৬৬ : ৬
ভাল কাজ করার মাধ্যমে : একজন মুত্তাকী যত ছোট থেকে বড় আমলই করুক না কেন তা শুধুমাত্র আল্লাহর জন্যই করবে। এ ভাল কাজ করার পিছনে, না থাকে কোন দুনিয়াবী চাওয়া-পাওয়া আর না থাকে আল্লাহ ছাড়া কোন ব্যক্তি বা বস্তুর মনপ্রবঞ্চনা পাওয়া। অর্থাৎ একজন মুত্তাকীর সমস্ত কর্মকান্ড, সমস্ত চাওয়া পাওয়া হবে একমাত্র আল্লাহকে ঘিরেই।
যেমন একটি হাদীসে নবী করীম (সা.) বলেছেন: “আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামতের দিন তোমাদের বংশ ও আভিজাত্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন না। বরং তোমাদের মধ্যে যে বেশী আল্লাহভীরু সে-ই আল্লাহর কাছে সর্বাধিক মর্যাদার অধিকারী হবে ৷” ( ইবনে জারীর)
মুত্ত্বাকী সেই হতে পারবে যার মধ্যে দুটি গুণ বিদ্যমান থাকবে যথা :
১. একজন মুত্তাকীর ভালো ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতা বা পার্থক্য বুঝার মত মানসিকতা থাকতে হবে।
২. তার মধ্যে মন্দ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ও ভালোকে গ্রহণ করার আকাংখা এবং এ আকাক্সক্ষাকে বাস্তবায়িত করার ইচ্ছা থাকতে হবে।
তাফসীরে জালালাইনে মুত্তাকীদের তিনটি স্তর বর্ণনা করেছেন যথা :
১ম স্তর হলো কুফর থেকে তওবা করে ইসলামে প্রবেশ করা এবং নিজেকে চিরস্থায়ী জাহান্নামের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা।
২য় স্তর হলো নফসকে কবীরা গুনাহ থেকে নিজেকে বিরত রাখা এবং ছগীরা গুনাহ থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করা।
৩য় স্তর হলো নিজের নফসকে ঐ সকল বস্তুথেকে বিরত রাখা যেগুলো আল্লাহ তা’য়ালার স্বরণ থেকে গাফিল করে দেয়। (পৃ: ৭৪ ১ম খন্ড)
তাফসীরে মাজেদীতে বলা হয়েছে, মুত্তাকী তারাই যাদের অন্তরে আল্লাহভীতি বিদ্যমান রয়েছে, আর রয়েছে সত্য গ্রহন করার মানসিকতা। তানা হলে সে কখনো কুরআন থেকে হেদায়াত পাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন-
পক্ষান্তরে যে স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে উপস্থিত হওয়ার ভয় করে এবং প্রবৃত্তির খারাপী থেকে নিজেকে বিরত রাখে, জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল।’ সূরা নাযিআত ৭৯ :
কেন তাকওয়া প্রয়োজন?
১. শুধুমাত্র আল্লাহর ভয়ে সকল প্রকার প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্যের গুনাহ থেকে বেঁেচ থাকার জন্য তাকওয়া প্রয়োজন।
২. নির্জনে একাকীত্বের খারাপি থেকে বেঁেচ থাকার জন্য তাকওয়া প্রয়োজন।
৩. সকল প্রকার আমানত রক্ষার জন্য তাকওয়া প্রয়োজন।
৪. নিজ পারিবারিক ও সাংগাঠনিক দায়িত্ব পালন যথাযথভাবে হক্ব আদায় করে করার জন্য তাকওয়া প্রয়োজন।
৫. রাষ্ট্রের আমানত ও দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করার জন্য তাকওয়া প্রয়োজন।
এক কথায় তাকওয়া ছাড়া কোন ভাবেই নিজেকে গুনাহের কাজ থেকে এবং খারাপীর হাত থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব না।
তবে যারা দুনিয়ায় পশুর মতো জীবন যাপন করে, নিজেদের কৃতকর্ম সঠিক কি না সে ব্যাপারে কখনো চিন্তা করে না, যেদিকে সবাই চলছে বা যেদিকে প্রবৃত্তি তাকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে, যে দিকে তার মন চায় সে দিকে চলতে যারা অভ্যস্ত, তাদের জন্য কুরআনে কোন পথ নির্দেশনা বা হেদায়াত নেই ৷ কুরআন থেকে তারা কখনো হেদায়াতপ্রাপ্ত হবে না। তাইতো আল্লাহ তায়ালা বলেন- هُدًى لِّلْمُتَّقِينَ এটা মুত্তাকীদের জন্য হেদায়াত গ্রন্থ। আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেন-তারা কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করলে আল্লাহ্কে সাথে সাথে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া কে তোমাদের পাপ ক্ষমা করবে? আর তারা জেনে বুঝে ভুল করে ফেলে তাতে অটল থাকে না। -সূরা আলে ইমরান : ৩ : ১৩৫ আল্লাহপাক আমাদের সর্ববস্থায় মুত্ত্বাকীর জীবন-যাপন করা তৌফিক দান করুন আমিন।