কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ৭২তম জন্মদিন আজ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনা ১৯৪৭ সালের এই দিনে মধুমতি নদী বিধৌত গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশবকাল কাটে পিত্রালয়ে। ৫৪’র নির্বাচনের পর শেখ হাসিনা বাবা-মার সঙ্গে ঢাকায় চলে আসেন। রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান হিসেবে ছাত্রজীবন থেকে প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন তিনি। শুধু জাতীয় নেতাই নন, তিনি আজ তৃতীয় বিশ্বের একজন বিচক্ষণ বিশ্বনেতা হিসেবে অবতীর্ণ হয়েছেন নতুন ভূমিকায়। সর্বশেষ ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে ‘বিশ্ব মানবতার বাতিঘর’ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন বিশ্ব নেতাদের কাছ থেকে।
৩৭ বছরের দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় শেখ হাসিনা কেবল সেই মহান নেতার কন্যা এবং তাঁর রাজনীতির উত্তরসূরি হিসেবে গণমানুষের প্রধান নেতার আসনে স্থান পাননি, তিনি জেল-জুলুম, মামলা-হামলা, হত্যা চেষ্টাসহ হাজারো হুমকির মুখে অটল থেকে নেতৃত্বের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তিনি নবপর্যায়ের বাংলাদেশের নতুন ইতিহাসের নির্মাতা। হিমাদ্রী শিখর সফলতার মূর্ত-স্মারক, উন্নয়নের কা-ারি। উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের রূপকার। সাগর সমান অর্জনে সমৃদ্ধ আওয়ামী লীগ সভাপতির কর্মময় জীবন। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাহসী নেতৃত্ব জনগণের কাছে আদর্শ ও অনুপ্রেরণার প্রতীক হয়ে আছেন তিনি। প্রতি বছরের মতো এবারও রাজনৈতিক পথপরিক্রমায় ছাত্রনেত্রী থেকে জননেত্রীতে পরিণত হওয়া শেখ হাসিনার জন্মদিন পালিত হবে অতি সাধারণভাবে।
রাষ্ট্রীয়কাজে জাতিসংঘের অধিবেশনে যোগদানের জন্য বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফর করছেন প্রধানমন্ত্রী। গত বছরের মতো এবারও যুক্তরাষ্ট্রে তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়সহ ভাগ্নে-ভাগ্নি, নাতি-নাতনীদের সঙ্গে পারিবারিক পরিবেশে তার জন্মদিন পালন করবেন শেখ হাসিনা। দেশে না থাকলেও আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন সংগঠন বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ কন্যার জন্মদিন উপলক্ষে গ্রহণ করেছে বিস্তারিত ও বর্ণাঢ্য কর্মসূচী।
১৯৭৫ সালের পটপরিবর্তনের পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে দলীয় প্রধানের দায়িত্ব নেন শেখ হাসিনা। এরপর তিন যুগ ধরে দেশের এই প্রধান রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিয়ে রাজনীতির মূল স্রোতধারার প্রধান নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বেই তৎকালীন বিএনপি সরকারের পতন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিজয় অর্জন করে আওয়ামী লীগ। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় প্রধান বিরোধী দলের নেতা হিসেবে তার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে প্রথমে ১৪ দলীয় জোট এবং পরে মহাঐক্যজোট গড়ে ওঠে। ১৪ দল ও মহাঐক্যজোটের তীব্র আন্দোলনের মুখে অধ্যাপক ড. ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২২ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচন করার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরী অবস্থা জারি করে ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় এলে ওই বছরের ১৬ জুলাই গ্রেফতার হন শেখ হাসিনা। এরমধ্য দিয়ে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে প্রথমবারের সংসদ ভবন চত্বরের বিশেষ কারাগারে তাকে প্রায় ১১ মাস বন্দী থাকতে হয়। গণতান্ত্রিক আন্দোলন করতে গিয়ে এর আগেও কয়েক দফা গৃহবন্দী হয়েছেন তিনি।
শেখ হাসিনার শিক্ষাজীবন শুরু হয় টুঙ্গিপাড়ার এক পাঠশালায়। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমপিএ) নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর পরিবারকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন। তিনি পুরান ঢাকার মোগলটুলির রজনী বোস লেনে বসবাস শুরু করেন। পরে তিনি যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার সদস্য হন। আবাস স্থানান্তরিত হয় ৩ নম্বর মিন্টো রোডের সরকারী বাসভবনে। ১৯৫৬ সালে শেখ হাসিনা ভর্তি হন টিকাটুলির নারীশিক্ষা মন্দির বালিকা বিদ্যালয়ে। এভাবেই শুরু হয় তাঁর শহরবাসের পালা, তাঁর নাগরিক জীবন। ১৯৬১ সালের ১ অক্টোবর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর রোডের বাড়িটির দারোদ্ঘাটন হয়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবার মৃত্যুর পূর্বদিন পর্যন্ত এই বাড়িতেই অবস্থান করেন। ১৯৬৫ সালে শেখ হাসিনা আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৬৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন ঢাকার বকশী বাজারের পূর্বতন ইন্টারমিডিয়েট গবর্নমেন্ট গার্লস কলেজ (বর্তমান বদরুন্নেসা সরকারী মহিলা মহাবিদ্যালয়) থেকে। ওই বছরই ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি কলেজছাত্রী সংসদের সহ-সভানেত্রী পদে নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় কিশোর বয়স থেকেই তার রাজনীতিতে পদচারণা। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ছাত্রলীগের নেত্রী হিসেবে তিনি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন এবং ৬ দফা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। সহজ সারল্যে ভরা তার ব্যক্তিগত জীবন। মেধা-মনন, কঠোর পরিশ্রম, সাহস, ধৈর্য, দেশপ্রেম ও ত্যাগের আদর্শে গড়ে উঠেছে তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। পোশাকে-আশাকে, জীবনযাত্রায় কোথাও তার বিলাসিতা বা কৃত্রিমতার কোন ছাপ নেই। নিষ্ঠাবান ধার্মিক তিনি। নিয়মিত ফজরের নামাজ ও কোরান তেলওয়াতের মাধ্যমে তার দিনের সূচনা ঘটে। পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেছেন কয়েকবার।
১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু উত্থাপিত ৬ দফা দাবিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে এক অভূতপূর্ব জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি হয়। শাসকগোষ্ঠী ভীত-সন্তস্ত্র হয়ে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। শুরু হয় প্রচন্ড দমন-নির্যাতন। আটক থাকা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী দায়ের করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তার জীবন ও পরিবারের ওপর নেমে আসে গভীর বিপদাশঙ্কা ও দুঃসহ দুঃখ-কষ্ট। এই ঝড়ো দিনগুলোতেই, কারাবন্দী পিতা বঙ্গবন্ধুর আগ্রহে পরমাণু বিজ্ঞানী ড. এম. এ ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিয়ে হয় ১৯৬৮ সালে।
বিয়ের কিছুদিন পর শুরু হয় ১১ দফা আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান। শেখ হাসিনা ছাত্রলীগ নেত্রী হিসেবে তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৮১ সালের ১৩-১৫ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন। জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে তাকে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ডাক আসে দেশ-মাতৃকার হাল ধরার। সামরিক শাসকদের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন শেখ হাসিনা। এরপর দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলে তার একটানা অকুতোভয় সংগ্রাম। জেল-জুলম, অত্যাচার কোনকিছুই তাঁকে তাঁর পথ থেকে টলাতে পারেনি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এ পর্যন্ত দুই মেয়াদ পূর্ণ করে তৃতীয় মেয়াদও প্রায় শেষ পর্যায়ে। গণতন্ত্র এবং দেশের মানুষের ভোট ও ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন সংগ্রামে অসামান্য অবদান রাখার পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনায়ও ব্যাপক সাফল্যের পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। ১৯৯৬-২০০১ সালে তার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি ও গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি তার সরকারের অন্যতম সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তৃতীয় মেয়াদেই ভরতের সঙ্গে ঐতিহাসিক স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন করেছেন। বর্তমানে তার নেতৃত্বাধীন সরকার ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য পূরণে নিয়োজিত আছে।
দক্ষভাবে রাষ্ট্র পরিচালনায় সারাবিশ্বের অনেক সম্মানজনক পদকে ভূষিত হয়েছেন বঙ্গবন্ধুর এই কন্যা। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে। সমুদ্র জয়ের পর বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে মহাকাশও জয় করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর অতিসম্প্রতি মিয়ানমার সরকারের ভয়াবহ নির্যাতনে আশ্রয়হীন ৫ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়ে নাড়িয়ে দিয়েছেন বিশ্বকে, বিশ্ববিবেককে। আজ সারাবিশ্বেই তার নাম আলোচিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মানবতার বিবেক’ হিসেবে। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তার এই মানবিক দৃষ্টান্তের প্রশংসায় ছিলেন পঞ্চমুখ। নিখাদ দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা ও মানবিক গুণাবলী তাকে আসীন করেছে বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে। তিনিই বাঙালীর জাতীয় ঐক্যের প্রতীক এবং ভরসার শেষ আশ্রয়স্থল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে আজকের দিনটি সারাদেশেই উৎসবমুখর পরিবেশে পালন করবে আওয়ামী লীগ। কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে আজ বিকেলে কৃষিবিদ ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘নবীনদের দৃষ্টিতে শেখ হাসিনা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী। এছাড়াও বাদ জুমা জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল, সকাল ১০টা আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহার (মেরুল বাড্ডা) ও সকাল ৯টায় খ্রীস্টান এ্যাসোসিয়েশন বাংলাদেশের উদ্যোগে সেনপাড়া পর্বতায় এবং বেলা ১১টায় ঢাকেশ্বরী মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ১০টায় ঢাকাসহ সারাদেশে সব সহযোগী সংগঠনের উদ্যোগে আনন্দ র্যালি ও শোভাযাত্রা কর্মসূচী পালন করা হবে।
এছাড়া শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে আজ সকাল ১০টায় দলের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপ কমিটির উদ্যোগে গরিব ও অসহায় ব্যক্তিদের মাঝে বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে রিক্সা ভ্যান বিতরণ করা হবে। ব্যতিক্রমী কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণ আজ রাজধানীতে প্রায় দুই লাখ মানুষকে মিষ্টিমুখ করানোর পাশাপাশি মতিঝিলের আরামবাগ বাফুফে মাঠে বিশেষ দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে, যেখানে ৩০ হাজার যুবক অংশ নেবেন।
দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন উপলক্ষে দেশের সব মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গীর্জায় দোয়া-প্রার্থনাসহ দেশের সব জেলা, মহানগর, উপজেলা, পৌর, ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডসহ সব শাখার নেতৃবৃন্দকে কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দিনটি উৎসবমুখরভাবে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।